শেখ রাসেলঃ একটি ফুলের মতো শিশু

21692

Published on জানুয়ারি 19, 2021
  • Details Image

বেবী মওদুদ:

বঙ্গবন্ধু-পরিবারের ছোট্ট ছেলে শেখ রাসেলের জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯৬৪ সালে, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে। শেখ রেহানার জন্মের ৮ বছর পর তাঁর জন্ম হয় – আনন্দে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল সেদিন সারা বাড়ি।

বড় ভাইবোনরা যেন একটা সোনার পুতুল পেয়েছে। সবার কৌতূহল-আনন্দ ও উষ্ণতায় শেখ রাসেল সেদিন বড় বড় দু চোখ মেলে তাকিয়েছিল, ছোট্ট ছোট্ট মুষ্টিবদ্ধ হাত ও পা ছুড়েছিল আনন্দে, মুখভরা ছিল ফুলের মতো হাসি। পিতা শেখ মুজিব রাসেলকে মমতার চুমু খেয়ে অভিষিক্ত করলেন তাঁর বিশাল বক্ষে, তারপর উচ্চারণ করলেন – ‘ওর নাম হবে শেখ রাসেল।’

দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রিয়। ওই সময় রাসেলের একটি গ্রন্থ ছিল তাঁর কারাগারের প্রিয় সঙ্গী। আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে এবং রাজনৈতিক নেতাদের জেলখানায় বন্দি করে। রাজবন্দি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, মামলা, জেল মুক্তি, আবারো গ্রেপ্তার একের পর এক চলছিল।

১৯৬২ সালে কারামুক্তির পর তিনি সংগঠনকে শক্তিশালী করার পক্ষে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করছিলেন খুব ধীরস্থিরভাবে। ওই সময় আইয়ুব খান শাসনতন্ত্র ঘোষণা করে এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ছাড় দেয়।

১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে সম্মিলিত বিরোধীদলীয় প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী আইয়ুববিরোধী প্রচারণা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বাসায় এসে বিশ্রাম নেয়ার সময় পেতেন না। শেখ রাসেলের জন্ম হয়েছিল এমনি এক দিনে।

শেখ রাসেলের বয়স যখন দুবছরও হয়নি বঙ্গবন্ধুকে আবারো রাজবন্দির জীবন যাপন করতে হয়। পিতার সান্নিধ্য, স্নেহ-মমতায় বড় হয়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। একমাত্র মা ছিলেন তার সব আদর-আবদার, ভালোবাসা-মমতার আধার, আর ভাইবোনদের ছিল চোখের মণি। কারাবন্দি পিতার জীবনযাপন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বাড়ির সবার ব্যস্ততার মাঝেও রাসেল একাকী বড় হয়ে উঠছিল। তার প্রিয় সঙ্গী ছিল সাইকেল, কবুতর ইত্যাদি।

১৯৬৯-এ বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে এসে কোলে তুলে নেন তাঁর চার বছরের পুত্র শেখ রাসেলকে। রাসেল এই প্রথম পিতাকে তার ইচ্ছামত কাছে পেল।

এল সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ঘোষণা। রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানের শাহীওয়াল কারাগারে আটক করে গোপন বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বাংলাদেশ তখন মুক্তিযুদ্ধে পাগলপারা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলাযুদ্ধের কৌশলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নাস্তানাবুদ হচ্ছে। ওই সময় রাসেল মা ও বোনদের সঙ্গে বন্দি হয়ে ছিল ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে। বড় দু ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। রাসেল মা-বোনদের সঙ্গে নিঃসঙ্গ হয়ে ঘরের ভিতর বন্দি জীবন কাটিয়েছে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরও তারা বন্দি ছিল। বাইরে তখন বিজয়-উৎসব চলছে। ১৭ ডিসেম্বর তারা বন্দিমুক্ত হলে রাসেল ‘জয় বাংলা’ বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এলে সেদিন রাসেল পিতাকে বিস্ময়ভরা দুচোখে দেখেছে, তাঁর স্নেহচুম্বনে সিক্ত হয়েছে। এরপর থেকে সে খুব একটা পিতার সান্নিধ্য ছাড়া থাকতে চাইত না। যতক্ষণ পিতা কাছে থাকতেন, ততক্ষণ সে তাঁর কাছাকাছি থাকতে চাইত।

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। ১০ বছরের রাসেল ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। চঞ্চল প্রকৃতির হলেও কখনো কখনো হঠাৎ সে শান্ত হয়ে নির্জনে প্রিয়সঙ্গী সাইকেল নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করত। তার আরো প্রিয় সঙ্গী ছিল ভাগ্নে জয়। তার সঙ্গে খুনসুটিও করত, আবার জয় না হলে তার চকোলেট খাওয়া হত না, খেলা করা হত না। আনন্দকে ভাগ করে নেয়ার উদারতায় রাসেল তার ক্লাসের বন্ধুদের খুব প্রিয় ছিল। সেই রাসেলের ঘুম ভেঙ্গে যায় সেদিন গুলির শব্দে, হইচইতে। মা তাকে পেছনের দরজা দিয়ে কাজের লোকজনের হাতে নিচে পাঠিয়ে দেন।

১০ বছরের রাসেল হঠাৎ ঘুমভাঙ্গা চোখ নিয়ে সব দেখেছে, আর আতঙ্কভরা মন নিয়ে সবকটা গুলির শব্দ শুনেছে। তারপর ঘাতকরা তার হাত ধরে, অস্ত্র তাক করে। রাসেল কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, ‘আমি মায়ের কাছে যাব। আমি মায়ের কাছে যাব।’

ঘাতক ওয়্যারলেসে অনুমতি নিয়েছে তাকে হত্যা করার। শেখ রাসেল বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র – এই ছিল তার অপরাধ। ঘাতকরা তার হাত ধরে বড়ভাই শেখ কামাল, চাচা শেখ আবু নাসের, স্নেহময় পিতা শেখ মুজিব, মমতাময়ী মা, ভাই শেখ জামাল, সদ্যপরিণীতা ভাবী সুলতানা ও রোজী – সবার রক্তাক্ত দেহ দেখাল। রাসেল কেমন করে দেখেছিল সেই প্রাণহীন প্রিয়জনদের? সেই রক্তভেজা মেঝেতে হাঁটতে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল কি হাহাকারে? রাসেলকে ঘাতকরা কেন এই রক্তাক্ত দেহগুলো দেখিয়েছিল? তার শুদ্ধতম ছোট্ট হৃদয়কে তারা কেন কষ্ট দিয়েছিল? কেন যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত করেছিল? ছোট্ট রাসেল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁতে কাঁদতে শেষবার উচ্চারণ করেছিল, ‘আমাকে আমার হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন!’

ঘাতক–নরপিশাচ ঘাতকরা ছোট্ট রাসেলের সে কান্নাভেজা কথা শোনেনি, হৃদয়ের আকুতি শোনেনি। তারা বুলেটে বুলেটে শিশু রাসেলকে হত্যা করেছে। ছোট্ট রাসেল কাঁদতে কাঁদতে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছে।

আমরা রাসেল হত্যার বিচার চাই। আমরা শিশু রাসেল হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড চাই। একটি ফুলের মতো শিশুকে যারা বাঁচতে দেয়নি তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। অপরাধীকে করুণা করা পাপ। আমরা বাংলাদেশকে পাপ ও পাপীদের হাত থেকে মুক্ত করতে চাই যেন আগামী দিনের শিশুরা উজ্জ্বল আনন্দ স্বাস্থ্য শিক্ষা পরমায়ু নিয়ে গড়ে ওঠে। এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমরা।

সূত্রঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার- বেবী মওদুদ, পৃষ্ঠা নং- ২৩-২৫

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত