বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন

3105

Published on মে 9, 2021
  • Details Image

আমিনুর রহমান সুলতানঃ

বর্তমান বিশ্বে নারী পুরুষের জৈবিক পরিচয়ের বাইরে সামাজিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জেন্ডার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু তার আগে ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব বাংলার নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা পায়নি জৈবিক ভিত্তির কারণে, বিবেচনায় আনা হয়নি লিঙ্গ নিরপেক্ষতাকে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সংবিধান প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে ঢাকা আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে নারী বা মেয়েদের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য প্রদান করেন, সেখানে নারী পুরুষ সকলের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর এই ভাষণ থেকে নারীর অধিকার এবং তাদের কাজের প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন যা থেকে নারী সম্পর্কে তাঁর ভাবনা সুস্পষ্ট রূপে প্রতীয়মান হয়। আমরা জানি, ধর্ম ও সমাজ নারী পুরুষের জেন্ডারের লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি যে, বঙ্গবন্ধুকে ভাবিয়েছে এবং তা থেকে উত্তরণ যে স্বাধীন বাংলাদেশে সম্ভব তা ভাষণের বিশেষ অংশে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করছি, “অন্ধ সংস্কারে আমাদের জাতির একটা অর্ধেক অংশকে আমরা ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রেখেছিলাম। আপনারা ধর্মে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস রাখতে পারেন, এই স্বাধীনতায় বাংলাদেশের ভাই-বোনদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আছে।”

অবশ্য সমান অধিকার থাকলেই হবে না, এর জন্য মেয়েদের বা নারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে এবং নারীরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে এ ব্যাপারে তাঁর জীবন অভিজ্ঞতার বাস্তবতা থেকে উদাহরণ তুলে ধরেছেন। উদ্ধৃতি, “আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। ...এই বাংলাকে শোষণহীন সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ভাইয়েদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বোনদেরও এগিয়ে আসতে হবে সেই সংগ্রামের জন্য। জাতি গঠনের সংগ্রামে।...আমার ছোট বোনেরা, আমার মেয়েরা, আপনারা- আমি বিশ্বাস করি, কাজ করে যাবেন। ঘরের একটা আধা অংশকে যদি জোর করে, আমি দেখেছি আমার জীবনে যে নারী তার স্বামীকে এগিয়ে দেয় নাই, সে স্বামী জীবনে বড়ো হতে পারে নাই। আপনারা এমন ভাবে গড়ে উঠুন বা আপনারা এমন মা হবেন, এমন বোন হবেন যে আপনাদের আদর, আপনাদের ভালোবাসা, আপনাদের মনের যে সচেতনতা তাই দিয়ে ভবিষৎ বংশধরকে গড়ে তুলবেন।”

নারীদের অবদানের কথা, নারীদের সহযোগিতার ইতিহাসকে পুরুষরা যেন না ভুলে যায় এই প্রসঙ্গেও নিজের সংসারের নারীর অবদানের কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুননেছার দূরদর্শিতা ও অবদানের উল্লেখ করে বলেছেন, “ আমার জীবনে ১০/১১ বৎসর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন আমার স্ত্রী মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসতো।

এমন সময়ও আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছিÑআমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই, আমার ছেলে-মেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। মহিলার নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। সে জন্য আজকে আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা আমার যখন কোনও রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে। ”
অবশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বেই ১৯৫২ সালে যখন বঙ্গবন্ধু নয়াচীন শান্তি সম্মেলনে যান। তখন চীনের বাস্তবতায় চীনের এবং পূর্ববাংলার নারীদের নিয়ে তিনি যে সহমর্মিতা দেখিয়েছেন এবং ভেবেছেন তা আমাদের বর্তমান বাংলাদেশে খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনের দায় ছাড়াও মানবীয় ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি দেন। পূর্ববাংলায় একসময় যৌতুক প্রথার প্রচলন ছিল। নারীদের প্রতি আহ্বান রেখেছেন তারা যেন এ প্রথার বিরুদ্ধে স্বোচ্চার হয়। এজন্যে যুবকদের সহযোগিতারও উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেছেন, “আমি আমার দেশের মেয়েদেও অনুরোধ করবো, যে ছেলে এইভাবে অর্থ চাইবে তাকে কোনো মেয়েরই বিবাহ করা উচিত না। সময় থাকতে এর বিরুদ্ধ আন্দোলন করা উচিত এবং আমাদেও দেশের শিক্ষিত মেয়েদের এগিয়ে আসা উচিত। মানবসৃষ্ট এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষশ্যেও ফলজলিত কুপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে আমাদেও মতো বহু যুবকের সাহায্যও তারা পাবে” (পৃষ্ঠা-৯৭)। যৌতুক যে নারীর প্রতি নির্যাতন ও বৈষম্যের একটি অন্যতম কারণ এবং তা নির্মূলে নারী ও পুরুষকে এগিয়ে আসতে হবে তা উল্লেখ করেছেন। নারীর অবদান যে চীনকেও সমৃদ্ধ করেছিল এ বিষয়টি তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। “নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলে-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে।

সত্য কথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনোদিন বড় হতে পারে না।

নয়াচীনে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার কায়েম হওয়াতে আজ আর পুরুষ জাতি অন্যায় ব্যবহার করতে পারে না নারী জাতির ওপর”(পৃষ্ঠা-৯৯)। সেই ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়নের ও সমাজের সমতার কথা ভেবেছেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে নারীর অধিকারের প্রতি যে স্বীকৃতি রয়েছে তা বঙ্গবন্ধুর নারী ভাবনার ফসল। সংবিধানের ২৭, ২৮ (১), ২৮ (২), ২৮ (৩), ২৮ (৪), ২৯ (১), ২৯ (৩) অনুচ্ছেদে সকল নাগরিক যে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী, নারী-পুরুষভেদে রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন না করার এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ প্রভৃতি বিষয় স্থান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ১৫টি আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান করেন বঙ্গবন্ধু। নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয় স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নয়নে।

১৯৭২ সালেই সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে যে সব নারী পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত করেছেন। এছাড়াও নারী পুনবার্সন বোর্ড গঠন করে তাদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি মহিলা সংস্থার এক ভাষণে বীরাঙ্গণাদের বাবার নাম ও ঠিকানা লেখার ক্ষেত্রে বলেন, “ আজ থেকে ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় লিখে দাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ঠিকানা লেখ ধানমন্ডি ৩২।”

নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের ভিত্তি রচিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ভিত্তিতে। ১৯৭৩-১৯৭৮ সালে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা ও সমাজকল্যাণ মূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। শহিদদের স্ত্রী ও কন্যাদের চাকরিও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দিয়েই ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মহিলা আওয়ামী লীগ। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর দুই জন নারীকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে একজন নারীকে নিয়োগ দেন। সামাজিক মুক্তির পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়েও ভেবেছেন। এবং কার্যকরী পদক্ষেপও গ্রহণ করেছেন- ১৯৭৪ সালে নারী উন্নয়ন বোর্ডকে পুনর্গঠন করেন ‘নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনে।

মাত্র সাড়ে তিনবছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ তথা তাঁর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণ, ক্ষমতায়ন ও অধিকারের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। ভেবেছেন নারীর উন্নয়নের জন্য। আর তারই ধারাবাহিকতায় তাঁরই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়নে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন- তা বাস্তবায়ন করছেন।

লেখক: কবি, মুক্তিযুদ্ধ ও ফোকলোর গবেষক; উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত