গণটিকায় গণমুক্তি

873

Published on আগস্ট 2, 2021
  • Details Image

মেহেদী হাসান বাবু:

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস হয়তো কখনই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে না। তাই সংস্থাটি বারবারই টিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে টিকা’ স্লোগানটি কার্যকর করে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ফিরেছে স্বাভাবিক অবস্থায়। এর মধ্যেই বাংলাদেশে গণটিকার কার্যক্রম ঘোষণা করেছে।

মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণহারে টিকাদানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ৭ আগস্ট শুরু হবে দেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গণটিকা কার্যক্রম। আর মফস্বল শহর, গ্রাম, চরাঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষ এখন করোনাভাইরাসের টিকা নেয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন। শুধু তাই নয়, টিকা সহজলভ্য করার জন্য কোনো প্রকার নিবন্ধন ছাড়াই কেবলমাত্র ন্যাশনাল আইডি কার্ড কিংবা স্মার্টকার্ড নিয়ে গেলেই টিকা পাবেন সাধারণ মানুষ।

করোনা মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষ যখন একটি নির্ভরযোগ্য টিকা পাওয়ার প্রতীক্ষায় ছিল, টিকা আবিষ্কারের আগেই যেখানে উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অগ্রিম বুকিং করে রেখেছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হয়ে আমরা সময়মতো টিকা পাব সেটি ছিল কেবলই কল্পনা মাত্র। সত্য হলো, আমরা যথাসময়েই টিকা পেয়েছি, যখন পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশই টিকা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, দেশে এ টিকা গ্রহণের কার্যকারিতার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। দেশে এখন টিকার মজুদ এতটাই স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে যে, সরকার ইউনয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত টিকাকরণ চালুর ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে।

বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে বিপুল পরিমাণ মানুষকে বিনাপয়সায় টিকাকরণের আওতায় নিয়ে আসার গোটা উদ্যাগটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি শুরু থেকেই টিকার বিষয়ে শতভাগ জোর দিয়ে এসেছেন। বলেছেন, তার দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য তিনি বিনামূল্যে টিকার ব্যবস্থা করবেন। তখন অনেকেই সেটা বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু বরাবরের মতো বিরোধীদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে টিকা কূটনীতিতে চূড়ান্ত সাফল্যের ছাপ রেখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, গেল কয়েক শতাব্দীর মহামারিতেও বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল। তবে সে সময়ও সুখবর এনেছিল প্রতিষেধক বা টিকা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অতীতের প্রাণঘাতী মহামারিও রুখে দিয়েছিল প্রতিষেধক বা টিকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সংক্রামক ব্যাধি ঠেকানোর জন্য টিকা অত্যাবশ্যক।

জাতিসংঘের বিশ্ব জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ (২০২০ সাল) অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৭ লাখ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার ১২৭ জন টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে সব ধরনের টিকা মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৪২২ জন প্রথম ডোজ নিয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪৩ লাখ ২২ হাজার ৩২৭ জন। গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ সরকারের করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া হচ্ছিল। পরে এ বসয়সীমা কমিয়ে ৩০ বছরে আনা হয়। এরপর ২৫-এ কমিয়ে আনার ঘোষণা এসেছে। এর মধ্যেই গণটিকা কার্যক্রমে বয়সসীমা ১৮ বছর পর্যন্ত করার কথা বলা হয়েছে।

করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে সবার জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে চায় সরকার। প্রায় দুই বছর ধরে চলতে থাকা করোনা মহামারি নিয়ে জনগনের নেত্রী ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সদা তৎপর। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে নানা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ মানুষকে সার্বক্ষণিক সেবা ও পরামর্শ দিয়ে আসছে। দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়া রোধে লকডাউন, কঠোর লকডাউন জারি করেছে সরকার। যদিও দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে লকডাউন কোনো সমাধান নয়। তাইতো বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো- সর্বসাধারণের জন্য করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বা টিকা নিশ্চিত করা।

এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পর্যায়ক্রমে সবাইকে করোনার ভ্যাকসিন দিতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো মানুষ যেন টিকা থেকে বাদ না থাকে, আমরা সেভাবে পদক্ষেপ নিয়েছি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, দেশে ২১ কোটি ডোজ টিকা আনার প্রক্রিয়া চলছে। পর্যায়ক্রমে এসব টিকা আনা হবে এবং টিকা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে বলছে, আগামী ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে। টিকা দিতে ১৩ হাজার ৮০০ ওয়ার্ডে টিকা কেন্দ্র করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তৃণমূলে টিকা পৌঁছে দিতে এ পরিকল্পনা করা হয়েছে। এত দিন ঢাকার বাইরে জেলা সদর হাসপাতাল, পুলিশ লাইন্স হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকা দেওয়া হয়েছে। করোনা সংক্রমণ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় বড় পরিসরে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এর মধ্যেই দেশে টিকা আসতে শুরু করায় জোরেশোরে চলছে টিকা কর্মসূচির পরিকল্পনা। প্রতিদিন ১০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার বাদে সপ্তাহে ছয় দিনে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার টার্গেট নিয়ে পরিকল্পনা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, এখন পর্যন্ত দেশের এক কোটি ২৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭৯ জন মানুষ করোনা টিকার আওতায় এসেছে। এদের মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৮০ লাখ ১৮ হাজার ৬৮১ এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪৩ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, প্রায় ২১ কোটি ডোজ টিকার চুক্তি ও প্রতিশ্রæতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চীনের সিনোফার্মের ৩ কোটি, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি, কোভ্যাক্সের ৭ কোটি ডোজ, রাশিয়ার ১ কোটি ডোজ ও জনসন অ্যান্ড জনসনের ৭ কোটি ডোজ রয়েছে। আগামী আগস্ট মাসে চীন আরও ৪০-৫০ লাখ ডোজ টিকা পাঠাবে। কোভ্যাক্স সহায়তা থেকে অক্সফোর্ডের ১০ লাখ ও ফাইজারের ৬০ লাখ টিকা আগামী সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আসার কথা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে খুব দ্রুতই টিকার চুক্তি হতে পারে বলে জানা গেছে। চুক্তি হলে রাশিয়া থেকে প্রথম ধাপে পাওয়া যাবে ১০ লাখ টিকা।

সব মিলিয়ে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ২ কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাবে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানা গেছে। এর বাইরেও চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশে চীনের টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়া চলছে। দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষমাণদের জন্য আসছে সুখবর। কোভ্যাক্স সহায়তার মাধ্যমে জাপান থেকে আসা টিকা দিয়ে আগামী সপ্তাহে শুরু হতে পারে টিকা কার্যক্রম। জাপান থেকে কোভ্যাক্স সহায়তার মাধ্যমে আড়াই লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেশে এসেছে। আগামী শুক্রবার আরও ৫ লাখ টিকা আসার কথা রয়েছে। তবে সব সুখবরের মাঝেও সংশয় রয়েছে টিকা বিতরণ প্রক্রিয়া। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের একার পক্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব নয়। এ জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে; দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যেমন- রাজনীতিক ও সমাজসেবীরা নানাভাবে দুর্গতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন, তেমনি বিশ্ব মহামারি মোকাবিলায় টিকা কার্যক্রমে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, সুধীজন, মসজিদের ইমাম, আলেম-উলামা, সমাজসেবক, সাংস্কৃতিকর্মী, ক্লাব, পাঠাগার, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষক যেখানে যেভাবে প্রয়োজন তাদের নিয়ে ‘করোনা টিকা স্বেচ্ছাসেবক কমিটি’ গঠন করে সবস্তরে টিকা দেয়ার কাজে লাগাতে হবে।

এক্ষেত্রে প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনীতিকদের ভূমিকা রাখতে হবে। বিভিন্ন স্তরে গঠন করতে হবে স্বেচ্ছাসেবক কমিটি। গ্রামের কমিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে; ইউনিয়নের কমিটি উপজেলা পর্যায়ে; উপজেলার কমিটি জেলা পর্যায়ে এবং জেলার কমিটি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সমন্বয় রেখে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব কমিটিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে টিকা ও যাবতীয় সরঞ্জাম সরবরাহ এবং দেখভাল করবে।

এছাড়াও গ্রামের মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে উৎসাহিত করা এবং করোনা চিকিৎসা দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিমকে কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজনে উপজেলা এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন করে চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। এভাবে গণটিকা কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চালাতে পারলেই মিলবে করোনা থেকে গণমুক্তি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সৌজন্যেঃ দৈনিক যুগান্তর

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত