শেখ কামাল: সৃষ্টিশীল তারুণ্য

1233

Published on আগস্ট 5, 2022
  • Details Image

মোঃ আসাদ উল্লাহ তুষার:

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ কামাল ছিলেন সব্যসাচী। ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী একজন নির্লোভ, সহজ সরল ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রেমী আধুনিক প্রগতিশীল মানুষ। ছাত্র আন্দোলনের একজন সামনের সারির সংগঠক ছিলেন। নিজে কোন পদ পদবীতে থাকতেন না,কিন্তু নেতৃত্ব দিতেন। নিজে তো ভাল এথলেট ছিলেনই, পাশাপাশি অভিনেতা হিসেবে মঞ্চ নাটক,উপস্থিত নাটক,বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদিতে অংশ নিতেন। ছায়ানটের ছাত্র ছিলেন,ভালো সেতার বাজাতেন। সেই সময়ে পপ সংগীতের ধাঁচে 'স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী' নামে গানের দল গঠন করেছিলেন। এর পেছনে আরেকটি উদ্দেশ্যে ছিল তরুণ সমাজকে বিশেষকরে যুদ্ধফেরত যুবকদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বেশি বেশি মনোনিবেশ করানো। আবাহনী ক্রীড়াচক্র তাঁরই হাতে প্রতিষ্ঠিত। যা আজ দেশ সেরা ক্রীড়া সংগঠন। পোশাক আশাকে ছিলেন খুবই সাদাসিধে কিন্তু আধুনিক। ব্যবহার ছিল অমায়িক,আচরণ ছিল নম্র। বিনয় ছিল তাঁর প্রধান শক্তি। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা একদমই ছিল না।

শেখ কামাল বঙ্গবন্ধুর সন্তান হয়েও নিজেকে সবসময় কেমন আড়াল করে রাখতেন তার একটা প্রমান তৎকালীন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক এর স্মৃতিচারণ বা তাঁর লেখায় পাওয়া যায়...
"শেখ কামাল অত্যন্ত দরাজ গলায় মাথায় রুমাল বেঁধে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে স্লোগান দিচ্ছিল সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রজনতা তাতে ভালোভাবে প্রতিউত্তরের মাধ্যমে সাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করা গেল লোকজন আস্তে আস্তে শেখ কামালের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রজনতা এগিয়ে আমার এবং শেখ জাহিদের দিকে চলে এসেছে আবার কিছু ছাত্রজনতা পিছিয়ে গিয়ে সৈয়দ শাহেদ রেজা ও শহীদ নজরুল ইসলাম যেখানে স্লোগান দিচ্ছিল সেদিকে সরে যাচ্ছে। বিষয়টা চোখে পড়ার মতো। আমি আর শেখ জাহিদ আবুজর গিফারি কলেজের সহকর্মী শাহাবউদ্দিনকে স্লোগান ধরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসা একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম তার সামনে এগিয়ে আসার কারণ। লোকটি কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে সরাসরি শেখ কামালের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বেশ জোরে জোরেই প্রচন্ড ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘ওই বেটা নিশ্চয় পাকিস্তানিদের দালাল, বেটা সব স্লোগান দেয় কিন্তু শেখ মুজিবের মুক্তির স্লোগান দেয় না।’ আমরা সবাই হতবাক, শেখ কামালও ওইভাবে ওর দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে জোরে বলায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কোনোরকমে নিজেদের সংযত করলাম। তাকে বলা হলো, যার দিকে আঙ্গুল দেখাচ্ছেন সে শেখ মুজিবের বড় ছেলে শেখ কামাল। সেজন্যই বাবার মুক্তির স্লোগান নিজে দিতে সংকোচ বোধ করছে। লোকটি কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে শেখ কামালের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে দৌড়ে গিয়ে সোজা ওকে ঘাড়ে তুলে নিল। তারপর শুধু একটাই স্লোগান ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, মুক্তি চাই’। সেদিন মিছিলের অন্যান্য জায়গায় দুই লাইন রাখা সম্ভব হলেও এখানে আর তা রাখা সম্ভব হয়নি। শেখ কামালকে ঘিরে সবাই স্লোগান দিতে দিতে হাঁটছিল। ভিড়ের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখছিলাম এ যেন অন্য এক শেখ কামাল, একটু আগেও যে মাথায় রুমাল বেঁধে নেচে নেচে স্লোগান দিচ্ছিল এখন শুধু বাক্যহারা হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে নীরবে হেঁটে চলেছে।

শেখ কামালের আচার-আচরণ কেমন ছিল সে বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্ৰফেসর আবুল ফজল রচিত ‘শেখ মুজিব; তাঁকে যেমন দেখেছি’ গ্রন্থে লেখা। লেখাটির শিরোনাম ‘শেখ কামাল; স্মৃতিচারণ’। তিনি লিখেছেন, “১৭ই মার্চ শেখ সাহেবের জন্মদিন। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ প্রতি বছর এ দিনটি পালন করে থাকে। ১৯৭৪-এর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য ঢাকার ছাত্রলীগ আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি রাজি হলাম, তবে দিনে দিনে ফিরে আসতে চাই এ শর্তে। তারা সেভাবে বিমানের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছিল।১৭ তারিখ ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, ওরা আমাকে নিতে আসবে কি না। এলেও আমি চিনতে পারব কি না। ওদের কারও সঙ্গে তো আমার দেখা নেই। ... একধারে দেখলাম একটা ছিপছিপে গোঁফওয়ালা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ লম্বা বলে সহজে চোখে পড়ে। ছেলেটাকে আমি চিনতে পারলাম না। লাউঞ্জের প্রবেশপথে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলে, ‘আপনাকে নিতে এসেছি।’ বলেই আমার হাত থেকে ব্যাগটি আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের হাতে নিয়ে নিল। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসেছ?’ ‘জ্বি হ্যাঁ।’ জবাব দিলো ছেলেটি। ওর পেছনে পেছনে হেঁটে এসে একটা গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসল ও নিজে এবং শুরু করলো ড্রাইভ করতে। তার আগে ও জেনে নিয়েছে আমি কোথায় উঠব। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মনে হঠাৎ কৌতূহল হলো। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কী করো?’ বললো, ‘অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সোসিয়োলজিতে।’ ‘ঢাকা থেকে?’ ‘জ্বী হ্যাঁ।’ শেখ সাহেবের সঙ্গে ছেলেটির দৈহিক সাদৃশ্য আমার মনে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম? ‘শেখ কামাল।’ ও! তুমি আমাদের শেখ সাহেবের ছেলে!”

এই ছিলেন শেখ কামাল। জাতির পিতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে কোনো অহমিকাবোধ ছিল না। তিনি ছিলেন বিনয়ী ও মার্জিত স্বভাবের। দাম্ভিকতা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। পরোপকারী, বন্ধুবৎসল ও মার্জিত স্বভাবের শেখ কামালের বিনম্র আচরণে মুগ্ধ হতেন সবাই। তাঁর ঐ সময়ের বন্ধুরা আজও অনেকেই বেঁচে আছেন সমাজের বিভিন্নস্তরে। দুএকজন হয়তো বিপথগামী হয়ে ভিন্ন মত পথেও আছেন। কেউ কিন্তু কোনদিন শেখ কামালকে নিয়ে কোন নেতিবাচক কথা বলতে পারেন নাই। বরং শেখ কামাল একজন মহৎ প্রাণ ভালো বন্ধু বা সহযোদ্ধা ছিলেন সেটাই প্রমান হয় তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁদের স্মৃতিচারনে। অবশ্য বেঁচে থাকতেও তাঁর বন্ধু বা সহযোদ্ধারা জানতেন শেখ কামাল তাঁদের কাছে শুধু বন্ধু,সহযোদ্ধা বা ভাইই ছিল,রাষ্ট্রপতি কিংবা জাতির পিতার সন্তান ছিল না। আর এটাই ছিল শেখ কামালের চরিত্রের প্ৰধান বৈশিষ্ট্য।

শেখ কামালকে নিয়ে অনেক অপপ্রচার এ দেশে হয়েছে। তিনি বেঁচে থাকতেও তাঁর নামে অনেক অপবাদ ছড়িয়েছিল কুচক্রীরা। উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হেয় করা। শেখ কামালকে থামিয়ে দেয়া। তারা হয়তো চিরকালের জন্য শেখ কামালকে থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিরাট ক্ষতি করেছে দেশের। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে দেশের জন্য কিছু করা ঘাতকরা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। পনেরই আগস্টের কালো রাতে পিতা মাতা,নববিবাহিতা স্ত্রী, ভাই,ভাইয়ের স্ত্রীসহ অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে। ঘাতকেরা জানতো শেখ কামাল বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দিবে। নেতৃত্ব দেয়ার সব গুনাবলী যে তাঁর মধ্যে ছিল সেটা ঘাতকরা খুব ভালো জানতো। তাই তো তাঁকেও সেদিন টার্গেট করে খুনিরা হত্যা করে। কি এমন বয়স হয়েছিল? ছাব্বিশ বছরের এমন সাহসী, আমুদে,ক্রীড়া ও সংগীত প্রেমী, বন্ধুবৎসল, সৃজনশীল,পরোপকারী এমন মহৎ প্রান মানুষকে অকালেই জীবন দিতে হলো ঘাতকের নির্মম বুলেটে।

শহীদ শেখ কামাল বেঁচে থাকলে আজ বয়স হতো তিয়াত্তর। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে ও সন্তানদের মধ্যে দ্বিতীয় শেখ কামাল ছিলেন ছাত্র ও যুবকদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। জাতির পিতা বা রাষ্ট্রপতির সন্তান এমন মনোভাব তাঁর মধ্যে ছিল না। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তাঁর সব সন্তানদের সাদামাটা ভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে স্বচেস্ট ছিলেন। যে কারণে রাষ্ট্রপতির পরিবার হিসেবে গণভবন বা বঙ্গভবনের বিলাসবহুল বাড়িতে না থেকে খুবই সাধারণ মানের নিজেদের বাড়ি ঐতিহাসিক ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িতেই থাকতেন। এ ক্ষেত্রে বেগম মুজিব ছিলেন আরো একধাপ এগিয়ে,তিনি কোনভাবেই চাইতেন না অতিরিক্ত বিলাসিতা বা সাড়ম্বর ভাবে বেড়ে উঠুক তাঁর সন্তানেরা। বেগম মুজিবও যেমন অতি সাদামাটা আটপৌরে জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। সন্তানদেরকেও তিনি একই ভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এমন নিরিহ আপদমস্তক বাঙালি মা, বোনের প্রতিচ্ছবি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকেও একইসঙ্গে ঘাতকের নির্মমভাবে হত্যা করে।

শেখ কামাল ছিলেন তারুণ্যের অহংকার। পিতার মতোই নেতৃত্ব দেয়ার দুর্লভ গুন ছিল তাঁর মধ্যে। ছিলেন অনেকটা পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই সাহসী। স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক বা প্ৰধান নেতার পুত্র হিসেবে নিজেকে নিরাপদে রেখে চলার চেষ্টা করেননি। মুক্তিযুদ্ধে সাহসের সাথে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। তার আগে ছাত্র আন্দোলনে কর্মী হিসেবে নিরলস কাজ করেছেন। পিতার পরিচয়ে নেতা হিসেবে নয় কর্মী হিসেবে কাজ করতেই পছন্দ করতেন। তাঁর মত মেধাবী তারুণ্যের অনেক অনেক প্রয়োজন ছিল এই দেশের। তিনি আজ নেই। তাঁর আজ জন্মদিন। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ, শিক্ষা, সততা, সাহস, রুচিশীলতা,মহানুভবতা ও বিনয় তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুসরনীয় হোক এটাই জন্মদিনের প্রত্যাশা। শুভ জন্মদিন: সৃষ্টিশীল তারুণ্য শেখ কামাল। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।

লেখকঃ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত