১৭ মার্চ ১৯৬৭ কারাগারে এক জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু

617

Published on মার্চ 17, 2022
  • Details Image

আনিস আহামেদ: আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাইÑ বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস’! দেখে হাসলাম। মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করতে অনুমতি কি দিবে? মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালই হত। ১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মণির সাথে দেখা করতে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলমÑ আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি শাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।

আমি থাকি দেওয়ানী ওয়ার্ডে আর এরা থাকেন পুরানা বিশ সেলে। মাঝে মাঝে দেখা হয় আমি যখন বেড়াই আর তারা যখন হাঁটাচলা করেন স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য।

খবরের কাগজ পড়া শেষ করতে চারটা বেজে গেল। ভাবলাম ‘দেখা’ আসতেও পারে। ২৬ সেলে থাকেন সন্তোষ বাবু, ফরিদপুরে বাড়ি। ইংরেজ আমলে বিপ্লবী দলে ছিলেন, বহুদিন জেলে ছিলেন। এবারে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পরে জেলে এসেছেন, ৮ বৎসর হয়ে গেছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পরে প্রায় ১৭ বৎসর জেল খেটেছেন। শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময় মুক্তি পেয়েছিলেন। জেল হাসপাতালে প্রায়ই আসেন, আমার সাথে পরিচয় পূর্বে ছিল না। তবে একই জেলে বহুদিন রয়েছি। আমাকে তো জেলে একলাই অনেকদিন থাকতে হয়েছে। আমার কাছে কোনো রাজবন্দিকে দেওয়া হয় না। কারণ ভয় তাদের আমি ‘খারাপ’ করে ফেলব, নতুবা আমাকে ‘খারাপ’ করে ফেলবে। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, ২৬ সেলে যাবেন। দরজা থেকে আমার কাছে বিদায় নিতে চান। আমি একটু এগিয়ে আদাব করলাম। তখন সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধ হয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেটে থেকে। ওর সাথে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।

আর একটা কেক পাঠাইয়াছে বদরুন, কেকটার উপর লিখেছে ‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে’। বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠাইয়াছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না।’ আমার ছেলেমেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, ‘তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও।’
ছয়টা বেজে গিয়াছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলেমেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নাই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না। ফিরে এলাম আমার আস্তানায়। ঘরে ঢুকলাম, তালা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। ভোর বেলা খুলবে।

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত