করোনার ভ্যাকসিন : স্বপ্ন নয় বাস্তব

1916

Published on জানুয়ারি 21, 2021
  • Details Image
ড. প্রণব কুমার পান্ডেঃ
 
সমগ্র বিশ্বের মতো, কোভিড -১৯ মহামারির বিপর্যয়মূলক প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকার এই শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ সময় অতিবাহিত করছে। ইতিহাসের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জপূর্ণ সময়ে যখন নাগরিক এবং সরকার একে অপরকে সাহায্য করবে মহামারির ধ্বংসাত্মক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে, ঠিক তখনই দেশের একটি কুচক্রী মহল গুজব ছড়িয়ে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সফলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে।

মহামারি শুরুর পর থেকেই এই কুচক্রী মহল এবং তাদের রাজনৈতিক গুরুরা সামাজিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করা যাতে তারা রাস্তায় নেমে এসে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে। মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে কোভিড -১৯ মহামারির অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের অক্ষমতা সম্পর্কিত অসংখ্য মিথ্যা গল্প এই মহল প্রচার করেছে। তবে, শেখ হাসিনার বিশ্বাসযোগ্য ও যোগ্য নেতৃত্বের কারণে দেশে প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার সফল হয়েছে। ফলে, তারা নাগরিকদের সরকারের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করতে সফল হয় নি। সুতরাং, আমাদের দেশ কোভিড -১৯ মহামারির প্রথম পর্যায়ে ততটা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়নি।

সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিপর্যয় কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে শুরু করলেও এই গোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা সম্পর্কে বিভিন্ন কাল্পনিক তথ্য ছড়িয়ে দেয়। এটা ঠিক যে স্বাস্থ্য বিভাগ মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কিছুটা হিমশিম খেয়েছে। মহামারীটির প্রভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় তাদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ছিল। এর অর্থ এই নয় যে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল।

মহামারির প্রথম পর্যায়ে সরকার নাগরিকদের বিনামূল্যে কোভিড-১৯ শনাক্তের সেবা প্রদান করেছে। পরবর্তীতে, তারা এই পরীক্ষার উপর খুব নামমাত্র ফি আদায় করে যেটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর সক্ষমতার মধ্যেই ছিল। এই গোষ্ঠী মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির (পিপিই, ফেসমাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য অন্যান্য সরঞ্জামা) অপ্রতুলতা সম্পর্কে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েছে। তবে, মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে এবং গুজব ছড়িয়ে সরকারকে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলার তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি।

মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘোষিত সরকারি ছুটির সময় অভাবী মানুষদের সহায়তা করার জন্য সরকার যখন কঠোর পরিশ্রম করেছিল, তখন এই মহল সেবা প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কিত গুজব ছড়ায়। সেবা প্রক্রিয়ায় কিছু অনিয়মের ঘটনা হয়তো ঘটেছে; এর অর্থ এই নয় যে সরকার দরিদ্র জনসাধারণকে পরিষেবা প্রদান করতে পারেনি। দরিদ্র জনগণের নিকট সরাসরি নগদ অর্থ সাহায্য প্রদানসহ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছে।

এমনকি, সরকার যখন অফিস-আদালত, পোশাক কারখানা, পরিবহন এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তারা বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েছে। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার জন্য সরকার যখন ১,২০,০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু করে তখনও এই মহল বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ায়। সবচেয়ে ইতিহাচক দিক হ'ল বাংলাদেশের মানুষ এই গুজবে কান না দিয়ে সরকারের উপর আস্থা রেখেছে।

সরকার যখন সফলভাবে মহামারির প্রথম পর্যায় মোকাবেলা করতে সক্ষম হল তখন তারা যথাসময়ে ভ্যাকসিন কিনতে সরকারের অক্ষমতা সম্পর্কে গুজব ছড়াতে শুরু করে। তবে, তাদের প্রচেষ্টা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেনি কারণ সরকার অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এমনকি, তারা এমন গুজবও প্রচার করতে থাকে যে সরকার সময় মতো এই ভ্যাকসিন দেশে আনতে পারবে না । তবে, সরকার যখন বিনামূল্যে নাগরিকদের টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন তারা আবার দমতে শুরু করে।

যাই হোক, ভারত সরকার যখন নিজেদের চাহিদা মেটানোর আগে বিদেশে ভ্যাকসিন রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন তারা আবার জল্পনা কল্পনা শুরু করে। শীঘ্রই তারা বিষয়টি নিয়ে গুজব প্রচার করা শুরু করে এই বলে যে ভারত যতই আমাদের বন্ধু হোক না কেন তারা নিজেদের জনগণদের টিকা দেওয়া শেষ না করে আমাদের একটিও টিকা প্রেরণ করবে না। এমনকি, মূলধারার মিডিয়ার কেউ কেউ এই মহলের সাথে মিলে একই ধরনের গুজব প্রচার শুরু করে।

যাই হোক, তারা আবার হতাশ হয়ে পড়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব এবং সিরাম ইনস্টিটিউটের নির্বাহীর বিবৃতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে যেখানে তারা সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করে যে চুক্তির বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ তাদের ভ্যাকসিন পাবে। সেই অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিশ্চিত করেছে যে তারা ২৫ জানুয়ারির মধ্যে ভ্যাকসিনের প্রথম চালান পাবে। এর মধ্যে ভারত সরকার বাংলাদেশের মানুষের জন্য ২০ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানালে এই মহল আরও বিপদে পড়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে, সরকার জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তুতি নিয়েছে। সুতরাং, কোভিড -১৯ এর ভ্যাকসিন আজ আমাদের জন্য কোন স্বপ্ন নয়, বরং বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটি একটি বাস্তবতা।

গুজব-ছড়ানো মহলের সাথে সাথে, একটি মূলধারার গণমাধ্যম দেশবাসীকে টিকা দেওয়ার রেজিস্ট্রেশনের জন্য ব্যবহার যোগ্য একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরির ব্যয় নিয়ে একটি মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি সত্য যে এই পত্রিকাটি এমন একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে যার কোনও ভিত্তি নেই। দেশবাসী প্রত্যাশা করে না যে এই জাতীয় বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ কোনও নামী পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। গুজব- ছড়ানো মহল এবং কয়েকটি গণমাধ্যমের পাশাপাশি, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে সুনাম নষ্ট করার জন্য বিভিন্ন মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রচার করতে ব্যস্ত রয়েছে। তবে স্বস্তির বিষয় হল এরা দেশের বেশীরভাগ জনগণকে প্রভাবিত করে পারে নি।

এটি দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশ যখন শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহতম সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন একদল কুচক্রী মহল এবং তাদের রাজনৈতিক কর্তারা বিভিন্ন গুজব প্রচারের মাধ্যমে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করে ঘোলা জলে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে। আমরা যথেষ্ট ভাগ্যবান যে শেখ হাসিনা তার পরিপক্ক নেতৃত্বের সাথে এই বিষয়গুলো পরিচালনা করছেন।

শেখ হাসিনা কোভিড-১৯-এর স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সঙ্কটের সাথে যেমন সফলভাবে লড়াই করেছেন, তেমনি অর্থনীতির গতি সচল রেখেছেন। তাই আমি দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান করতে চাই তারা যেন এই গুজবে কান না দিয়ে শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ মহামারি থেকে দেশকে বাঁচাতে সরকারের প্রতি আস্থা রাখেন।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত