1748
Published on আগস্ট 8, 2021স্কোয়াড্রন লিডার(অব) সাদরুল আহমেদ খানঃ
‘সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর জয়। “ কবি নজরুলের এ আহ্বান আর সাম্যের ডাক আজ প্রতেষ্ঠিত । আর তাইতো বাংলাদেশ নামক দেশটির মুক্তির সংগ্রাম ও ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্ধ নারী সংগঠকের নাম উঠে আসে বার বার। তিনি হলেন জাতীর পিতার সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। There is Always a Lady Behind Every Successful Man. আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তি জীবনেও এ চিরন্তন সত্যের ব্যতিক্রম হয়নি । বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নীরবে-সরবে কাজ করে যাওয়া এক মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের যে দুর্বারতা তার মূলে ছিলেন বেগম মুজিব।
কারাগারে কিংবা রাজপথে , পরাধীন পাকিস্তান কিংবা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সব পরিস্থিতিতে সব সময়ে বঙ্গবন্ধুর সহায়ক শক্তি হয়ে প্রেরণা জুগিয়েছেন এই হার না মানা সংগ্রামী নারী। তিনি মনেপ্রাণে একজন আদর্শিক যোদ্ধা ছিলেন, সাহসিকতার সাথে জেল বন্দী শেখ মুজিব কে গোপন তথ্য আদান প্রদান করে আন্দোলন চালিয়েছেন, রাজনৈতিক ও জাতীয় সংকট উত্তরণে দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বেশ কয়েকবার গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ ও শাস্তি-নির্যাতনের হুমকি দেয়, তবু তিনি ছিলেন অকুতোভয়।
আর সেকারনেই মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে ঘাতকের চোখে চোখ রেখে বুকে বুলেট নিয়ে শহীদ হওয়া কেই বেছে নিয়েছিলেন , প্রাণ ভিক্ষে চাওয়া সে যেন তার ব্যক্তিত্বের সাথে মানায় না ।
৮ আগস্ট বঙ্গমাতার জন্মদিন। এই বীর নারীর কিছু জানা-অজানা ঘটনা তুলে ধরলাম।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪২ সালে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন , সেখানে তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় । নিজ ইচ্ছায় রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করেন বঙ্গমাতা । সাধারণ নারী থেকে হয়ে উঠেছিলেন প্রবল পরাক্রমশালী । নিজের গহনা বিক্রি করে রাজনৈতিক অফিসের ভাড়া, স্মমেলনের টাকা জোগার করেছেন বহুবার । বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রায় ১২ বছর জেল খানায় ছিলেন, তার অবর্তমানে নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে দল কে পরিচালনা করতেন বেগ্ম মুজিব । নিজ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত স ম্পত্তি বিক্রি করে নিজ গ্রামের অনেক অসচ্ছল মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।
বিভিন্ন সময়ে বঙ্গ বন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবি ও আন্দোলন সংগ্রাম সফলভাবে পালনে বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল অন্যতম।
তথ্য সংগ্রহঃ
১৯৬৬-তে ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে শেখ মুজিব যখন বারবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন। নিজ হাতে রান্না করে তাদের খাওয়াতেন । আপ্যায়নের পাশপাশি তিনি তাঁদের কাছ থেকে সকল কথা মন দিয়ে শুনতেন এবং বঙ্গবন্ধু ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে তা যাচাই করতেন ।
তথ্য প্রেরণঃ
বঙ্গবন্ধুর সাথে জেলখানায় দেখা করার সময় তিনি ছেলে-মেয়েদের শিখিয়ে নিতেন একটু হৈচৈ করার জন্য, আর ওই ফাঁকে বাইরের সমস্ত রিপোর্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে দিতেন আর তাঁর কাছ থেকে পরবর্তী করণীয় নির্দেশনা জেনে নিতেন।
নির্দেশনাগুলোর সরবরাহ ও যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাঃ
গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি লুকিয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তাঁদের ছোট ফুফুর ফ্ল্যাট বাসায় চলে যেতেন। ওখানে গিয়ে নিজের স্যান্ডেল বদলাতেন, কাপড় বদলে, বোরকা পরে একটা স্কুটার ভাড়া করে ঢাকায় পড়ুয়া ছোট ভাইকে নিয়ে ছাত্রনেতা আর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। আন্দোলন চালাবে কিভাবে তার পরামর্শ, নির্দেশনা তিনি নিজেই দিতেন। আবার ওই বাসায় ফিরে এসে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতেন। বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে এই ধর্মঘট যাতে পালিত হয় এবং চলমান আন্দোলনের সফলতার জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যেতেন।
ঢাকার বাহির থেকে আগত নেতারা তদানীন্তন শাহবাগ হোটেলে থাকতেন । বেগম মুজিব মাঝে মাঝে বড় মেয়ে হাসুকে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা) পাঠাতেন তাঁদের স্ত্রীদের একটু খোঁজখবর নিয়ে আসার জন্য, আর সেই সঙ্গে কে কে আছে একটু দেখে এসে তাঁকে জানাতেন। বেগম মুজিবের একটা ভালো নেটওয়ার্ক ছিল সারা দেশে। কোথায় কী হচ্ছে তার সব খবর চলে আসত তাঁর কাছে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। সবই করতেন গোপনে এবং রাজনৈতিক মেধায় । আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধু জেলের ভিতরে কিংবা বাহিরে থাকলেও, রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক নেতাই বেগম মুজিবের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।
রাজনৈতিক টার্নিং পয়েন্টে বঙ্গমাতার ভূমিকাঃ
১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু কে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনকে রাষ্ট্র দ্রোহী মামলায় আসামী করে । সে সময় মিথ্যা মামলা তুলে নেয়ার আন্দোলন ক্রমেই আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে রুপ নেয়। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্যারলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে গোল টেবিল বৈঠকের নীল নক্সা করে। বঙ্গমাতা বেগম মুজিব জেল খানায় বঙ্গ বন্ধুর সাথে দেখা করে এই প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করেন । বঙ্গমাতা স্বামীর কাছে খবর পাঠালেন যে, দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে। মামলা তুলে বঙ্গবন্ধুসহ বন্দি ৩৫ জনের সবাইকে মুক্তি দিলেই গোলটেবিল বৈঠক হতে পারে, অন্যথা একা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যে দূরদর্শিতা তিনি সেদিন দেখিয়ে ছিলেন তা পরবর্তী সময়ে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের পথের নির্দেশনা দিয়েছিল। পাকিস্তান বাধ্য হল রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে । ১৯৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধুসহ সবাই মুক্তি পেলেন। মামলা খারিজ হল । বঙ্গমাতার সেদিনের জোরালো ভূমিকা আমাদের ইতিহাসের অনন্য ঘটনা ।
১৯৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধুর উপর অনেক চাপ ছিল। তখন বঙ্গমাতা জনতার মুখের দিকে তাকিয়ে এবং সার্বিক বিবেচনায় থেকে যা বলতে ইচ্ছা সেটাই বলতে বলেছিলেন জাতির পিতাকে । বঙ্গ মাতার পরামর্শের প্রতিফলনই হল ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ । যে মহীয়সী নারীর এমন দৃঢ়প্রত্যয় সাহস জোগানোর ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন ৭ই মার্চের অমর ভাষণ দিয়েছিলেন, বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন, ৭ই মার্চের ভাষণের নেপথ্য শক্তি—তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। এই ভাষণ দিয়েছে বাঙ্গালী জাতীকে যুদ্ধের ডাক, আমরা ছিনিয়ে এনেছি বিজয়। আর এই ভাষণ আজ বিশ্ব স্বীকৃত ইউনেস্কো মেমরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিষ্টারে স্থান পেয়েছে। বঙ্গ মাতা উল্লেখিত দুটি ঘটনায় যদি ব্যক্তিগত ভূমিকা না রাখতেন , তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত ।
সাহসী যোদ্ধাঃ
বঙ্গমাতা ছিলেন এক জন হার না মানা যোদ্ধা । একদিকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার সামলানো, আবার কারাগারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে তাঁর মনোবল দৃঢ় রাখা; অন্যদিকে আইনজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মামলার খোঁজখবর নেওয়া। নিজের সোনার অলংকার বিক্রি করেও মামলার খরচ যুগানো , আওয়ামী লীগের নেতাদের সাহায্য দরকার, কেউ অসুস্থ তাকে টাকা দেয়া, কিন্তু কখনোই এসব কথা কাউকে বলতেন না। নীরবে কষ্ট করে সমস্যার সমাধান করেছেন। কোনো দিন কোনো অনুযোগ-অভিযোগ ছিল না, যত কষ্টই হোক কখনো ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি তাঁকে। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছিলেন । জেলে বঙ্গবন্ধু নিজ জীবনী লেখার জন্য বঙ্গমাতাই উদ্ভদ্ধ করেছিলেন ।
জীবদ্দশায় তিনি স্বামীর পাশে থেকে মানবতার জন্য কাজ করে গেছেন। জীবনে ঝুঁকি নিয়েছেন বহুবার। । জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন তিনি ১৫ ই আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের সময়ও জীবনের মতো মরণের সহযাত্রী হলেন বীর বেশে । সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে বেগম মুজিব বলেন, ‘আমি নামব না আমাকে এখানেই মেরে ফেল।' ভয় কে জয় করা এমনই বীর ছিলেন বেগম ফজিলাতুন নেছা ।
বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের বীরত্ব ও ত্যাগ, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নেপথ্যে সফলতার অন্যতম অনুপ্রেরণা। তিনি আজ বেঁচে না থাকলেও বেঁচে আছেন প্রত্যেক দেশপ্রেমিক বাঙালির হূদয়ে। তাঁর দেশপ্রেম ও আদর্শ অনুপ্রেরণার উত্স হয়ে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
আজ তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখকঃ সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট-এট-আর্মস; সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ