পদ্মা সেতুঃ বিশ্বের বুকে স্বগৌরবে মাথা তুলে দাড়ানোর জ্বলজ্বলে ছবি

947

Published on জুন 16, 2022
  • Details Image

সাইফুল্লাহ্ আল মামুনঃ 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষনে বলেছিলেন, " সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।"

না। কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। বহুমুখী ষড়যন্ত্রের নীলনক্সাতেও পারেনি দমাতে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী, দুরদর্শী নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা অদম্য বাংলাদেশকে।

সকল শঙ্কা, বাঁধা, ষড়যন্ত্রকে পর্যুদস্ত করে আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে কাঙ্খিত পদ্মা সেতু। যদিও এই ঐতিহাসিক সাফল্যের সোপানে পা রাখার আগের পথ মোটেও মসৃন ছিলো না। পরতে পরতে ছিলো ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত।

দেশী-বিদেশী বহুমুখী ষড়যন্ত্রের বিস্মৃত জালে যখন চরম অনিশ্চয়তা, স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কার বোবাকান্না তখনই বঙ্গবন্ধুূকন্যা শেখ হাসিনা মহান জাতীয় সংসদে দাড়িয়ে ব্যক্ত করেন দৃঢ়, উদীপ্ত, সাহসী উচ্চারণ, "বিশ্বমন্দার মধ্যেও যদি আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারি তবে নিজের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মান করতে পারব, ইনশাআল্লাহ আমরা তা করব। বিশ্বব্যাংকসহ আরো যারা আছে তারা ঋণ দেওয়া বন্ধ করলে করতে পারে, করুক। আমরা গরিব হতে পারি। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মানের জন্য আমাদের সঙ্গে দেশের ১৬ কোটি জনগণ এবং বিদেশে ৮০ লাখ প্রবাসী বাঙালি আছে। আমাদের অর্থনীতি অবস্থাও এতো খারাপ নয়।.. " (সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ, ৫ জুলাই, ২০১২)

এরপর ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে।

অতঃপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে শুরু হয় নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মান কাজ। অপর দিকেও থেমে থাকেনি চক্রান্তকারী, অপপ্রচারকরীরাও। চলতে থাকে নানান অপপ্রচার, ব্যাঙ্গাত্মক বক্তব্য বিবৃতি। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারী ছাত্রদলের এক আলোচনায় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, "এখন পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে কিন্তু পদ্মা সেতু এ আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। আর সেই সেতুতে ওঠার জন্য.. এতো যদি জোড়াতালি দিয়ে বানায় সেই সেতুতে কেউ উঠতে যাবেন না। অনেক রিস্ক আছে..."

এর আগে ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর খুলনায় এক সমাবেশেও বিএনপি নেত্রী খলেদা জিয়া বলেছিলেন, " পদ্মা সেতু কি হচ্ছে? হচ্ছে না। এই সরকার পদ্মা সেতুটাও করতে পারলো না।"

শুধু বেগম খালেদা জিয়া নন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতা, সুশীল নামধারী পাক প্রেতাত্মা ভর করা অনেক কথিত নামিদামী মানুষও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মান নিয়ে নানান সময়ে নানান কাল্পনিক, মনগড়া তথ্য দিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় সোচ্চার ছিলেন। এমনকি তাদের এহেন বক্তব্য বিবৃতি পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরেও অব্যাহত রয়েছে।

শুধু অপপ্রচারই নয় চলতে থাকে নতুন নতুন ষড়যন্ত্র। রটানো হয় নানারকম গুজবও। পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে এমন গুজবে ২০১৯ সালে সারাদেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতিও তৈরী হয়। ফলশ্রুতিতে সেতু নির্মান কতৃপক্ষকে বিষয়টি গুজব ও ভিত্তিহীন উল্লেখ করে ২০১৯ সালের ৯ জুলাই গণমাধ্যমে বিবৃতিও পাঠাতে হয়।

এসব মোকাবেলার পাশাপাশি প্রমত্তা, খরস্রোতা এবং নদীর তলদেশে ব্যতিক্রমধর্মী মাটির গঠন যুক্ত পদ্মার বুকে সেতু নির্মানে ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং মারাত্মক চ্যালেঞ্জও। শেষ বেলায় এসে বাধা হয়ে দাড়ায় করোনার থাবা। করোনার কারনে কাজের গতি কিছুটা শ্লথ না হলে আরো আগেই শেষ হয়ে যেতো পদ্মা সেতুর নির্মান কাজ। অবশেষে সব বাঁধা মাড়িয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান গৌরবগাথা বাস্তবতা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁর জাতিসংঘের ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি মানবের অসাধ্য সাধন ও দুরূহ বাধা অতিক্রমের অদম্য শক্তির প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থার কথা আবার ঘোষণা করতে চাই।’ বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকার আমাদের প্রিয়নেত্রী জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানামুখী চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, বাঁধা উপেক্ষা করে পদ্মা সেতু নির্মানে যে অবিচল সাহস, বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন তা জাতির পিতার ঐ বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি বললে অত্যুক্তি হবে না বলে বোধ করি।


পদ্মা সেতু নিছক একটি স্ট্রাকচারাল সেতু নয়। এটি ষড়যন্ত্র- চক্রান্তের জাল ধুলিস্মাৎ করার অনন্য উদাহরণ।
পদ্মা সেতু আমাদের সক্ষমতার প্রতিক। আমাদের দৃপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে চলার অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।

সততা, নৈতিকতা, সাহসিকতা, দৃঢ়তা আর দূরদর্শী নেতৃত্ব শেখ হাসিনার সুযোগ্য, সুদক্ষ, বিচক্ষণ নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে স্বগৌরবে মাথা তুলে দাড়ানোর জ্বলজ্বলে ছবি।

পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে তাই স্মরন করা যেতে পারে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য'র কবিতার কয়েকটি লাইন, কথাগুলো যেন তরতাজা পদ্মাসেতুকে ঘিরেও-
"হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়ঃ"

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মান সারা বিশ্বে ব্যপক আলোচিত বিষয় এখন। বহু দেশের বহু গণমাধ্যম আমাদের গৌরবের এ সাফল্যগাথা নিয়ে সংবাদ প্রচার করেছে। এমনকি থেমে থাকেনি পাকিস্তানের গণমাধ্যমও। দেশটির জনপ্রিয় 'ডেইলি টাইমস' পত্রিকায় আমাদের অগ্রযাত্রার মহানায়ক শেখ হাসিনাকে প্রশংসা করে গত ২ জুন, ২০২২ এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
"স্টোরি অব বাংলাদেশ'স পদ্মা ব্রিজ: মোর দ্যান জাস্ট আ ব্রিজ" শিরোনামে পাকিস্তানী শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. মালিকা-ই-আবিদা খাট্টাক নিবন্ধটিতে বলেছেন :- 'দেশের উন্নয়নের মূর্তিমান প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মতো বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আত্নবিশ্বাস ও দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশাল প্রতিবন্ধকতার পথে তাকে হাঁটতে হয়েছে কিন্তু তিনি তার গন্তব্যে ঠিকই পৌছেছেন। সেতুর নির্মানের সময় যে ষড়যন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো তিনি তা দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। '

পদ্মা সেতু নির্মান শুধুমাত্র আমাদের বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খা পূরণ নয় এটা ইতিমধ্যে বিশ্ববাসীর কাছেও 'যুগান্তকারী অর্জন' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গত ২৪ মার্চ, ২০২২ বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে টুঙ্গীপাড়া যাওয়ার পথে ঢাকায় অবস্থানরত ৪২টি দেশের রাষ্ট্রদূত পদ্মা সেতু দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। যা তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশও করেছেন।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন টুইটারের পোস্টে লেখেন, 'বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান পরিদর্শন করা সত্যিই আনন্দের ব্যপার। নবনির্মিত পদ্মা সেতু দেখেছি, যা চলতি বছরেই উন্মুক্ত হবে।'
পদ্মা সেতুর ছবি শেয়ার করে জাপানের রাষ্ট্রদূত নাওকি লেখেন, 'টেকসই উন্নয়নের জন্য পদ্মাসেতু যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।' কসোভোর রাষ্ট্রদূত গুনার লেখেন, 'পদ্মাসেতু নির্মাণকাজ শেষ। ভীষণ চ্যালেঞ্জ নিয়ে এ কাজটি করতে হয়েছে। অভিনন্দন বাংলাদেশ।'

বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হচ্ছে শেখ হাসিনা। কতিপয় হিংসুক, পরাশ্রীকাতর, দেশের উন্নয়ন বিরোধী ব্যক্তি বাদে সারাদেশের সাধারণ জনগণ শেখ হাসিনার প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ, প্রশংসায় পঞ্চমুখও। সাধারন মানুষের মূল্যায়ন যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠান "রাজনীতির সাতকাহন" এ  গত ২৭ মে 'পদ্মা সেতুর নেপথ্য কথা' শিরোনামে আলোচনা অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড.মসিউর রহমানের বক্তব্যে। তিনি বলেন, "প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি না থাকলে পদ্মা সেতু সম্ভব হতো না। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য গর্ব ও অহংকারের বিষয়। শেখ হাসিনার দূরদর্শী দৃষ্টির কারণেই আজ জাতি ইতিহাস সৃষ্টির দ্বারপ্রান্তে।"

সত্যিই আমরা এ প্রজন্মের বাংলাদেশীরা গর্বিত। জননেত্রী শেখ হাসিনার মতো একজন সাহসী, দৃঢ়, বিচক্ষণ নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়ে। পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের দিয়েছেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আর যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন 'স্বপ্নের সোনার বাংলা' বিনির্মানে আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে দুর্বার গতিতে প্রিয় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে যৌক্তিক দাবি হিসেবে পদ্মা সেতুর নাম 'শেখ হাসিনা'র নামে রাখতে সারাদেশে জনজোয়ার সৃষ্টি হলেও তাতে সায় দেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতে কি? পদ্মা সেতু নির্মানে শেখ হাসিনা নামটি ইতিহাসের পাতায় চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। 

মহান জাতীয় সংসদে গত ৮জুন ২০২২ তারিখে আমাদের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, "... আমার আক্ষেপ হচ্ছে, এই সেতুর নাম সারা বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নামে পদ্মা সেতু চেয়েছে। এই সেতুর নাম শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু, আমি এখনো বলব।... তাহলে আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি হয়ে যাব, যদি আপনাকে এ মর্যাদা থেকে আমরা দুরে সরিয়ে রাখি।......  আমি এখনও বলছি, শেখ হাসিনা... সামারি পাঠিয়েছি মন্ত্রণালয় থেকে, আপনি নাকচ করে দিয়েছেন। সেদিন আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। তো যাক, আমি কষ্ট পেয়েছি, তারপরও আমি মনে করি, এখন আর কি করব-
কাগজে লিখো নাম ছিড়ে যাবে
পাথরে লিখো নাম ক্ষয়ে যাবে
হৃদয়ে লিখো নাম রয়ে যাবে।.. "

শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো বিশ্ববাসীর হৃদয়েই পদ্মা সেতুর সঙ্গে শেখ হাসিনার নাম রয়ে যাবে চিরকাল।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিকল্পনা উপ-কমিটি।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত