785
Published on জুন 23, 2021ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনঃ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাঙালির ভাগ্য ফেরানো এবং দিন বদলের দল। বাঙালির ভাগ্য ফিরেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে; আর দিন বদল হয়েছে তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে (অবশ্য যার সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে; তার কন্যা অসমাপ্ত জীবনের পিতার অসমাপ্ত স্বপ্টেম্নর রূপায়ণ করছেন)। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর হাতেখড়ি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলটির জন্মলগ্নে (২৩ জুন ১৯৪৯)। ১৯৫৩-তে তিনি সাধারণ সম্পাদক; ১৯৬৬-তে সভাপতি, যা বিস্তৃত হয়েছিল ১৯৭৪ পর্যন্ত, যখন বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। অবশ্য তার আগেও ১৯৫৭ সালে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিত্বের পদে ইস্তফা দিয়ে সাধারণ সম্পাদকের কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দলীয় দায়িত্বে ওপরে উঠেছিলেন ধাপে ধাপে। বিপরীতে কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের শুরু দলের শীর্ষ থেকে; ১৯৮১ সালের ১৭ মে সামরিক শাসনে বিপন্ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরেছিলেন বৈরী পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। দেশের প্রাচীনতম, বৃহত্তম এবং তৃণমূললগ্ন দলটির বয়সকাল সাত দশকের বেশি হলো; এ সময়ের সিংহভাগ এই পিতা-কন্যার নেতৃত্ব দলের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে, এবং একই সঙ্গে নির্দেশিত হয়েছে দেশ ও মানুষের এগিয়ে চলার পথ।
বাঙালিলগ্ন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাঙালিলগ্ন আওয়ামী লীগের মিথস্ট্ক্রিয়ায় যে রসায়ন তৈরি হয়েছিল, তার জারক রসে সিঞ্চিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল। আসলে আওয়ামী লীগের জন্মক্ষণ ছিল ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণ, যে ক্ষণে নির্ধারিত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতার গতিপথ। কাজেই আমরা বলি, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ মানেই স্বাধীনতা।
অন্নদাশংকর রায়কে বলা কথা থেকে- 'বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্টম্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। তিনি পাকিস্তান হওয়ার পর ইসলামিয়া কলেজের সিরাজউদ্দৌলা হোস্টেলে পূর্ব বাংলার কিছু মানুষ নিয়ে এক আলোচনা সভা করেছিলেন।' বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তা সভায় উপস্থিত প্রয়াত যশস্বী সাংবাদিক কে.জি. মুস্তাফা নূহ-উল-আলম লেনিনকে ১৯৯৮-তে এভাবে বলেছিলেন, 'মিয়ারা, ঢাকায় যাইবা না? শোনো মিয়ারা, ঢাকায় গিয়া কাম শুরু করতে হইব। মাউড়াদের সাথে বেশিদিন থাকা যাইব না। এখন থিকাই প্রস্তুতি নিতে হইব।'
১৯৭২-এ ছাত্রলীগের সম্মেলনে দেওয়া ভাষণের এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু বললেন, 'কলকাতা থেকে বিএ পাস করে এলাম ঢাকায়। ঢাকায় এসে রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে, বাঙালির জাত শেষ হয়ে গেছে। সেই দিন শপথ নিলাম, বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। ১৯৪৭ সাল হলো আমাদের সংগ্রামের সূচনা।'
১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রামের সূচনা। অবশ্য ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির বাঙালিত্ব অর্জনের প্রথম সংগ্রাম, যার সূচনা হয়েছিল আগের বছর। এর পর থেকে একাত্তর পর্যন্ত লাগাতার সফল সংগ্রাম, যে সাফল্যগাথার রচয়িতা ছিল ছাত্রলীগ (ছাত্র ইউনিয়নও ছিল) এবং আওয়ামী লীগ। '৫৪-এর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের প্রধান রূপকার ছিল আওয়ামী লীগ। '৬৬ সালের ছয় দফা- বাঙালির মুক্তিসনদ, প্রথমত ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব প্রকল্প, পরে তা আওয়ামী লীগের হয়। এই ছয় দফা আন্দোলন বাঙালিকে স্বাধীনতামুখী করে। ছয় দফা যে আসলে স্বাধীনতার এক দফা- সে কথা তো বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে বলেছিলেন। '৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়ে আওয়ামী লীগ পৌঁছেছিল এক অনন্য উচ্চতায়। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ রাজনীতির পথে না এগোনোর ফলে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের জাতীয় চার নেতা- তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান।
সংগ্রামের/সমরের সফল সমাপ্তি হলো ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১; 'মাউড়াদের সঙ্গে থাকার সময় শেষ হলো ২৪ বছর চার মাস তিন দিন পর। পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু আত্মতৃপ্তি নিয়ে বললেন- 'আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।' আরও নির্দেশ দিলেন- 'বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র।' সংবিধান দিয়ে (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২) জাতিকে রোডম্যাপ দিলেন। রোডম্যাপে বলা হলো স্তম্ভসম চার মূলনীতির কথা- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ। ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীতে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা তুলে ধরেন এভাবে- 'আমি কী চাই? আমি চাই, বাংলার মানুষ পেট ভরে খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে-খেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।'
বঙ্গবন্ধুর এ চাওয়াগুলো পাওয়াতে রূপান্তরিত হওয়ার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছিল বলেই বাকশাল হয়েছিল। বাকশাল এক দল ছিল না। ছিল অভিন্ন জাতীয় মঞ্চ; যেখানে আওয়ামী লীগ লীন হয়ে ছিল, বিলুপ্ত নয়। ১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাকশালের গঠনতন্ত্র ঘোষিত হয়, যা পড়লে বোঝা যায়, বাকশাল কর্মসূচি রূপায়িত হলে বাংলাদেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন অনিবার্য হতো। কিন্তু বাকশাল অপূর্ণ থেকে যায়। অপূর্ণ থেকে যায় এর স্রষ্টার জীবনও।
বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণ চাওয়াগুলোকে পাওয়ায় পরিণত করছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার সাহসী, মানবিক এবং উদ্ভাবনী নেতৃত্বে এ করোনাকালেও বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার তকমা পেয়ে গেছে। উপরন্তু এ নেতৃত্বে '৮১ সালের পর আওয়ামী লীগ টিকে গেছে এবং ক্ষমতাসীন হয়েছে (১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৮- চলমান)।
বঙ্গবন্ধুর যাত্রা শুরু হয়েছিল শূন্য থেকে এবং মাটি আর মানুষ নিয়ে। তার সময় ছিল মাত্র ১,৩১৪ দিন। বঙ্গবন্ধুর আমলে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ ঝুড়ির তলা লেগেছিল; আর ঝুড়িতে স্থিত হয়েছিল অনেক কিছু। সুতরাং বাস্তবতার নিরিখে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় এ কারণে- যেন বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে না পারে।
বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য প্রগতির পথে। ৫০ বছরের বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক; যেতে হবে এখনও বহুদূর। আমাদের গন্তব্য- সোনার বাংলা। সোনার বাংলার পথ-পরিক্রমা করতে হলে যে চ্যালেঞ্জ, সেগুলো হলো- বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক প্রেরণায় থিতু থাকা, শাসনের গুণমান বাড়ানো, বৈষম্যের বৃদ্ধি রোধ করা, অস্থির-উত্তাল সমাজকে সামাল দেওয়া, শিক্ষার স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানো; সর্বোপরি দুর্নীতি ঠেকিয়ে দেওয়া। চ্যালেঞ্জ আরও অনেক আছে, তবে এগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবিলা করতে হবে।
আমরা দেখছি, এক দীর্ঘ সময়ে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ আজও টিকে আছে। দলটি তার আবর্তন-বিবর্তনে নেতৃত্বের বিচারে পিতা-কন্যার কাছে ঋণী। এরাই দল ও দেশকে পথ দেখিয়েছেন। কাজেই দেশ ও জনগণের জন্য দলটির ইতিহাস-স্বীকৃত যে অবদান, তা তো নেতৃত্বের কারণে। সুতরাং আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা একাকার।
লেখকঃ বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল