জাপানিদের চোখে বঙ্গবন্ধু

652

Published on মার্চ 17, 2022
  • Details Image

ড. নূরুন নবী:

উচ্চশিক্ষার্থে জাপানে পাঁচ বছর অবস্থানকালে আমাদের যে বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জাপানিদের গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আগ্রহ। জাপানিদের বঙ্গবন্ধুর প্রতি এত শ্রদ্ধা, ভালোবাসার অভিব্যক্তি দেখে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করতাম। আমাদের জাপানে অবস্থানকালে মোটামুটি সব মহলে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল, আমি বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা। বিশেষ করে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, যেমন রোটারি ক্লাব, বিদেশি ছাত্রদের সমাবেশ ও জাপানি নববর্ষের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলাপচারিতা হতো। এসব অনুষ্ঠানে একটি কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতাম যার উত্তর দেওয়া সুখকর ছিল না। তারা প্রশ্ন করত, কেন বাঙালিরা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল?

জাপানিরা জানত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও দক্ষিণ এশিয়ার একজন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বাঙালির অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলন এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৩ বছর জেল খেটেছেন। দুবার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে হত্যা করতে ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা আরও জানত, প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের ‘জাতির জনক’ বা ‘জাতির পিতা’ বলা হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে জাপানি প্রগতিশীল সমাজ একজন বলিষ্ঠ ‘বাঙালি ন্যাশনালিস্ট’ হিসেবেই দেখেছেন। বাঙালি জাতির বহু যুগের প্রত্যাশার আর্থ-সামাজিক-সাং¯ৃ‹তিক মুক্তির কাক্সিক্ষত নেতা হিসেবেই বিবেচনা করেছেন তাকে। তারা বঙ্গবন্ধুকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে জানত এবং তাদের কাছে বাংলাদেশ হল নেতাজির স্মৃতিবিজড়িত দেশ। তাদের চোখে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, এশিয়ার লায়নহার্ট, মহাবীর এবং সর্বোপরি একজন মহামানব।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি কেন জাপানিদের এই সশ্রদ্ধ মনোভাব এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যায় কেন তারা এত আঘাত পেয়েছিল, সেই আখ্যান এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫ মার্চের রাত্রি থেকে পরবর্তী নয় মাস বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করতে থাকে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এটা ঐকমত্য যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রায় তিরিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে, দু’লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করে এবং এক কোটি বাঙালিকে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য করে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এসব মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। যদিও আমেরিকার সিনেট, কংগ্রেস এবং জনসাধারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করে এবং পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধের নিন্দা করে, কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধ নিন্দা করেনি। চীনও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধের কঠোর নিন্দা করে, বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার জন্য পাকিস্তান সরকারের ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে এবং মুক্তিবাহিনীদের অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে নানাভাবে সাহায্য করে। কিন্তু জাপান আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিম-লে আমেরিকার প্রভাব বলয়ে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধের তীব্র নিন্দা করে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপান আমেরিকার কাছে পরাজিত হয়েছিল এবং আমেরিকা কর্তৃক অধিকৃত হয়েছিল। এই পরাজয়ের গ্লানি জাপানিরা ভোলেনি। তাই আমেরিকা সমর্থিত পাকিস্তানের বাংলাদেশের কাছে পরাজয়ে জাপানিরা আমেরিকার পরাজয় হয়েছিল বলে আনন্দিত হয়েছিল। আমেরিকার মতো চীনও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। পাকিস্তানের পরাজয়কে চীনের পরাজয়, তাই জাপানিরা আনন্দিত হয়েছিল।

অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক দিয়ে ব্যাপক ব্যবধান সত্ত্বেও এশিয়ার এ দুটি দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক। নেতাজির সামরিক অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় জাপানিরা যেমন নিরাশ হয়েছিল, তেমনি নিরাশ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় যুক্তবাংলার বিভক্তি এবং পূর্ববাংলাকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি । তাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম যেমন বাংলাদেশিদের জন্য আনন্দের, ঠিক তেমনি আনন্দের ছিল জাপানিদের জন্যও।

জাপান আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিম-লে আমেরিকার প্রভাব বলয়ে থাকা সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধের তীব্র নিন্দা করেছিল তার কারণ রয়েছে। বহু যুগ আগে থেকে জাপান ভারতের অবিভক্ত বাংলার ভাষা, সং¯ৃ‹তি এবং রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত ছিল। এই সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯০২ সালে যখন জাপানি মনীষী শিল্পাচার্য তেনশিন ওকাকুরার ভারত সফরকালে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ হয়। তেনশিন ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি জাপানে ফিরে গিয়ে এই অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন বাঙালি কবি ও দার্শনিক সম্পর্কে টোকিও ইম্মেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করেন। এর ফলে জাপানি প-িত মহলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়। সেই সম্পর্কের সূচনার জের ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেন। তার এই ভ্রমণের মাধ্যমে জাপান এবং বাংলার মধ্যে ভাষা, সাহিত্য, সং¯ৃ‹তি এবং রাজনীতির বিষয়ে আদান-প্রদানের বিকাশ ঘটে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান ভ্রমণ, জাপানে ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বোস এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামের কর্মকা-ের মাধ্যমে জাপানিরা ভারতবর্ষের ইতিহাস, বিশেষ করে বাঙালি বীরদের সম্পর্কে জানতে পারে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপ্লবী রাসবিহারী বোস, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস এবং বিচারপতি রাধাবিনোদ পালÑ এই চারজন বিশিষ্ট বাঙালির মাধ্যমে জাপানি এবং বাঙালিদের মধ্যে বন্ধুত্বের যে সূচনা হয়েছিল তা সময়ের সঙ্গে অনেক গভীরে স্থায়িত্ব লাভ করে।

এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় জাপানের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী যারা গুরু তোওয়ামার স্নেহধন্য বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সমর্থক ছিলেন, তাদের অনুসারীরাই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতে পারে।

১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার মোট ৩৫ জন বাঙালির (রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সরকারি অফিসার) বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। সে সময় বাংলাদেশের বাইরে একমাত্র জাপানেই প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য আন্দোলন করে। পরে এই গোষ্ঠীটিই বাংলাদেশের জন্য জাপানে জনমত গঠন, অর্থ সংগ্রহ এবং বিভিন্ন সহযোগিতার মাধ্যমে বাঙালিকে সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশের এই জাপানি বন্ধুদের নেতা ছিলেন তাকাশি হায়াকাওয়া (১৯১৭-১৯৮২)। তার অন্য সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক-গবেষক সুয়োশি নারা, বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা, শ্রীমতী হায়াশি তাকাকো, তানাকা তোশিহিসা, তিব্বতি নাগরিক পেমা গিয়ালপো, লায়ন তাসুগি কিয়োশি প্রমুখ। তাদের উদ্যোগে বাংলাদেশের পক্ষে একাধিক প্রচারমূলক প্রকাশনাও প্রকাশিত হয়েছিল। জাপান-বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে জাপানিদের মধ্যে তাকাশি হায়াকাওয়া অবদানের কথা চিরস্মরণীয়। হায়াকাওয়ার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনের বিষয়টিকে বিশেষ সম্মান ও গুরুত্বের সঙ্গে অনুসরণ ও উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকাশি হায়াকাওয়া একটানা ৪০ বছর জাপানের জাতীয় সংসদ ডায়েটে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন এবং ‘ফাদার অব দ্য ডায়েট’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি তিন দফায় মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী জাপানিরা যে কী গভীরভাবে বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিলেন, তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তারা। মোদ্দা কথা, জাপানিরাও বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনের অনেক আগেই বাংলাদেশ এশিয়ায় উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যেত জাপানি সাহায্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের তো বটেই, জাপানের ভবিষ্যৎ স্বপ্নও ধূলিসাৎ করে দেয়! তারা বিস্ময়াভিভূত ও মর্মাহত হয়। স্বপ্নভঙ্গ হয় জাপানিদের।

জাপানিরা বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের শেষ উত্তরসূরি হিসেবে মনে করত। নেতাজিকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য দেওয়া সত্ত্বে ও তিনি আমেরিকা এবং ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেননি। ভারতকে স্বাধীন করতে পারেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমেরিকা ও চীনের মদদপ্রাপ্ত পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাপানিদের চোখে জাপানিদের মহানায়ক, এশিয়ার মহানায়ক, সর্বোপরি এক মহামানব!

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক এবং বিজ্ঞানী
সৌজন্যেঃ আমাদের সময় 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত