১৯৭১ঃ পঞ্চাশ বছর পরে রাজাকারদের ইতিহাস

1010

Published on সেপ্টেম্বর 2, 2021
  • Details Image

সৈয়দ বদরুল আহসানঃ

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পুর্ণাঙ্গ তালিকার প্রয়োজন আছে। স্বাধীনতার জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন, যুদ্ধ করেছেন আজ তারা সবাই বয়সের ভারে ন্যুজ্ব, একসময় থেমে যাবে তাঁদের জীবনের পথচলা। তাই মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম তো বটেই, আগামী প্রজন্মের কাছেও এঁদের ইতিহাস তুলে ধরতে আমরা দায়বদ্ধ।

এরই সাথে সেসকল বাঙ্গালীদের তালিকা সংরক্ষন করা দরকার যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের ওপর শোষণ-জুলুম-অত্যাচারের পরেও পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে, তাদের পক্ষে কথা বলেছে। পৃথিবীর যেকোন দেশের ইতিহাস ঘাঁটলেই মীরজাফরদের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস অন্য দেশের চাইতে অনেকটাই আলাদা। ফ্রান্সের ইতিহাসে ভিচি সরকারের সহযোগী আর পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের খানের সহযোগীদের মধ্যে তফাত হলো নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর পিয়েরে লাভাল ও ফিলিপ পিটেইন তাদের কুকর্মের শাস্তি পেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজাকার ও পাকিস্তানের দোসরদের অনেকেই ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বহাল তবিয়তে ছিল আর বিপর্যস্ত দেশকে আরো অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল।

আজ যখন আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি, যখন আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুজিবনগর সরকারের সদস্যদের অসামান্য নেতৃত্বগুণের সাফল্য উদযাপন করছি তখন পাকিস্তানের দোসরদের বাংলাদেশের সাথে বেইমানির ইতিহাস লিপিবদ্ধ হওয়া খুবই জরুরী। আজ আমরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের, আমাদের কৃষক-শ্রমিক ভাইবোনদের, আমাদের আজন্ম সংগ্রামী মানুষদের ত্যাগের কথা স্মরণ করছি। একই সাথে জাতিকে এটাও আরো একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন কারা পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের পিঠে ছুরি চালিয়েছিল, কারা এমন এমন একটি দেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিল যে দেশটি ১৯৭০ এর নির্বাচনকে অস্বীকার করে আমাদের ওপর আদিম আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। আমাদের মনে আছে। নিচে বর্ণিত ইতিহাসগুলো লিপিবদ্ধ থাকা উচিত যাতে আবার কেউ এসে নতুনভাবে ইতিহাস বিকৃত করতে না পারে।

১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সম্মেলনে ইয়াহিয়া খানের জান্তা সরকারের পক্ষে ঢাক পেটাতে কারা গিয়েছিল তা একটু মনে করি। সেই দলের মধ্যে অন্যতম ছিল শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী এবং সৈয়েদা রাজিয়া ফায়েজ, যারা দ্বিধাহীনভাবে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের পক্ষে কথা বলতে থাকে। দেশে ও বিদেশে যারা বাংলাদেশের ইতিহাসের ছাত্র, ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছেন তাঁদের এটাও মনে রাখতে হবে যে এই মানুষগুলো ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের পরে কি ভূমিকা পালন করেছেন।

শাহ আজিজুর রহমানকে দেশদ্রোহীতার দায়ে গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুর সরকার। কিন্তু ১৯৭৫ সালে প্রেসিডেন্ট সায়েম ও জেনারেল জিয়াউর রহমান ‘দালাল আইন’ বাতিল করলে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় আসে শাহ আজিজুর রহমান। দালাল আইন বাতিল করার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের খোদ বাংলাদেশে এসেই রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়ার আমলে ৫ বছর মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে শাহ আজিজুর রহমান। অন্যদিকে মাহমুদ আলি ১৯৭১ সালের নভেম্বরে রাওয়ালপিন্ডিগামী প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে পাকিস্তান সরকারের সাথে পরামর্শ করে যায়। ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরতে পারেনি। ভুট্টো সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব করে মাহমুদ আলী এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

সৈয়দা রাজিয়া ফায়েজ ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কনভেনশন মুসলিম লীগের পক্ষে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়ার অধীনে নির্বাচনে খান আবদুস সবুরের ছেড়ে দেওয়া একটি আসনে মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বসার সুযোগ পায় সৈয়দা রাজিয়া ফায়েজ। এরশাদ আমলে মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয় এবং পরে মন্ত্রীত্ব লাভ করে। এরশাদ আমলের পরে সৈয়দা রাজিয়া ফায়েজ বিএনপিতে যোগদান করে এবং দলের ১৮ জন ভাইস প্রেসিডেন্টের একজন হিসেবে নির্বাচিত হয়। আইয়ুব খান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী খান আবদুস সবুর ছিল ৭৫-পরবর্তী মুসলিম লীগের প্রধান। স্বাধীনতা লাভের দুই দিন আগে খান আবদুস সবুর বাংলাদেশকে ভারতের জারজ সন্তান আখ্যা দেয়।

দালাল আইনে গ্রেফতার হয়ে স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই জেলখানায় মারা যায় ফজলুল কাদের চৌধুরী। এর আগ পর্যন্ত আইয়ুব খান সরকারের মন্ত্রী এবং সংসদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ‘ফকা’ চৌধুরী। তার ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরী ৭৫-পরবর্তী সময়ে সবুর খান ও বিএ সিদ্দিকির মুসলিম লীগে ছিল। এক পর্যায়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয় এবং মন্ত্রীত্ব পায়। এরশাদের পতনের পর সাকা চৌধুরী বিএনপিতে যোগ দেয় এবং বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। অবশেষে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার সাজা হয় এবং মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়।

পাকিস্তানের সাথে যোগসাজশ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডিত হয়েছে এমন আরো দুইজন ব্যক্তি মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। তারা দুজনই ৭৫-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয় এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দাপটের সাথে বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রধান গোলাম আজম ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসে এবং এর পর আর কোনদিন পাকিস্তানি ফিরে যায়নি। ১৯৭১ সালে গণহত্যা শুরুর অল্প কিছুদিনের মধ্যে ইয়াহিয়াপন্থী বাঙ্গালিরা জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে। এদের মধ্যে অন্যতম এই গোলাম আজম। শান্তি কমিটি, আল বদর, আল শামস এর মতো গুন্ডা বাহিনী প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেয় গোলাম আজম যেসব বাহিনীর মূল কাজ ছিল বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামকে সহিংস্রভাবে দমন করা। বর্তমান সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে গোলাম আজমের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং সাজা ভোগ করা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

নেজামে ইসলাম পার্টির প্রধান মৌলভী ফরিদ আহমেদ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। এর পর আর কোনদিন তাকে দেখা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন এবং হাসান জামানকে ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া সরকারের কথা বলতে করাচি পাঠানো হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের পাকিস্তানি সেনাদের সংঘটিত হামলা ও নির্বিচারে হত্যার সকল প্রমাণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে থাকার পরেও এরা দুইজন কোনভাবেই তা স্বীকার করতে রাজি ছিল না। স্বাধীনতার পর সাজ্জাদ হোসেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পড়লে বেদম মার খায়। পরে সৌদি আরবে পালিয়ে যায় এবং কিছুদিন শিক্ষকতা করে। এরশাদের আমলে দেশে ফিরে আসলে এবং কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়

ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের মালিক ও সাবেক মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও পাকিস্তানে আটকা পড়ে ছিল। ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে পত্রিকার পুনরায় চালু করেন যা এখন বাংলাদেশ অবজারভার নামে পরিচিত। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে যে দুজন জয় পেয়েছিলেন তাদের একজন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় অন্যজন ময়মনসিংহের নুরুল আমিন। চাকমা রাজা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফিরে না এসে ভুট্টো সরকারের মন্ত্রিত্ব করে। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ইসলামাবাদ প্রধান দূতের দায়িত্ব ও পালন করে।

আর ময়মনসিংহের নুরুল আমিনকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে ইয়াহিয়া খান। জুলফিকার আলী ভুট্টো উপ প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পায়। জেনারেল নিয়াজি যখন পাকিস্তানের পরাজিত সৈন্যদলের সেনাপতি হিসেবে আত্মসমর্পনের দলিলে সই করে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যায়। ইয়াহিয়া খানের স্থলে পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হয় ভুট্টো। ভুট্টোই নুরুল আমিনকে পাকিস্তানের নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেয়।

উপরের ইতিহাসগুলো অল্প কিছু বাঙালির ইতিহাস যারা আমাদের নয় মাসের সংগ্রামে আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। আরো অনেকেই আছে- রাজনীতিতে, শিক্ষাক্ষেত্রে, সাংবাদিকতায়, সিভিল সার্ভিসে, ফরেন সার্ভিসে- তাদের নামও আসা উচিত, কারন তারাও পাকিস্তানের পক্ষে, পাক সেনাদের পক্ষে সরব ছিল কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আয়েশের সাথে নিরাপদ জীবন পার করছে। যে দেশের জন্য তাদের একবিন্দু মায়া ছিল না।

এই মানুষগুলো, এই বাঙ্গালিদের আসল চেহারা আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। তাই এদের তালিকা তৈরি করে দেশের এবং দেশের বাইরের মানুষকে জানার সুযোগ করে দেওয়া জরুরী।

আমরা ভুলিনি, কখনো ভুলবোনা।

(মূল ইংরেজি থেকে অনূদিত)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত