জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় শেখ হাসিনার পদক্ষেপ

2227

Published on মে 9, 2021
  • Details Image

খন্দকার হাবীব আহসানঃ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্মুখী সমস্যার প্রতিরোধ এবং প্রতিকার নিরূপণ করে চলছেন। যে সমস্যাগুলো অধিকাংশই পরিবেশকেন্দ্রিক নয় বরং রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র উল্লেখযোগ্য। তবুও সামগ্রিক অগ্রগতি বিচারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে যেসব রাষ্ট্র বা সম্প্রদায় পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার প্রশ্নে উদাসীন এবং বেপরোয়া আচরণ করছে তারা চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে সমগ্র পৃথিবীই যেন অসহায়। বিষয়টি এমন যে উন্নত দেশগুলো চোখ কান বন্ধ করে আমাদের সঙ্গে এক টেবিলে আলোচনায় বসেছে কথা বলতে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো পরিবেশগত অবনতিতে ভীত কিনা সেটির সন্দেহ থাকলেও আমরা জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বা মানবসভ্যতা টিকে থাকার প্রশ্নে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার বিষয়ে শঙ্কিত। এই বিপর্যয়ের ফল হিসেবে আলোচনাটি বিলাসিতা বা স্বাচ্ছন্দ্যের নয়, বরং এটি মানুষের জীবন ধারণ বা টিকে থাকার প্রশ্ন।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার সর্বোচ্চ দায় উন্নত রাষ্ট্রগুলোর। ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকলে মাত্র কয়েকটি দেশকে ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ ঠেকানোর লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হলে সেই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি বাকিরাও লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ-২১ সম্মেলনে জলবায়ু চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হন বিশ্বনেতারা। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ২০০টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। প্যারিস চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো হলো; বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম করা। গাছ, মাটি ও সমুদ্র প্রাকৃতিকভাবে যতটা শোষণ করতে পারে, ২০৫০ থেকে ২১০০ সালের মধ্যে কৃত্রিমভাবে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ সেই পর্যায়ে নামিয়ে আনা। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ রোধে প্রত্যেকটি দেশের ভূমিকা পর্যালোচনা করা। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে জলবায়ু তহবিল থেকে সহায়তা করা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপজ্জনক জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে প্যারিস চুক্তিকে অবশ্যই কার্যকর করতে হবে। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে পুনরায় ফিরে ২০৩৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ খাতকে দূষণমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের ৪০ নেতাকে আগামী ২২ এবং ২৩ এপ্রিল ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নভেম্বর মাসে জাতিসংঘে জলবায়ু কনফারেন্স হওয়ার কথা থাকায় জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে বিশ্বকে আর্থিকভাবে লাভবান করা যায়, পরিবেশ ঠিক রাখা যায়, সেই আলোচনায় মিলিত হবেন বিশ্বনেতারা। বাইডেনের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি ঢাকা সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কনফারেন্সে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক 'ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম' সিভিএফের সভাপতি হওয়ার ফলে তার প্রতি প্রত্যাশা কেবল বাংলাদেশকেন্দ্রিক নয়, বরং সিভিএফ সদস্যভুক্ত ৪৮টি দেশের ১২০ কোটি জনগণের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বৈশ্বিক উষ্ফ্মতা হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ভবিষ্যৎ জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পৃথিবীর স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর নাগরিকদের আর্থসামাজিক মানোন্নয়ন ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে নেতৃত্ব দেওয়া শেখ হাসিনা উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ইতোপূর্বেও স্পষ্টত জানান দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির দায় উন্নত রাষ্ট্রগুলো এড়াতে পারে না। শেখ হাসিনা জলবায়ুবিষয়ক সর্বোচ্চ বিশ্ব ফোরাম জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ, ২০১৫-তে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা 'চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ' পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে জলবায়ু-সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের একটি ভার্চুয়াল গোলটেবিল আলোচনায় এক ভিডিও বার্তায় শেখ হাসিনা পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য পাঁচ দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রথম প্রস্তাব, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবী এবং নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবশ্যই জোরালো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা উৎসাহিত করার পরামর্শ দেব। দ্বিতীয় প্রস্তাব, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রস্তাব সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং সমস্ত প্যারিস প্রবিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। তৃতীয়ত প্রস্তাব, দুর্বল দেশগুলোকে প্রতিশ্রুত তহবিল সরবরাহ করতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাব, দূষণকারী দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রশমন ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের এনডিসি বাড়াতে হবে। পঞ্চম প্রস্তাব, জলবায়ু শরণার্থীদের পুনর্বাসন একটি বৈশ্বিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

প্যারিস চুক্তির পাঁচ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাসে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেন। জলবায়ু পরিবর্তন সংবেদনশীল ও অভিযোজন প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ ৫০০ কোটি ডলারের মধ্যে প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তন সংবেদনশীল প্রকল্পের জন্য ২০০ কোটি ডলার ও অভিযোজন ব্যবস্থার জন্য ৩০০ কোটি ডলার ব্যয় করছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশব্যাপী ১ কোটি ১৫ লাখ চারা রোপণ করা হয়েছে এবং সুরক্ষিত টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সম্পদের জোগান দিতে 'মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান' নামে একটি কর্মসূচিও চালু করা হয়েছে। প্রতিশ্রুতি ও অভিযোজন উচ্চাভিলাষ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়াতে, প্রশমন প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান বিদ্যুৎ, শিল্প ও পরিবহন খাতসহ কয়েকটি সম্ভাব্য খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনাও চূড়ান্ত।

'ডিপ্লোম্যাট' ম্যাগাজিনে এপ্রিল ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত 'ঢাকা-গ্লাসগো সিভিএফ-সিওপি২৬ সংহতি' শীর্ষক নিবন্ধে শেখ হাসিনা জলবায়ু অবিচার দূর করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে অর্থবহ করে তুলতে সবার প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, ক্রান্তিকালীন জলবায়ু সহযোগিতা জোরদার এবং ক্ষয়ক্ষতি ও জলবায়ুর অবিচার রোধের উপায় খুঁজে বের করতে আমরা উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক কার্বন বাজার দেখতে চাই। জলবায়ুর ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতি রোধের উপায় খুঁজতে গিয়ে, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো খুব কমই ভূমিকা রাখছে বলে উল্লেখ করেছেন। জলবায়ুর এই অবিচার দূর করার সময় এখনই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ না হলে এই যুদ্ধে আমরা হেরে যাব। মানুষ সচেতনভাবে আমাদের বেঁচে থাকার সহায়ক পরিবেশ ধ্বংস করছে।

আমরা গ্রেটা থুনবার্গ কিংবা বাংলাদেশ কোস্টাল ইয়ুথ অ্যাকশন হাবের লোকজনের জন্য কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি? আমরা জলবায়ু তহবিল উন্মুক্ত দেখতে চাই। আর তা কেবল কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর জন্য নয় বরং অঙ্গীকার করা ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড় এবং এর ৫০ শতাংশ জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা তৈরির জন্য ব্যয় করা হোক। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর ক্ষেত্রে প্রায়ই 'গ্রাউন্ড জিরো' হিসেবে উল্লেখিত হয়। এখানে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের কোটি কোটি সাহসী ও সহিষ্ণু জনগণের অস্তিত্বের লড়াই। যাদের বাড়িঘর, জমি ও শস্য প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক ক্রোধে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। প্রতি বছর জিডিপির ২ শতাংশ বিরূপ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় হয় যা শতাব্দী শেষে ৯ শতাংশে দাঁড়াবে। ২০৫০ সাল নাগাদ উপকূলীয় ১৭ শতাংশেরও বেশি এলাকা পানির নিচে তলিয়ে তিন কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যে ৬০ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ ছাড়া কপবাজারের পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল্য দিয়ে এই দেশ এখনও মিয়ানমার থেকে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয়দানের যে চাপ বহন করছে, এই ক্ষয়ক্ষতির মূল্য কে দেবে?

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির বিষয়ে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির প্রস্তাবক এবং বিপর্যয় কমাতে উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার ওপর চাপ প্রয়োগের মুখপাত্র এখন শেখ হাসিনা। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং কূটনৈতিক সফলতার অভিজ্ঞতা দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বনেতা হিসেবে শেখ হাসিনা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীসহ মানবজাতির অধিকার নিশ্চিত করতে সফল হলে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী পেতে পারি। আশা রাখছি, দ্বিতীয় মেয়াদে সিভিএফের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার পদক্ষেপগুলোর সুফল ভোগ করবে বিশ্ববাসী।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত