টেকসই বন্যা ব্যবস্থাপনা

3559

Published on অক্টোবর 5, 2020
  • Details Image

প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সবুর:

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, দেশের ভূমিবৃত্তি ও আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছরই ছোট বড় বন্যায় আক্রান্ত হয়। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সময় সময়ে বন্যার মাত্রা ও স্থায়িত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। তবে বন্যা বাংলাদেশের মানুষের জীবন-যাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বন্যার সঙ্গে বসবাস করে এবং সাহসিকতার সঙ্গে বন্যা মোকাবেলা করার সংস্কৃতি আমাদের দীর্ঘদিনের। প্রতিবছর যে সাধারণ বন্য হয়, তা বাংলাদেশের প্লাবন ভূমির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই বন্যার পানি যে পলিমাটি বয়ে আনে, তা আমাদের কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালের ভয়াবহ বন্যার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধিদলের পরিচালিত সমীক্ষার (ক্রুগ মিশন) সুপারিশ ক্রমে পানি সম্পদ, বিদ্যুতের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে তৎকালীন ইপিওয়াপদা সৃষ্টি ছাড়া বন্যা ব্যবস্থাপনা নিয়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পানিসম্পদের সৃষ্ট ব্যবস্থাপনা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট অর্ডার নং-৫৯ এ তদানীন্তন ইপিওয়াপদা ‘পানি উইং’ নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠন করেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। ১৯৭২ সালে সংঘটিত বন্যার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্যাদুর্গত এলাকা, কৃষি ও কৃষক শ্রেণীর ক্ষয়ক্ষতি নিজে পরিদর্শন করেন। তিনি তৎকালীন কৃষি ও সেচ মন্ত্রণালয় (বর্তমান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়) এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাঠামোগত (বাঁধ নির্মাণ) ও অ-কাঠামোগত উভয় বিষয় যেমন আলোকপাত করেন, একইভাবে পাশর্বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অববাহিকা ভিত্তিক বন্যা ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ সময় তিনি তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদী একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির একটি ধারা ছিল উপমহাদেশের সহযোগিতায় অববাহিকা ভিত্তিক বন্যা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বন্যা দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম করে গড়ে তোলা।

১৯৭৫ পরবর্তী সময় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা তেমন গতি পায়নি। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর জাতির জনকের সেই পদক্ষেপ ও নির্দেশনাগুলোকে বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প ও গঙ্গার পানি ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষর। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিকাজের প্রবৃদ্ধি ও সমুদ্রের জোয়ারের লবণাক্ত পানিকে প্রশমিত করে মিঠা পানির জোগান দেয়া থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমের উভয় সময়ে আবাদ করা সম্ভব হয়েছে। মৌসুমের পানি প্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমন-বোরো ধান, সেই সঙ্গে গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের কারণে বিদেশে রফতানির মাধ্যমে অর্জন করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।

পরবর্তীতে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও টেকসই উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি হলেও ২০০৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ সর্বোপরি টেকসই উন্নয়নের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। টেকসই উন্নয়ন ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য বর্তমান সরকারের ঘোষিত বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডও ভবিষ্যত প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর আওতায় ইতোমধ্যে ৬৪ জেলায় খাল খনন কর্মসূচী চলমান আছে।

প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি এবং নির্দেশনা মোতাবেক গৃহীত প্রকল্প সংখ্যা হলো ৮৯টি। যার মধ্যে রয়েছে নদীভাঙ্গন প্রতিরোধকল্পে প্রকল্প, বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, উপকূলবর্তী এলাকা রক্ষা প্রকল্প, ড্রেজিং প্রকল্প ও সেচ প্রকল্প। এর মধ্যে ৫০টি প্রকল্প ইতোমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে, ১৪টি প্রকল্প চলমান রয়েছে এবং ১২টি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সামগ্রিকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলের ১২ বছরে কৃষি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রচুর সময়োপযোগী প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ও বাস্তবায়ন চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বাংলাদেশে বন্যা দুর্যোগ অনেকটাই লাঘব হয়েছে এবং সমন্বিতভাবে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের ফলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। সেই সঙ্গে উন্নত হয়েছে মানুষের জীবন যাত্রার মান।

চলতি বছর বন্যায় ৩৩টি জেলা বন্যা আক্রান্ত হয় এবং দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০ লক্ষাধিক মানুষ। কারিগরি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, চলতি বছরের বন্যা ব্যাপকতার দিক থেকে ১৯৮৮ সালের বন্যাকে অতিক্রম করেছে, যদিও ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল আরও ব্যাপক। তবে ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় অতীতের বন্যাগুলো ছিল অনেক বেশি ভয়াবহ। চলতি বছরে বন্যায় প্রায় পঞ্চাশ লক্ষাধিক লোক আক্রান্ত হয়, যেখানে ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা তিন কোটিরও বেশি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৯৮৮ সালে প্রায় ১.২ বিলিয়ন টঝউ এবং ১৯৯৮ সালে প্রাড ২.৮ বিলিয়ন টঝউ। চলতি বছরে বন্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৬,২৬১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৪৮৭টি স্থানে মাত্র ২৮৩.৩৯৮ কি.মি. বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা মোট বেড়িবাঁধের ১.৭৪ শতাংশ। বিগত বন্যাগুলো থেকে অধিক তীব্র ও স্থায়ী হওয়ার পরেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক কম। ক্ষতিগ্রস্ত ২৮৩.৩৯৮ কি.মি. বাঁধ মেরামতের জন্য দ্রুততম সময়ে ৬২৬টি প্যাকেজে কাজ শুরু হয়। সামগ্রিকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে আগাম আবহাওয়া ও বন্যা পূর্বাভাস, সমন্বিতভাবে সরকারের যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ এবং বিগত এক দশকে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সময়োপযোগী প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।

বন্যা ব্যবস্থাপনা মূলত দুই প্রকারের যথা- কাঠামোগত বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং অ-কাঠামোগত বন্যা ব্যবস্থাপনা। কাঠামোগত কার্যাবলীর মধ্যে রয়েছে নদীর অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন, বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, ব্যারেজ, বাঁধ, রেগুলেটর নির্মাণ, জলপথ, খাল-বিল ইত্যাদি পুনঃখনন, ভূমি সংরক্ষণসহ ভূমি পরিবৃদ্ধি ও পুনরুদ্ধার, নদীর মোহনা নিয়ন্ত্রণ, নদী তীর সংরক্ষণ ও নদীভাঙ্গন হতে জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ সংরক্ষণ, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ, লবণাক্ততা রোধ ও প্রশমনসহ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যাবতীয় অবকাঠামোগত কার্যক্রম। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে এ পর্যন্ত মোট ১২,৮৬৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব প্রকল্পের আওতায় অন্যান্য অবকাঠামোর পাশাপাশি ৫৭৫৭ কিমোমিটার উপকূলীয় বাঁধ, ১৬২৬১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ২৫৯৪ কিলোমিটার হাওড়ে ডুবন্ত বাঁধ রয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর নাব্য রক্ষার নিমিত্তে ১৩৮৮ কিলোমিটার ড্রেজিং ও খনন, ১২২৯ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ, ৬৪.৯৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন সুবিধা প্রদান ও ১২৯টি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১৬.২৪ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। নদী তীর সংরক্ষণমূলক কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুর, ভোলা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নরসিংদী, নওগাঁসহ মোট ৩১টি জেলা শহর ৭০টি উপজেলা শহর ও ৫০০ এর অধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদীভাঙ্গন হতে রক্ষা পেয়েছে।

বন্যা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত বাপাউবোর অ-কাঠামোগত কার্যাবলীগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ, পানি বিজ্ঞান সম্পর্কিত অনুসন্ধান কার্যপরিচালনা, তথ্য-উপাত্ত গ্রহণও সংরক্ষণ-বিতরণ এবং বন্যাবিষয়ক কার্যাবলীর ওপর মৌলিক গবেষণা। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এর ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ২৯টি নদ-নদীর ৫৪টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক ৫ দিনের স্বল্পমেয়াদী আগাম বন্যা পূর্বাভাস ও ৩৮টি পয়েন্টে ১০ দিনের মধ্যমেয়াদী পূর্বাভাস প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। সাম্প্রতি গুরত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ১৫ দিনের পানি প্রবাহ পূর্বাভাসও প্রদান করা হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (FFWC) বন্যাবিষয়ক জাতীয় ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে নিয়োজিত। বন্যা পূর্বাভাস ফ্যাক্স, ইমেইল ও IVR, Apps ইত্যাদি প্রচার ব্যবস্থার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, প্রচার মাধ্যম, NGO, উন্নয়ন সহযোগী, স্থানীয় প্রশাসন, জেলা-উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি ইত্যাদি পর্যায়ে নিয়মিত বিতরণ ও প্রেরণ করা হয়। বন্যা পূর্বাভাস বার্তা তৃণমূল পর্যায় সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ২০১১ সালে IVR বা Interactive voice Recording চালু করা হয়। এই সেবা ব্যবহারের করে যে কোন মোবাইল ফোন ও অপারেটর থেকে ১০৯০ তে ডায়াল করে দুর্যোগ সংক্রান্ত তথ্যাবলী ও ৫-এ গিয়ে বন্যা সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য ও পূর্বাভাস শোনা যায়। সকল স্তরের জনগণের সহজলভ্যতার জন্য প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে এই IVR সেবা টোল ফ্রি করে দেন।

বন্যার সঙ্গে বসবাস করে এবং সাহসিকতার সঙ্গে বন্যা মোকাবেলা করার সংস্কৃতি আমাদের দীর্ঘ দিনের। প্রতি বছর যে সাধারণ বন্যা হয় সেটি বাংলাদেশের প্লাবন ভূমির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই বন্যার পানি যে পলিমাটি বয়ে আনে, তা কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তদুপরি বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার তীব্রতা ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনজীবনে দুর্ভোগের কারণ হিসাবে দেখা দিচ্ছে এবং দেশের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে বন্যা দুর্যোগ আরও লাঘবের জন্য সরকার অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। এখন বাস্তবায়িত প্রকল্প বাঁধের ভেতরে আর বন্যার প্রকোপ পরিলক্ষিত হয় না। ভবিষ্যতে বন্যা দুর্যোগ লাঘবের জন্য যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বন্যা ব্যবস্থাপনার উন্নতিকরণ, ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ, কাঠামোগত উন্নতিসাধন ও বন্যা পূর্বাভাসের অধিকতর সঠিকতা ও আধুনিকায়ন।

দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক মানুষ প্লাবন ভূমিতে বসবাস করছে। নদীতীরবর্তী প্লাবন ভূমি ও চরাঞ্চল যা কেবল কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত, সেখানেও বসবাস করে অসংখ্য মানুষ। এ কারণে তারা প্রতি বছরই থাকছেন বন্যা ঝুঁকিতে। প্লাবন ভূমি ও চরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজনের যথাযথ পুনর্বাসন বন্যার ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে দিতে পারে। সামাজিক অভিযোজনের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার চিন্তা করা যেতে পারে। জনগণ যাতে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে, সে লক্ষ্যে বন্যার পানির উচ্চতা বৃদ্ধির যথেষ্ট আগে জনগণের কাছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ-এর যথাযথ তথ্য পৌঁছনো। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়েও উদ্যোগ প্রয়োজন। ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন ও বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগ, শস্য উৎপাদন বহুমুখীকরণ তথা বন্যা প্রতিরোধী বা বন্যা সহনক্ষম শস্য চিহ্নিতকরণ ও রোপণ করা এবং শস্য রোপণ মৌসুমের অভিযোজন। প্লাবন ভূমিসমূহকে বিভিন্ন জোনে বিভক্ত করা এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরি করা। পদ্মা-মেঘনা-যমুনাসহ ছোট বড় ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। সুতরাং এসব নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা অতি গুরুত্বপূর্ণ। বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির কারণে দেশে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কৃষিজমি বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে কোন কোন বছর ক্ষরাজনিত কারণে সেচকাজে পানির অভাব কৃষিকার্যে বিরাট বাধা সৃষ্টি করে। সুতরাং আনঃদেশীয় নদীসমূহের পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে তিস্তাসহ কয়েকটি নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নদ-নদীর তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে অববাহিকাভিত্তিক বন্যা ব্যবস্থাপনা ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনসহ একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে টেকসইভাবে সমুন্নত রাখতে কৃষি পানি ও পরিবেশ খাতকে সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও ভিশন বাস্তবায়নের জন্য সরকার ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করেছে। কেবল কিছু নদী বা একটি অববাহিকা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্যার ঝুঁকি কমানো সম্ভব নয়। সকল অববাহিকা ও ছোট-বড় সকল নদী থেকে শুরু করে উপনদী, শাখানদী এমনকি খাল ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে শতবর্ষের ডেল্টা প্ল্যান-২১০০। দীর্ঘমেয়াদী ডেল্টা প্ল্যানের সফল বাস্তবায়ন এবং ভৌগোলিক বাস্তবতায় সময়োপযোগী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা বৈশ্বিক উষ্ণতাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দুর্যোগের ভোগান্তি সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে।

লেখক: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি)

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকন্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত