অর্থনৈতিক উন্নয়নে রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও কৃষির ভূমিকা

1302

Published on জানুয়ারি 8, 2022
  • Details Image

হীরেন পণ্ডিতঃ 

কঠিন পরিশ্রমী কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসী বীরদের ঘাম ও শ্রমে সৃষ্ট বাংলাদেশ উন্নয়নের কিংবদন্তি হয়ে বিশ্বের কাছে হয়ে উঠছে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতার পর মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ৭৬৮ গুণ বেড়ে এখন ছয় লাখ তিন হাজার কোটি টাকা।

মার্কিন থিংক ট্যাংক ওয়েলথ-এক্সের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয়, অত্যন্ত সমৃদ্ধ প্রবৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, জাপান, হংকং, চীন, ভারতসহ ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। গত এক দশকে বাংলাদেশে ধনীদের সংখ্যা গড়ে ১৪.৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মোট সম্পদের পরিমাণ পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলায় খাদ্য সংকট সাড়ে সাত কোটি মানুষের হলেও মোট ফসল উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি টন। ৫০ বছর পর বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ। ফসল উৎপাদন চার কোটি টনে পৌঁছেছে। ঘাটতির বাংলাদেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সব বাধা অতিক্রম করে, কঠোর পরিশ্রম ও ঘামের মাধ্যমে কৃষির প্রায় সব উপখাতে কৃষকের মন ও আত্মার জয়জয়কার। ৫০ বছর ধরে শ্রমজীবী মানুষ সমৃদ্ধির চাকাকে পেছন থেকে ঠেলে দেশের অর্থনীতির ভিত তৈরি করেছেন। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতি করেছেন অপ্রতিরোধ্য। লাল-সবুজের পতাকা বিশ্বের শীর্ষে উত্তোলন করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় এক কোটি প্রবাসী তাঁদের অমানবিক শ্রমের প্রায় পুরো আয় দেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের পথে।

সরকারি পরিকল্পনা কমিশন, দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ১৯৭১ সালে ধ্বংসস্তূপে যে দেশটির জন্ম হয়েছিল, ৫০ বছর পরে সেই দেশটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি।

জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) আটটি লক্ষ্যের প্রায় সব কটিতেই ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক দশক ধরে বিশ্বের শীর্ষ সংস্থা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা, গোল্ডম্যান শ্যাক্স, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এইচএসবিসি, সিটিব্যাংক এনএ, পিডব্লিউসির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ডায়মন্ড, ইমার্জিং টাইগারসহ বিভিন্ন নামে ডাকা হচ্ছে। এর কারণেই ধারাবাহিকভাবে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়, রপ্তানি, মাথাপিছু আয়, আয়, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির অন্যান্য প্রধান সূচকে প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বড় চমক।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। নারী শিক্ষা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, আয়, বাণিজ্য ঘাটতি, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য হ্রাস, নিরাপদ সুপেয় পানি, আবাসন, স্কুলে ভর্তি, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হারের মতো সব সূচকে বাংলাদেশের অর্জন সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। সেই সাফল্যের জন্য এত কিছু; অগ্রগতি, বলা যায় অর্থনীতির প্রধান তিনটি খাত—কৃষি, রপ্তানি ও প্রবাস আয়ের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে অন্য সব দিকে সক্ষমতা তৈরিতে।

বাংলাদেশের কৃষকরা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরাসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেও দ্বিগুণ দৃঢ়তা ও শক্তি দিয়ে কৃষির অগ্রগতি বজায় রেখেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৭ শতাংশের বেশি কৃষিকাজে নিয়োজিত। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণ ব্যবহার করে তাঁরা জমি ক্ষয়ের পরও কয়েক গুণ বেশি ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন।

রপ্তানি ও পোশাক খাত কৃষির মতো অবদান রাখছে। এটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এই সেক্টরে প্রায় চার মিলিয়ন কর্মী তুলনামূলকভাবে কম মজুরিতে কাজ করছেন, যা প্রতিযোগিতায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ফলে চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। খাতটি ৫০ বছর আগে রপ্তানি আয়ের তালিকায় ছিল না, কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাত থেকে দেশে এসেছে তিন হাজার ৪১৩ কোটি ডলার। করোনার কারণে গত অর্থবছরে রপ্তানি কিছুটা কমলেও মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।

গত ৫০ বছরে দেশের রপ্তানি আয়ের চেহারা পাল্টে দিয়েছে পোশাক খাত। পাঁচ দশকে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৯৬ গুণ। গ্রামীণ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, নারীর আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং অসংখ্য সহযোগী শিল্পের সম্প্রসারণের মাধ্যমে খাতটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একসময় যেটি ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা ছিল, তা এখন পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বে পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায়ও বাংলাদেশ শীর্ষে।

এ ছাড়া বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে অন্য যে খাতটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা হলো প্রবাস আয়। প্রবাসীরা তাঁদের পরিবার ও প্রিয়জনদের ছেড়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে প্রবাসী হয়ে তাঁদের উপার্জনের বেশির ভাগ দেশে পাঠান। এর ওপর ভিত্তি করেই আজ দেশের সমৃদ্ধি এসেছে। কিন্তু ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিদেশে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ হাজার, এখন তা প্রায় এক কোটি। ১৯৮৬-৮৮ সালে প্রবাস আয় ছিল মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার, কিন্তু ২০২০ সালে বাংলাদেশে এসে দাঁড়ায় ২২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ এক লাখ আট হাজার কোটি টাকা।

তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এনবিআরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী আগামী বছরে দেশের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবসা দাঁড়াবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন তরুণরা। এ খাতের রপ্তানি আয়ও এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দেশে প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর মোবাইল ফোনসেট তৈরি হচ্ছে। সামনে রপ্তানির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিশাল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে।

দেশে খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে, অন্যদিকে স্থল রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আকারে শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এসবের সম্মিলিত ফল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি। সারা দেশে সড়ক, মহাসড়ক ও মেগাপ্রকল্প। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রো রেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি)
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত