‘তিমির হননের নেত্রী’র জন্মদিনের শুভেচ্ছা

2230

Published on সেপ্টেম্বর 19, 2020
  • Details Image

ড. আতিউর রহমান

দারুণ এক অন্ধকার নেমে এসেছিল এই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে। যিনি ছিলেন বাংলাদেশের আরেক নাম তাঁকেই এক কালরাতে আঘাত হানে এক দল বেঈমান। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার বাঙালির জাতির পিতাকে আচমকা আক্রমনে তাঁর প্রিয় দেশবাসী থেকে শারিরীকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তাঁর পরিবারের সবাইকে তারা সে রাতে হত্যা করে নির্মমভাবে। শুধু বেঁচে যান তাঁর দু’কন্যা বিদেশে থাকার কারণে। ইতিহাসের সেই করুণ অধ্যায়ের কথা মনে এলেই কারবালার কথা মনে পড়ে। পুরো বাঙালি জাতি তখন দুঃখে মুহ্যমান। চারিদিকে শুধুই অন্ধকার। এই তমসাচ্ছন্ন বাংলাদেশে আলোকবর্তিকা হিসেবে যেদিন পা রাখেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হসিনা সেদিন চারি দিক আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর তাই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ শামসুল হক লিখে ফেলেন সেই বৃষ্টিভেজা দিনটিই ছিল শেখ হাসিনার জন্মদিন। রূপক অর্থেই তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যার এই জন্মদিনের অবতারনা করেছিলেন। তিনি লিখেছেন:

“সেই বৃষ্টি সেই অশ্রু আপনার সেই ফিরে আসা
নিমজ্জিত নৌকোটিকে রক্ত থেকে টেনে তুলবেন,
মানুষের দেশে ফের মানুষের সংসার দেবেন
ফিরেছেন বুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা।
সেদিনই হয় জন্মলাভ প্রকৃত অর্থেই,
আপনার জন্মদিন আমাদের কাছে সেই দিন,
যেদিন ফেরেন ঘরে আমাদের হৃদয়ে আসীন,
যেদিন স্বর্গের ফুল ফুটে ওঠে মাটির মর্ত্যেই।”
(‘শেখ হাসিনার জন্মদিন: ২০০৯’)।

কবি আরও লিখেছেন,” আপনি সে জন বটে যাকে জন্ম দেয় ইতিহাস”। ইতিহাসের এই অনন্য কন্যা বরাবরই ছিলেন‘ জনকের স্বপ্নবাহু’। তাই তিনি অনেক ত্যাগের বিনিময়ে হতে পেরেছেন বাঙালির ‘অন্ধকারে বাতিঘর, মুমূর্ষের নিঃশ্বাস’। এই জায়গায় আসাটা তাঁর জন্য মোটেও সহজ ছিল না। কতো ঘাত-প্রতিঘাত পায়ে দলে তাঁকে এগুতে হয়েছে। কতোবার তাঁকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে নিয়তি। এমনটিই যে হবে তা কিন্তু জানতেন আরেক কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিরা যেন অন্তর্যামী। তাই তিনি লিখেছেন:

“শেখ হাসিনা, আপনার বেদনা আমি জানি,
জানি, দুঃখ রজনী ফুরাতে চায় না সহজে।
আপনার প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে
আপনি পা রেখেছেন মাত্র।
আপনার পথে পথে পাথর ছড়ানো।
পাড়ি দিতে হবে দুর্গম গিরি, কাণ্ডার মরুপথ।”
(‘পথে পথে পাথর’)।

কবির সেই আশঙ্কা মিথ্যে ছিলো না। নিরন্তর তিনি ভয়কে জয় করে এগিয়ে গেছেন সম্মুখ পানে। মৃত্যুকে যিনি ভয় পান না তিনিই তো প্রকৃত বীর। যেমনটি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তেমনি সাহসী তাঁর কন্যা। আমার স্পষ্ট মনে আছে ২০০৪ সালের একুশে আগষ্টের পরের দিনগুলোর কথা। গ্রেনেড মেরে তাঁকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল মানবতার শত্রুরা। কতো প্রাণ সেদিন হয়েছিল বলিদান। নিজের নিরাপত্তা কর্মী মাহবুবের চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চলে যেতে দেখেছেন। দেখেছেন প্রিয় নেত্রী আইভী রহমানসহ কতো নেতা-কর্মীর আত্মদান। নেতারা মানব ঢাল তৈরি করে তাঁকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। নিজেও আহত হয়েছেন। এখনও শত শত দলীয় কর্মী ও নেতা গায়ে গ্রেনেডের টুকরো নিয়ে কোনো মতে বেঁচে বর্তে আছে। কিন্তু তিনি দিক হারান নি। আবার ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়িয়েছেন। জেল খেটেছেন। কিন্তু মাথা নোয়ান নি। তিনি যে বঙ্গবন্ধুকন্যা। এটিই তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয়। এমন সংকট পাড়ি দিয়ে বন্দীশালায় বসে স্বপ্ন দেখেছেন সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের। গনতন্ত্রের মানসকন্যা তাই জাতিকে উপহার দিতে পেরেছিলেন ‘দিন বদলের সনদ’। সে সময়টায় খুব কাছে থেকে তাঁকে দেখেছি। মুখে নেই ক্লান্তি। নেই অন্যায় ভাবে তাঁকে জেলে আটকে রাখার কোনো খেদ। দেখেছি শুধু স্বপ্নভরা এক মুখ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে সোনার বাংলায় পৌঁছে যাবার অনাবিল আকুতি। জনগন দুহাত তুলে প্রার্থনা করেছেন তাঁর জন্য। ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনগন বিপুল ভোটে তাঁকে এবং তাঁর দলের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এরপর আর তাঁকে পেছনে তাকাতে হয়নি। দিন বদলের সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তিনি নিঃশঙ্ক চিত্তে। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও মানবতার বিরোধী অপরাধীদের প্রচলিত আদালতেই বিচার সাপেক্ষে শাস্তি কার্যকর করে চলেছেন একের পর এক। জঙ্গী দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বঙ্গবন্ধুকন্যা সমাজ ও প্রশাসনকে উজ্জীবিত করে সমাজে শান্তি নিশ্চিত করেছেন। বিগত এক দশকেরও বেশি সময়ে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দারুণ গতিময় করেছেন। এশিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে বাড়ন্ত দেশটির নাম বাংলাদেশ। এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নিয়মিত বেড়ে বেড়ে করোনার আগ দিয়ে ৮ শতাংশের ওপরে উঠে গিয়েছিল। ভোগ বেড়েছিল চার গুন। বিনিয়োগ তিন গুনের বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বেড়েছে ছয় গুন। মূল্যস্ফীতি এখনও স্থিতিশীল। দারিদ্র্য কমে ২০ শতাংশের আশে পাশে নেমে এসেছিল। জীবনের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭৩ বছর।

কিন্তু হঠাৎ করে করোনা সংকটের মুখে পড়ে যায় বাংলাদেশ ও সারা বিশ্ব। এপ্রিল থেকে মাস তিনেক খুবই সংকটে ছিল বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা স্পষ্টতই ভেসে ওঠে। অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষগুলো আয় রোজগার হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতেও দারুণ পারদর্শিতা দেখিয়ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। স্বাস্থ্য খাতের হজবরল অবস্থা অনেকটাই বাগে আনতে সক্ষম হয়েছে তাঁর সরকার। তবে করোনায় এখনও প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। সংক্রমণের হার আগের চেয়ে কমেছে। বাঁচার তাগিদেই মানুষ ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছে। আর বিপুল অংকের প্রণোদনা দিয়ে তাঁর সরকার অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন। এডিবির মতে এ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৮ শতাংশ। শেষমেষ হয়তো তা আরও বেশি হবে। সরকারের প্রক্ষেপিত ৮.২ শতাংশ হলেও অবাক হবো না। কৃষি ,শিল্প ও সেবা একযোগে ভালো পারফর্ম করছে। প্রণোদনাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অর্থনীতি যে খাড়াখাড়ি তরতর করে উঠে যাবে এই লক্ষ্যরে দিকে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। রপ্তানি বাড়ছে। প্রবাস আয় বাড়ছে। আমদানি ততোটা বাড়ছে না। লেনদেনের ভারসাম্য ইতিবাচক। মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিদিন দুই হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। কৃষি ভালো করছে। গ্রামীণ চাহিদা চাঙ্গা বলে পুরো অর্থনীতি গতিময় হচ্ছে। মাস তিনেকের মধ্যে করোনার সঠিক টিকা পেয়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে সক্ষম হবে।

আর তা সম্ভব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যার বলিষ্ঠ এবং সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বের গুনে। করোনা নামের অন্ধকার সময়টিও ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাই এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে এসেছে এবারের ২৮ সেপ্টেম্বর। জয়তু শেখ হসিনা। সৈয়দ হকের কবিতার লাইন উল্লেখ করেই শেষ করছি তিমির হননের নেত্রীর জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

“সকলেই জন্ম নেয়- কেউ কেউ জন্মলাভ করে;
অনন্য অর্জন তার।”

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত