রাজনীতিতে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ কতটা যৌক্তিক?

599

Published on ডিসেম্বর 11, 2022
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পান্ডেঃ 

একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার জন্য তাদের প্রতিনিধি বেছে নেয় এবং সেই প্রতিনিধিরা সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। এটিই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার রীতি এবং এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও রাজনৈতিক দলগুলার মধ্যে নির্বাচন কেন্দ্রিক ঐকমত্যের অভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও। আর এই সুযোগে দেশের অভ্যন্তরের এবং বিদেশি বিভিন্ন অনুঘটক বাংলাদেশের সরকার এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে দেশের সরকার ও জনগণকে খাটো করার চেষ্টা করে চলেছে বছরের পর বছর।

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকদের বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য বেশ কয়েক মাস ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে মতামত প্রকাশের মাধ্যমে অনধিকার চর্চা করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে এই ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে প্রতিবাদ জানানোর পরও কূটনীতিকরা তাদের বক্তব্য থেকে সরে আসেননি।

এ ধরনের সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত ৬ ডিসেম্বর। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা দেশগুলোর মধ্যে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ছাড়াও ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার কূটনীতিকরা (সমকাল, ০৭/১২/২০২২)।

বিবৃতির পাশাপাশি একইদিন যুক্তরাজ্যের ফরেন ট্রাভেল অ্যাডভাইজারিতে ১০ ডিসেম্বর ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘাতের আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশে অবস্থানরত সে দেশের নাগরিকদের রাজনৈতিক সমাবেশ ও বড় ধরনের জমায়েত এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়। ঢাকায় সতর্কতার সঙ্গে চলাচলের অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করা হয় (সমকাল, ০৭/১২/২০২২)।

বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনীতিকরা বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অংশীদার হলেও প্রত্যেকটি সম্পর্কের একটি নিজস্ব গণ্ডি রয়েছে। সেই গণ্ডির সীমা যখন তারা অতিক্রম করে তখন তাকে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত হিসেবে কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কোনো একটি নির্দিষ্ট দলের রাজনৈতিক সমাবেশকে ঘিরে যেভাবে একটি দেশ বক্তব্য উপস্থাপন করেছে এবং নিজ দেশের জনগণকে বাংলাদেশ ভ্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করেছে সেই ধরনের কোনো ঘটনা কি বাংলাদেশে আদৌ ঘটেছে বা ঘটার সম্ভাবনা আছে? একটি দেশের সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার তার দেশের মানুষের নিরাপত্তা-এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু যে বিষয়টিকে ঘিরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে সেটি আদৌ সেই ধরনের নিরাপত্তা ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে কিনা-তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সব সময় বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সভা সমাবেশের আয়োজন করে। এটিই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৌন্দর্য। কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট সমাবেশকে কেন্দ্র করে এই ধরনের বিবৃতি প্রদান দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে সবার কাছে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কূটনৈতিকদের এ ধরনের হস্তক্ষেপ কতটা যৌক্তিক? যৌক্তিকতার প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করলে এটি একেবারেই যৌক্তিক নয়। অনেকেই যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন এই মর্মে যে যেহেতু বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে, সেহেতু সেই সব দেশের অধিকার রয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে মতামত প্রদান করা। তবে যারা এই ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করেন তাদের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দুটি আলাদা বিষয়। বাংলাদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কোন পথে চলবে। কোনে বিদেশি শক্তির বৃদ্ধাঙ্গুলিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা পরিচালিত হওয়া উচিত নয়।

তাহলে কূটনীতিকরা কেনই বা এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাবার চেষ্টা করছেন। এর মূল কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিভিন্ন সময়ে কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেয়ার ফলে এক ধরনের সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে যেখানে কূটনীতিকরা তাদের মতামত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সরকারের তরফ থেকে কড়া বার্তা প্রদান করা প্রয়োজন। ইতোমধ্যেই কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের এই ধরনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কড়া বার্তা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য উপস্থাপন বন্ধ হচ্ছে না, যা দেশের রাজনীতির জন্য খুব সুখকর নয়।

গত এক দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা নির্দিষ্ট কোনো দেশের বদান্যতায় হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকার এক সময় তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যা পাওয়া দেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছে বিধায় দেশ একটি শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের এই ধরনের বক্তব্য কাম্য হতে পারে না। এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সব রাষ্ট্র তাদের বন্ধু রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হবে এই প্রত্যাশা করতে পারে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা করা এবং সেই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সম্পর্কে মতামত প্রদান সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।

বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্রিক সমস্যাটি একদিনের সমস্যা নয়। যুগের পর যুগ ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সহিষ্ণুতার অভাবের কারণে আজকে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এটি যেমন একটি বাস্তবতা, ঠিক তেমনিভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করবার জন্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারি দলের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে বিরোধী দলেরও দায়িত্ব রয়েছে। কোনো দল যদি অযৌক্তিক দাবির মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়-সেটিও কাম্য হতে পারে না। আবার জোরপূর্বক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতায় আসবার প্রচেষ্টা যদি কার্যকর করা হয়-সেটি কাম্য নয়।

ফলে সব রাজনৈতিক দলকে কিছুটা হলেও ছাড় দিয়ে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করবার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে দেশের অসম্মান করার উদ্যোগ যারা নিয়েছেন তাদের সেখান থেকে সরে আসা উচিত। একই সঙ্গে কূটনীতিকদের এই ধরনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সবার সোচ্চার হওয়া উচিত। কোনো বিদেশি শক্তির অযাচিত শিষ্টাচারবহির্ভূত হস্তক্ষেপ দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কখনও সুসংহত করতে পারে না বরং সেটি দেশের অসম্মানের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

সবশেষে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্য যে সতর্ক বার্তা দিয়েছিল তা অমূলক ও বিভ্রান্তিকর বলে প্রমাণ হলো নির্দিষ্টদিনে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। আশা করি, এ থেকেও বিদেশি মোড়লরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বন্ধ করবেন।

সৌজন্যেঃ সময় নিউজ 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত