সাদা হাতি নয় রুপপুর হবে রুপসী ময়ুর

2706

Published on মে 19, 2022
  • Details Image

স্কোয়াড্রন লীডার (অবঃ) সাদরুল আহমেদ খানঃ 

সম্প্রতি ডেইলি স্টার পত্রিকায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি নিয়ে নিয়ে প্রফেসর মইনুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। এতে প্রসঙ্গক্রমে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়েও আলোচনা করেন। তবে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে তার একটি বিরুপ মন্তব্য ” নিকৃষ্টত সাদা হাতি “ ফলাও করে প্রচার করছে একটি চক্রান্তকারী মহল। ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে বিপুল ভাইরাল হয়েছে এ বিষয়টি। ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় ফেইসবুক পেইজ লক্ষ করে দেখা যায় প্রায় একইরকম কিছু কমেন্ট ভিন্ন ভিন্ন আইডি থেকে পোস্ট করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। যাহোক আসুন বিভ্রান্তিকর সেই মন্তব্যগুলি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করি।

কমেন্ট ১- রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি ভুয়া প্রজেক্ট

ব্যখ্যাঃ সরকারের সকল প্রজেক্টই যাচাই বাছাই করে নেয়া হয়। লাভজনক ও জনকল্যাণ মূলক প্রজেক্টই গ্রহন করা হয়, যেমন আলোচ্য রুপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আর প্রজেক্ট অলাভজনক বা ব্যয় বহুল বিবেচনায় বাদও দেয়া হয়, যেমন সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর ।

কমেন্ট ২- রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রজেক্ট হঠকারিতায় নেয়া হয়েছে

ব্যাখ্যাঃ মোটেও না। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২- ৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা করেন। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগের আমলে বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি একশান প্লান প্রণয়ন হয়, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে পারমাণবিক চুল্লী স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয়, ধারাবাহিক আলোচনা দরপ্ত্র যাচাই বাছাইয়ের পর ২০১৩ সালে এই প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়।

কমেন্ট ৩- এটি সাদা হাতি, ব্যয়বহুল

ব্যাখ্যাঃ আসলে আয়ুষ্কাল বিবেচনায় রুপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রই সাশ্রয়ী। অন্যান্য তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয় কিছুটা বেশি, তবে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেখানে ২০-২৫ বছর আয়ুস্কাল পায় সেখানে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পাবে ৬০ বছর। এর পরে রিনভেশন/আপগ্রেড করে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যকাল ৯৫-১০০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। কাজেই তথ্যটা যুক্তিযুক্ত না, আয়ুষ্কাল বিবেচনায় রুপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যয়বহুল নয় বরং সাশ্রয়ী।

কমেন্ট ৪- ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এর জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ, আকাশ ভরা তারা..

ব্যাখ্যাঃ তথ্যটি সম্পূর্ণ ভূল। রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতি ঘন্টায় ২৪০০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে, অর্থাৎ প্রতিদিন ২৪০০x ২৪= ৫৭,৬০০ প্রতি বছর ২৪০০x ২৪x ৩৬৫ =২,১০,২৪,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এই হিসেবে ৬০ বছরে উৎপাদন করবে ২,১০,২৪,০০০x ৬০= ১২৬১,৪৪,০০,০০০ মেগাওয়াট। কাজেই ১২ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ এর পরিমান ২৪০০ মেগাওয়াট নয় বরং অনেক অনেক গুণ বেশি।

কমেন্ট ৫- বিদ্যুৎ প্লান্ট করেছেন ভালো কথা, এবার ঋণ শোধ করতে রিজার্ভ খালি করেন

ব্যাখ্যাঃ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ শোধ হবে বিদ্যুৎ বিক্রিতে প্রাপ্ত টাকা থেকেই। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত পাওয়া যাবে ঘন্টায় ২৪০০ মেগাওয়াট। ২৪০০ মেগাওয়াট =২৪,০০,০০০ কিলোওয়াট বা ইউনিট। এক ইউনিট বিদ্যুৎ ৫ টাকায় বিক্রি করা হবে। তাহলে এক ঘন্টায় বিদ্যুৎ এর বিক্রয় মূল্য পাওয়া যাবে ২৪,০০,০০০ x ৫= ১,২০,০০,০০০( এক কোটি বিশ লাখ টাকা)। ১ দিনে (২৪ ঘন্টা) বিক্রয় মূল্য আয় ১,২০,০০,০০০x২৪= ২৮,৮০,০০,০০০ (২৮ কোটি ৮০লাখ)। আর বছরে ২৮,৮০,০০,০০০x৩৬৫= ১০,৫১২,০০,০০,০০০ (১০ হাজার ৫১২ কোটি টাকা) বার্ষিক বিদ্যুৎ বিক্রয় মূল্য। যদি ডলার হিসেব করা হয়, তাহলে বার্ষিক বিক্রয় মূল্য ১০,৫১২,০০,০০,০০০/ ৮৫=১২৩,৬৭,০৫,৮৮২ বা ১২৩৬ মিলিয়ন ডলার।

কমেন্ট ৬- এটা লস প্রজেক্ট, লস কাভার দিতে আছে রেমিট্যান্স যোদ্ধা, আপনার কষ্টের টাকা দেশে পাঠানোর আগে চিন্তা করেন

ব্যাখ্যাঃ রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি লাভজনক প্রতিদান দিবে ।

আগেই বলেছি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বার্ষিক বিদ্যুৎ বিক্রয় মূল্য ১০,৫১২,০০,০০,০০০ / ৮৫=১২৩,৬৭,০৫,৮৮২ বা ১২৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনে জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) ব্যয়, মেইনটেনেন্স এন্ড অপারেশন কস্ট এই দুই মিলিয়ে খরচ হবে ১৬-১৮ ডলারের মতো। সে হিসেবে হিসেবে ঘন্টায় ২৪০০ মেগাওয়াটে খরচ হবে ২৪০০x ১৮=৪৩,২০০ ডলার। এক দিনে খরচ ৪৩,২০০x২৪= ১০,৩৬,৮০০ ডলার। এক বছরে খরচ ১০,৩৬,৮০০x ৩৬৫= ৩৭,৮৪,৩২,০০০ ডলার বা ৩৭৮ মিলিয়ন ডলার।

কাজেই, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বার্ষিক নীট আয় হবেঃ

১২৩৬ ( মোট বিক্রয়)-৩৭৮ (মোট উৎপাদন খরচ) = ৮৫৮ মিলিয়ন ডলার (লাভ)

কমেন্ট ৭- ২০ বছরে বছরে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার করে কিস্তি দিতে পদ্মা সেতু বিক্রি করতে হবে

ব্যখ্যাঃ রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৮৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভ হবে, সেখান থেকে ৫৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করা যাবে অনায়েসেই।

এভাবে প্রথম বিশ বছরে কিস্তি পরিশোধ করেও প্রতি বছর (৮৫৮-৫৬৫) ২৯৩ মিলিয়ন ডলার লাভ হবে। আর এই ১২ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প থেকে ২০ বছরে কিস্তি দিয়েও আয় আসবে আসবে প্রায় ২০x ২৯৩ মিলিয়ন ডলার=৫,৮৬০ মিলিয়ন ডলার।

২০ বছর কিস্তি পরিশোধ করার পর ৪০ বছরে, ৪০ x ৮৫৮ মিলিয়ন= ৩৪,৩২০ মিলিয়ন ডলার আয় হবে । কাজেই ৬০ বছরে আয় দাঁড়াবে ৫,৬৮০+৩৪,৩২০=৪০,০০০ মিলিয়ন ডলার।

রুপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৯০-১০০ বছর চলতে পারে, তবে ৬০ বছর পর রিনভেশন/আপগ্রেড খরচ লাগবে ।

কমেন্ট ৮- প্রজেক্টের নামে টাকা পাচার হবে

ব্যাখ্যাঃ প্রায় অন্য সকল প্রজেক্টের মতো রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রজেক্টটি সফট লোনে করা হচ্ছে। মোট ব্যয় ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিবে ১ বিলিয়নের কিছু বেশি। এবং রাশিয়ান ফেডারেশন লোন দিবে ১১ বিলিয়নের মতো। এখানে টাকা ঢুকছে না পাচার হচ্ছে ভেবে দেখুন ।

কমেন্ট ৯- বাংলাদেশ পরবর্তী শ্রীলঙ্কা না হলেও পরবর্তী চেরনোবিল/ ফোকোশিমা হবে

ব্যাখ্যাঃ রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়েছে সর্বাধুনিক ভিভিইআর-১২০০ প্রযুক্তি। প্লান্ট থেকে লোকালয়ের অবস্থান বিবেচনা করেই মূল চুল্লীতে রয়েছে ৫ স্থরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, রয়েছে কন্টেইমেন্ট ওয়াল, কোন দুর্ঘটনায়ও তেজস্ক্রিয়তা বাহিরে আসবে না, বর্জ্য চলে যাবে রাশিয়ায়। আর এই স্থাপনার নিরাপত্তা দিবে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। ইতিমধ্যে সেনা সদস্যরা প্রশিক্ষণ গ্রহন করছেন কিভাবে শান্তি , দুর্যোগ বা বহিঃশ্ত্রুর আক্রমণ থেকে প্লান্টটি রক্ষা করা হবে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিবেশবান্ধব, কারণ এখানে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে ইউরেনিয়াম যা প্রচলিত কয়লা বা তরল জ্বালানির চেয়ে আহরণ, মজুদ ও ব্যবহারে পরিবেশ বান্ধব। এছাড়াও বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ ও বিপনণের সময়ে নিরাপত্তার বিষয়টি শতভাগ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

প্রিয় পাঠক, আসুন গুজবে কান না দিয়ে বাংলাদেশের গৌরবময় অগ্রযাত্রায় সামিল হই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ অচিরেই পারমাণবিক শক্তিধর রাস্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। ভাবা যায় পাবনার একটি গ্রাম রুপপুর, সেখানে হচ্ছে অত্যাধুনিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র? এই রুপপুরই অতি দ্রুত উজ্জ্বল করবে বাংলার রুপ।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখকঃ সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট এট আর্মস; সদস্য ,অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত