যারে দেখতে নারি...

1544

Published on ফেব্রুয়ারি 2, 2021
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

কথায় বলে যারে দেখনে নারি তার চরণ বাঁকা। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টেপাধ্যায় ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে অপরূপ সুন্দরী বলে যার বন্দনা করা হচ্ছিল, যেই-না একজনে একটু খুঁত বের করল- কিছুক্ষণেই পরিণত হলো কুৎসিত-কুরূপায়। ভারত করোনার টিকা দিতে পারবে না, এমন দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একটি মহলের। কেউ বা বলছিল এ টিকার মান আদৌ বিশ্বমানের নয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ভারত থেকে ‘ওজিএল বা ওপেন জেনারেল লাইসেন্সের’ অধীনে শাড়ি-লুঙ্গি আমদানি করা হয়েছিল। এর একটি অংশ ছিল নিম্নমানের, যা  মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু সময় বদলালেও অনেকের মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটে নাই। সেই সত্তরের দশকের শুরুতে বিশ্বের প্রধান দুই জনবহুল দেশ চীন ও ভারত এখনকার মতো অর্থনৈতিক শক্তি ছিল না। বাংলাদেশ দুটি দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রেখে চলেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে ভারতের তুলনায় চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ছে এবং এটা একতরফা। বলা যায়, পুরোটাই চীনের অনুকূলে। ২০১০ অর্থ বছরে বাংলাদেশ চীন থেকে আমদানি করেছে ৬৭৯ কোটি ডলারের পণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৩৩ কোটি ডলারে। অন্যদিকে, ভারত থেকে আমদানি ছিল- ২০০৯-১০ অর্থ বছরে ৩০১ কোটি ডলার থেকে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৮২৪ কোটি ডলার। চীন থেকে আমদানি ভারতের প্রায় দ্বিগুণ!

বাংলাদেশ ২০১৪ সালে অর্থ বছরে চীনে রফতানি করেছে ৭৯ কোটি ডলারের পণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরেও তা প্রায় কাছাকাছি- ৮৩ কোটি ডলার। এই সময়ে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি ৫২ কোটি ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২৫ কোটি ডলার।

ভারত ও চীন, উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রকট- আমদানি বেশি, রফতানি অনেক কম। কিন্তু চীনের সুবিধা হচ্ছে- বালাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য বিপুলভাবে তাদের অনুকুলে হলেও সেটা নিয়ে একাডেমিক আলোচনা তেমন হয় না, যতটা উচ্চবাচ্য ভারতের প্রসঙ্গ নিয়ে। করোনার শুরুতে চীনের রফতানি বাণিজ্য যখন বিঘ্নিত হতে থাকে, আমাদের  পোশাক শিল্পের মালিকরা কাপড়ের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজতে থাকেন। ভারত থেকে আমদানি বাড়ানোর প্রস্তাবও আলোচনায় আসে। ১২ ফেব্রুয়ারি (২০২০) নিউ এজ পত্রিকা খবর দেয়- ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘করোনার কারণে বাংলাদেশে চীন থেকে কাঁচামাল সরবরাহের কথা উঠছে। এর প্রয়োজন আছে কি? উত্তরে আমি বলব- না। আর চীন থেকে কাঁচামাল সরবরাহ অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করা হলে সেটা হবে স্টুপিড ডিসিসন।’

স্বাধীনতা পরবর্তী পাঁচ দশকে বাংলাদেশ আর ‘বাস্কেট কেস’ নেই, যাকে নিয়ে উপহাস করা চলে। আমরা যে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি, সেটা বিশ্ববাসীরও নজরে পড়ছে। করোনাকালেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। শুরুর দিকে কিছুটা হতাশা ছিল। দুর্বৃত্ত-লোভী একটি মহল রাতারাতি লাখপতি-কোটিপতি হতে চেয়েছিল। তারা কেউ করোনা টেস্টের নামে, কেউ সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের নামে, কেউ বা ত্রাণ সামগ্রী আত্মসাৎ করে নিজের আখের গোছাতে চেয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাতেও সঙ্কট ছিল। সংক্রমণের ভয় ছিল ব্যাপক। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে এবং তা ইতিবাচক।

বাংলাদেশকে বাস্কেট কেস হিসেবে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার কিংবা বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদরা উপহাস করেনি, দেশের ভেতরেও একদল ছিল যারা বাস্কেট কেস-এর অর্থ তৈরি করে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। এই উপহাসের যোগ্য জবাব দিচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বে প্রথম যে স্বল্প সংখ্যক দেশের হাতে কনোনার টিকা রয়েছে, তার একটি বাংলাদেশ- এ অর্জন কারও দয়ার কারণে নয়। এখন চীনের একটি প্রতিষ্ঠান বলছে- তারা বাংলাদেশে টিকা তৈরির কারখানা খুলতে চায়। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে ভারত বা জার্মারি কিংবা ইংল্যান্ডের কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে উৎপাদন সুবিধা স্থাপন করতে এগিয়ে এলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।

করোনাকালেও পদ্মা সেতুর কাজ চালানো সম্ভব হয়েছে,  বোরো ও আমন চাল কৃষকের ঘরে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান করোনা নিয়ন্ত্রণে যে সব দেশ ভাল করেছে, তার তালিকায় ওপরের দিকে রেখেছে বাংলাদেশের নাম। করোনার মধ্যেই দুই কোটি শিশুকে পোলিও টিকা দেওয়া গেছে- এটা ইউনিসেফের নজর এড়ায় নাই। এটাও মনে রাখতে হবে যে করোনাকালেই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিদিন এক বা একাধিক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে হাজির থেকে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার দায় নিশ্চিত করছেন। ভারতে পার্লামেন্ট অধিবেশন হয় না, কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচল রেখেছে, প্রধানমন্ত্রী সেখানে হাজির থাকছেন। 

ভারতের ১২০ কোটি লোকের টিকার চাহিদা রয়েছে। চীনেও ব্যাপক চাহিদা। তবে দুটি দেশের অভ্যন্তরীণ চিত্র আমাদের কাছে সমভাবে স্পষ্ট নয়। ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। গণমাধ্যম সক্রিয় এবং সোশাল মিডিয়ার রয়েছে ধারালো দাঁত। চীনের চিত্র একেবারেই বিপরীত। সেখানে কী ঘটছে, বাইরের কারও জানার সুযোগ নাই। সরকার যা বলবে, সেটাই একমাত্র তথ্য। তারপরও টীনের একটি সুবিধা বাংলাদেশের মতো অনেক দেশে রয়েছে। চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে বসেই ‘স্টুপিড ডিসিশন’ উচ্চারণ করতে পারেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার যদি এমন কটূ মন্তব্য করতেন, নিশ্চিতভাবেই তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণার দাবি উঠত। হাইকমিশন অফিসের দিকে মিছিল নিয়ে দেখা যেত কোনো কোনো সংগঠনকে।

যাকে দেখতে নারি... প্রসঙ্গে ফিরে যাই। যারা ধরেই নিয়েছিলেন যে করোনার টিকা বাংলাদেশে আসবে না। রয়টার্স বার্তা সংস্থা যখন দায়িত্বজ্ঞানহীন খবর দিল- বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে অক্সফোর্ডের টিকা আপাতত রফতানি হবে না- মুহূর্ত দেরি করেনি এ মহল। তারপর ২০ লাখ টিকা এলো উপহার হিসেবে। আরও তিন কোটি টিকা পাইপলাইনে। এখন প্রচারের নতুন ইস্যু- এ টিকার মান ঠিক নাই। প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে টিকা নিয়ে প্রমাণ দিতে হবে যে এটা কার্যকর এবং কোনোভাবেই প্রাণঘাতী নয়। অথচ ভারত, ইংল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে এবং তেমন উদ্বেগজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর মিলছে না। আমরা আট-ভাইবোন শৈশবে স্মল পক্স ও যক্ষার যে টিকা নিয়েছি তার দাগ এখনও হাতে বহন করছি। কলেরার ইনজেকশন ছিল যন্ত্রণাদায়ক এবং তা নেওয়ার পর জ্বর হয়নি, এমন লোক পাওয়া যেত না। আমাদের একটি সুবিধা ভারতই করে দিয়েছে। দুই দেশের আবহাওয়া ও জীবনাচরণ মোটামুটি একরকম। সেখানে করোনার টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে আমরা জানতে পারব এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত কারেকটিভ মেজারস নেওয়া যাবে।

কারা প্রথমে টিকা পাবে, তার একটি রূপরেখা তৈরি হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মানছে বাংলাদেশ। যারা এই ভেকসিন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে তাদের এখন নতুন বাহানা- আগে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে এই টিকা নিতে হবে। আর সেটা করতে হবে টিভি ক্যামেরা ও মোবাইল ফোনে সরাসরি হাজির হয়ে। আমি নিশ্চিত যে যদি সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অগ্রাধিকারের বাইরে গিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের প্রথমে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিত, তারও প্রবল সমালোচনা হতো। বল হতো- আমজনতা নয়, নিজেরা লুটপাট করে টিকার দখল নিচ্ছে।

অনুরোধ থাকবে সংশ্লিষ্টদের প্রতি- নিজের অর্জনকে তুচ্ছ বা ছোট করবেন না। যে কোনো টিকা নিয়ে ভয় থাকে, উদ্বেগ থাকে। ইনজেকশন নেওয়ার ভয়ে ছুটে পালিয়েছে, এমন শিশু আছে ঘরে ঘরে। করোনার টিকা প্রথম পর্যায়ে বয়স্করা পাবে। তাদের অনেকের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। এখানেই চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব- জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। টিকাদান ব্যবস্থাপনা যেন সুষ্ঠু হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য  সংস্থা নির্ধারিত ছক যেন যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় এবং কোথাও যেন কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে করতে না সে দিকে যথাযথ দৃষ্টি কাম্য।

লেখকঃ সাংবাদিক ও গবেষক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত