২০০১ থেকে ২০০৬, বিএনপি-জামাত শাসনামলঃ বিদ্যুৎ-পানি-সারের অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত, প্রতিবছর ২ কোটি মানুষ মঙ্গা-দুর্ভিক্ষে পতিত

2319

Published on এপ্রিল 6, 2023
  • Details Image

২০০১ সালে সরকার গঠনের পর থেকে দেশজুড়ে বিদ্যুতায়নের নামে শুধু খাম্বা স্থাপনের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা লুটপাট এবং সেই অর্থ বিদেশে পাচার করে বিএনপি নেতা তারেক রহমান। হাওয়া ভবন থেকে খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের টাকা আত্মসাৎ করায়, প্রচণ্ড বিদ্যুৎ সঙ্কটে পড়ে বাংলাদেশ। ফলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বিদ্যুৎ সঙ্কট বাড়তে থাকে। ঢাকাসহ দেশের বাণিজ্যিক নগরীগুলোতে বিদ্যুতের অভাবে আপাত বন্ধ হয় কলকারখানা, এমনকি প্রচণ্ড গরমে পানির সঙ্কটেও চরম ভোগান্তির শিকার সাধারণ মানুষ। আর কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। ফলে খাদ্যসঙ্কটের কারণে মঙ্গা ও দুর্ভিক্ষে মারা যেতে থাকে অসহায় মানুষ।

বিদ্যুৎ না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে সেচের অভাবে ধানের আবাদ জমিতেই শুকিয়ে যায়, ফলে প্রতিবছরই কমতে থাকে আবাদি জমির পরিমাণ। বিদ্যুতের অভাবে কৃষকরা ডিজেল দিয়ে জমিতে সেচ দেওয়ার উদ্যোগ নিলে, বিএনপি-জামায়াত নেতারা সিন্ডিকেট করে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে ক্ষুদ্র চাষিরা জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য ডিজেল-কেরোসিন কিনতেও ব্যর্থ হয়। পানির অভাবে তাদের মাঠ ফেটে চৌচির হয়। গৃহস্থ ও বড় চাষিরা উচ্চমূল্যে চাষাবাদ অব্যাহত রাখলেও সারের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তারাও।

বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে সেচ ব্যাহত, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, এরপর আবার বিএনপি নেতাদের সার নিয়ে কালোবাজারির কারণে বাজার থেকে সারও হাওয়া হয়ে যায়। সরকারি ভর্তুকির সার পর্যন্ত দ্বিগুণ দামে কিনতে বাধ্য করা হয় সামর্থ্যবান কৃষকদের। আর প্রান্তিক কৃষকরা এই পরিস্থিস্থিতে লোকসান দিয়ে চাষাবাদ অব্যাহত রাখার চাইতে শহরে গিয়ে দিনমজুর দিয়ে খাদ্য সংগ্রকেই প্রধান্য দেন।

আওয়ামী লীগ-বিএনপি শাসনামলে খাদ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনামূলক চিত্র:

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রায় অন্ধকারে ডুবে থাকা বাংলাদেশকে টেনে তুলে নিয়ে আসেন শেখ হাসিনা। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট থেকে উন্নীত করে ২০০১ সালে ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করে আওয়ামী লীগ সরকার।

কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি সরকার গঠনের পর পাঁচ বছরেও বিদ্যুৎ উৎপাদন আর বৃদ্ধি পায়নি। বরং বিদ্যুৎখাতে চরম দুর্নীতির কারণে উৎপাদন কমে ৩ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াটে নেমে আসে। ফলে আবারো অন্ধকারে ডুবে যায় দেশ। একারণে জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদনের চাহিদা বাড়লেও তা সেচের অভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব হয়নি। ফলে অবধারিতভাবেই মঙ্গার শিকার হয় উত্তরাঞ্চলের প্রায় দেড় কোটি প্রান্তিক জনগণ, এছাড়াও দেশের অন্যান্য প্রান্তেও দুর্ভিক্ষের শিকার হয় আরো প্রায় এক কোটি মানুষ।

তবে ২০০৯ সালে আবারো আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট থেকে উন্নীত করে বর্তমানে ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে। ফলে ২০০৬ সালে মাত্র ২৮ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় থাকলেও ২০২২ সাল নাগাদ দেশের শতভাগ মানুষ এই বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। ফলে পর্যাপ্ত সেচ নিশ্চিত করায় সামগ্রিক উৎপাদন বেড়েছে ৪ গুণ। ২০০৬ সালে যেখানে মাত্র ২ কোটি ৬১ লাখ মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন হতো, সেখানে বর্তমানে ২০২২ সাল নাগাদ ৯ কোটি ১৯ লাখ ১৮ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন হচ্ছে।

সরকারের সুশাসনের ফলে সিন্ডিকেট করে সার কালোবাজারির দিনও আর নেই। বিদ্যুৎ-পানি-সেচ-সার-উন্নত মানের বীজ, কৃষকদের জন্য সবকিছুর সরবরাহ সহজ হওয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উত্তরাঞ্চল থেকে মঙ্গা যেমন দূর হয়েছে, তেমনি দেশ থেকেও দূর হয় দুর্ভিক্ষ। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত যেমন রাস্তায় চাল টোকানো বা অভাবে আত্মহত্যা অথবা দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মারা যেতো মানুষ; সেই প্রহসনের দিনগুলো থেকে এখন বের হয়ে এসেছে বাংলাদেশ। ।

তবে কেমন ছিল খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দ্বৈতশাসনের যাঁতাকালে কৃষিখাত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সেই দিনগুলি, তৎকালীন মূল ধারার পত্রিকাগুলোয় ছবিসহ প্রকাশিত সংবাদগুলোর আলোকে একবার আসুন ঘুরে আসি বিভীষিকাময় সেই সময় থেকে। বিশেষ করে ২০০৪, ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিদ্যুৎ-সার-ডিজেল নিয়ে দুর্নীতি ও সীমাহীন লুটপাট, একই সঙ্গে গণমানুষের আর্ত-চিৎকারের প্রতি বছরের পর বছর ধরে তাদের নিষ্ঠুর অবজ্ঞার খবরগুলো পড়লে আজও শিউরে ওঠে যেকোনো স্বাভাবিক মানুষ।

২০০৪ সালের পত্রিকার সংবাদে ফসলহানি এবং মঙ্গার কারণ অনুসন্ধান:

২০০৪ সালের ১১ মে জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদ্যুৎহীনতার কারণে দ্বিগুণ দামে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করে অনেক কষ্টে যে ফসল ফলিয়েছিলেন কৃষকরা, দাদন ব্যবসায়ীদের কারণে তার ন্যায্য মূল্যও পাননি তারা। কারণ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সার চোরাচালানের কারণে কয়েকগুণ বেশি দামে সার এবং লোডশেডিংয়ের কারণে দ্বিগুণ দামে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে তেল কিনতে বাধ্য হন কৃষকরা। তীব্র দাবদাহের মধ্যে ফলন কমে আসা অবশিষ্ট ফসলটুকু বাঁচানোর জন্য মহাজন ও দাদন-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন কৃষকরা। ফসল তোলার পরপরই বিএনপি-জামায়াত নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট ফড়িয়ারা আবার সিন্ডিকেট করে কম দামে সেই ফসল বিক্রি করতে বাধ্য করে কৃষকদের। ফলে দ্রুত ফসল বিক্রি করে সুদের ঋণ শোধ করে সারা বছর খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ধানও জমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি কৃষকদের জন্য। ফলে ধান তোলার অল্প দিনের মধ্যেই খাদ্যের অভাবে হাহাকার শুরু হয় তাদের। বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনে এভাবেই বছরের পর বছর থেকে বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁসহ বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলের কৃষক সমাজ নিপীড়িত ও শোষিত হয়েছে।

২০ মার্চের প্রতিবেদনে, খালেদা জিয়ার অপশাসন এবং বিএনপি-জামায়াত সরকারের সীমাহীন লুটপাটের কারণে উত্তরবঙ্গের মঙ্গা সৃষ্টির কথা উঠে এসেছে। তারেক রহমান কর্তৃক বিদ্যুৎ খাতে সীমাহীন লুটপাট ও অর্থ পাচার, সিন্ডিকেট করে সার ও ডিজেলের সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি, কৌশলে কৃষকদের দাদন নিতে বাধ্য করা, প্রভৃতি কারণে ধান উৎপাদন প্রায় অর্ধেক কমে যায়। ফলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রতিবছর খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন কমতে থাকে, কমে যায় বাজারে পণ্যের সরবরাহ। ফলে একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। ফলে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খেতে হয় মানুষকে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মঙ্গার প্রকোপ বাড়তে থাকে।

আবার বিদ্যুৎহীনতার কারণে তীব্র গরমে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন গৃহিণী ও শিশুরা। রিকশা-চালকরা জানান, একবেলা খাবার জোটে তো আরেকবেলা উপোস। গৃহিণীরা জানান, এলপি গ্যাস সাশ্রয়ের জন্য একবেলার রান্না করে দুই বেলা খেতে হচ্ছে। মধ্যবিত্ত যে বাড়িতে আগে দশ-বোরো জন কামলা-কিষাণ খাটতো, সেখানে খাটছে দুই-তিন জন। কামলা-কিষাণরা গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে জড়ো হচ্ছে মজুরের হাটে। সেখানেও কোনো কাজ নেই। ক্ষুধার জ্বালায় ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিতেও বাদ্য হয়েছেন অনেকে। শহরের রাস্তায় বৃদ্ধি পায় ভাসমান পতিতা। অন্যদিকে ঠিকমতো আবাদ করার ভরসা পর্যন্ত হারিয়ে গ্রামের মানুষের স্বস্তিও উধাও। সার আনতে ডিজেল ফুরায়, এমনকি কেরোসিনের দামের ঊধ্বগতির কারণে সন্ধ্যাবাতি জ্বালানো বন্ধ হয়ে যায় নিম্নবিত্তের ঘরে।

খালেদা-তারেকের শোষণে ২০০৫ সালেও মঙ্গা ও দুর্ভিক্ষে মারা যেতো অনেক মানুষ:

২০০৫ সালের ১ নভেম্বর জনকণ্ঠের সচিত্রসংবাদে দেখা যায়, মঙ্গা-অভাব-দুর্ভিক্ষের কারণে উত্তরবঙ্গের অনেক বাজারের রাস্তায় রাস্তায় অর্ধমৃত ও কঙ্কালসার মানুষ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এমনকি নিজের ও পরিবারের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে না পেরে আত্মহত্যা করে লজ্জা থেকে মুক্তি নিতে বাধ্য হয়েছেন নবকান্ত রায় নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা। বিএনপি-জামায়াত সরকার তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ভিজিএফ-এর চাল বণ্টন করার কারণে প্রকৃত অসহায় মানুষরা অভুক্তই থেকে যায়। তবে চাল বিতরণের পর সেখানে পড়ে থাকা চাল কুড়িয়ে নিতে দেখা গেছে অনেক অসহার বয়স্ক নারীকে।

৩ নভেম্বরের পত্রিকার সংবাদে জানা যায়, নীলফামারীতে রতনবালা নামের এক বৃদ্ধা চরম মঙ্গার কারণে খাদ্যের অভাবে অবশেষে মারা গেছেন। পরে ঋণ করে তার লাশের সৎকার করা হয়েছে। এদিনের জনকণ্ঠ আরো জানায়, বিএনপি-জামায়াতের লুটপাট ও দুঃশাসনের কারণে রোজা আর অনাহার এক হয়ে গিয়েছিল সেবার। তিস্তাপাড়ের মানুষ কখনো না খেয়ে, কখনো একবেলা খেয়ে বেঁচে ছিল কোনোমতে।

২০০৫ সালের ৩ নভেম্বরের আরেক সংবাদে জানা যায়, মঙ্গার ভয়াবহতার কারণে উত্তরাঞ্চলের কমপক্ষে ছয় লাখ মানুষের ঘরে ঈদের দিনেও চুলা জ্বলার সম্ভাবনা নেই। এমনকি কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ এক বেলা খেয়ে বেঁচে থাকতে হয় সেখানে। তীব্র মঙ্গার কারণে ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক মানুষ চেয়ে খাওয়ার ওপর ভর করেই বেঁচে ছিল সেসময়। বিএনপি-জামায়াতের সীমাহীন লুটপাটের কারণে সৃষ্ট সেই মঙ্গায় রংপুরে উত্তরাঞ্চলের খাবারের অভাবে মারা গেছে প্রায় অর্ধশত মানুষ। এরমধ্যে রংপুরে ৮ জন, নীলফামারীতে ৫ জন, লালমনিরহাটে ৩ জন, কুড়িগ্রামে ৪ জন এবং গাইবান্ধায় ৩ জন মারা যায় অনাহারে। আশ্বিন-কার্তিকের পর আগে যেখানে দুর্ভক্ষের ভয়াবহতা হালকা হয়ে আসতো, সেখানে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলজুড়ে পুরো বছরেই ভয়াবহ আকাল লেগে থাকতো।

২০০৬ সালে বিদ্যুৎ খাতে সীমাহাীন দুর্নীতি ও সার লুটপাটের কথা স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী:

খালেদা জিয়া প্রথমবার শাসনামলের সময়, ১৯৯৫ সালে সার নিয়ে বিএনপি নেতাদের চোরাচালানের কারণে ভয়াবহ সার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল দেশে। ফলে সেবার ফসল উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর আবারো সার লুটপাট শুরু করে বিএনপি-জামায়াত জোট। তবে ২০০৬ সালে ক্ষমতার শেষ বছরে সীমাহীন লুটপাট করে বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষের মুখে ফেলে যায় তারা। ৫ মে তারিখের জনকণ্ঠ জানায়, বিদ্যুৎ খাতে লুটতরাজের কারণে বিদ্যুৎহীনতায় ডুবে যায় বাংলাদেশ। ফলে সেচ সংকটে চরমভাবে ব্যাহত হয় বোরো উৎপাদন। ফলে উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা প্রকট আকার ধারণ করে এবং দেশের সর্বত্র দুর্ভিক্ষের মধ্যে পতিত হয় নিম্ন আয়ের প্রায় কোটি মানুষ। এমনকি খোদ রাজধানীতেও সুপেয় পানি ও বিদ্যুতের দাবিতে জগ-বালতি এবং হারিকেন নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে সাধারণ মানুষ। ২০০৬ সালের ২০ মের পত্রিকায় এই ছবি প্রকাশের পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি খালেদা জিয়ার সরকার। উল্টো দলীয় ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে জনগণের বিক্ষোভকে দমানোর অপচেষ্টা করে তারা।

২০ মের জনকণ্ঠ আরো জানায়, তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী সাইফুর রহমান দেড় হাজার কোটি টাকার সার ও বীজ লুটপাটের কথা স্বীকার করেছেন। মৌলভীবাজারে সাইফুর রহমানের সফরের সময় স্থানীয়রা বিক্ষোভ করলে তিনি দলীয় নেতাদের লুটপাটের কথা স্বীকার করে জানান, কৃষকদের জন্য সরকার দেড় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল, কিন্তু লুটপাটের কারণে তারা সেই টাকার কিছু পাননি। কৃষকরা সংগঠিত না থাকায় এই টাকা একটি চক্র লুটপাট করে খেয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।

লুটপাটের রাষ্ট্রীয় খাদ্য-গুদাম খালি, সেচের অভাবে মাঠেই পুড়েছে বোরোর চারা:

বিএনপি-জামায়াত সরকারের শেষ বছরে লুটপাট আরো বৃদ্ধি পায়। ২০০৬ সালের ২৮ জানুয়ারির খবরে জানা যায়, টানা চার বছর বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে সেচ ব্যাহত এবং সার কালোবাজারির কারণে ফলন হ্রাস পাওয়ায় দেশে খাদ্য সঙ্কট তীব্র হয়ে ওঠে। ফলে প্রতিটি জেলার আপদকালীন খাদ্যগুদামও শূন্য হয়ে পড়ে। এমনকি সেনাবাহিনীর জন্য রেশনের চাল সংগ্রহ করতেও বিপাকে পড়ে সরকার। ঢাকার খাদ্যগুদামে যেখানে সবসময় ৩০ হাজার টন চাল মজুদ থাকে, সেটি শূন্য পড়ে ছিল। এরকম পরিস্থিতি সব জেলার খাদ্য গুদামেই। এছাড়া দেশে খাদ্য সঙ্কটের কারণে কৃষকদের কাছ থেকেও ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারেনি সরকার। ফলে টিআর-কাবিখার চাল দেওয়াও বন্ধ করে দেয় বিএনপি-জামায়াত সরকার। এরমধ্যেই জামালপুর, যশোর, সাতক্ষীরা, ঈশ্বরদী, রাজশাহী, পাবনা, দৌলতপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নওগাঁ, নাটোরে বিএনপি-জামায়াত সিন্ডিকেট তেল ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করায় নতুন মৌসুমের সেচ ব্যবস্থাপনা নিয়েও অনিশ্চয়তায় পড়ে কৃষকরা।

দেশে যখন খাদ্য সঙ্কট চরমে, উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষে প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর পর মঙ্গা প্রকল্প থেকে প্রায় ১ কোটি টাকা এবং ৭০০ টন চাল দুস্থদের জন্য বরাদ্দ করা হলে, তা প্রশাসনের কাছ থেকে প্রকাশ্যে লুটপাট করে নিয়ে যায় ঠাকুরগাঁও বিএনপির নেতারা। এই লুটের ঘটনায় চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন বরাবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হলেও বিএনপি-জামায়াত সরকারের হাই কমান্ডের প্রভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ২৯ জানুয়ারির এই পত্রিকায় আরো বলা হয়, দুপুরের রোদে সেচ দিয়ে মাটি পর্যন্ত ভেজাতে পারেনি কৃষকরা। একে তো তারেক রহমানের খাম্বা সিন্ডিকেটের কারণে দেশজুড়ে বিদ্যুৎহীনতা, তার ওপর বিএনপি নেতারা ডিজেল নিয়ে কালোবাজারি করে ডিজেলের মূল্য কৃষকদের আয়ত্বের বাইরে নিয়ে যায়। ফলে ভরা শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধানের জমিতে পানি দিতে না পেরে জমিতেই শুকিয়ে যায় অনেকের ধানের চারা।

৬ ফেব্রুয়ারির জনকণ্ঠ আরো জানায়, সার ও ডিজেলের অতিরিক্ত মূল্যের কারণে কৃষক-মজুরদের ত্রাহি অবস্থা। এ ব্যাপারে গৃহস্থরা জানান, মধ্যম সারির কৃষকরাই বোরো ফলন তুলতে পারবে না। সেখানে প্রান্তিক কৃষকদের বাড়িতে বাতি জ্বালানোর মতো কেরোসিনই কিনতে পারছে না, ডিজেল-সার কিনবে কোথা থেকে! ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত গত চার বছরে আবাদের খরচ দ্বিগুণ হলেও, ২০০৬ সালে এসে একেবারে তা সীমার বাইরে চলে গেছে। কৃষকরা বলেন, 'পাবলিক মরুক আর বাঁচুক, কারো কিছু না। সরকারের ক্যাডারের ভয়ে পাবলিক কিচ্ছু কচ্ছে না। ভোট আসুক, তখন দেখাবি।'

৬ মার্চের পত্রিকার খবরে দেখা যায়, জোট সরকারের টানা লুটপাট ও নৈরাজ্যের কারণে বিদ্যু ও সেচের অভাবে চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে রোহনপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ বোরোর আবাদি জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। মাঠ ছেড়ে ঘরে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন কৃষকরা। অনেকে আবার চাষের জমি ফেলে শহরে চলে গেছেন মজুরি দিয়ে একবেলা খাদ্য জোগাড়ের আশায়। চাপাই থেকে আমনুরা, আমনুরা থেকে নাচোল রাজবাড়ী পর্যন্ত এরকম খরা এর আগে কখনো ঘটেনি। এসব এলাকায় ২৪ ঘণ্টার ৬৪ মিনিটও বিদ্যুৎ থাকেনি এমন দিনই ছিল বেশিরভাগ সময়। সেই সঙ্গে সার-ডিজেলের কারসাজির কারণে যে কৃষক আগে সাড়ে তিন বিঘা জমি চাষ করতেন, তিনি মাত্র ২০ শতক জমিতে চাষাবাদ করতে বাধ্য হয়েছেন।

৯ মার্চের প্রতিবেদনে জানা যায়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলজুড়ে সেচের অভাবে তীব্র দাবদাহে মাঠেই পুড়ে গেছে বিস্তীর্ণ বোরো ধানের ক্ষেত। তীব্র লোডশেডিংয়েও কোনোমতে আমন ধান কাটার পর সার-ডিজেল কারসাজির কারণে আর বোরো লাগাতেই পারেনি অনেকে। যারা বোরো লাগিয়েছিলেন, টানা দুই সপ্তাহ এক ফোটা পানিও না পাওয়ায় তাদের বাড়ন্ত ধানের চারাও মাঠেই পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।

সেচ ও সারের অভাবে ৩০ ভাগ আবাদি জমিতে ধানের চারা লাগাতে পারেনি কৃষকরা:

২০০৬ সালের ১ মার্চের দৈনিক জনকণ্ঠের খবর জানায়, বিএনপি-জামায়াত সরকার ও নেতাদের দুঃশাসন এবং লুটপাটের কারণে সার ও সেচ সঙ্কট চরম আকার ধারণ করে দেশে। সারের কালোবাজির এবং সেচের অভাবে উত্তরাঞ্চলের ৩০ ভাগ বোরো জমি অনাবাদী পড়ে ছিল। অনেকে বেশি দামে সার কিনলেও সেচের অভাবে মরে গেছে তাদের বোরো আবাদ। জমির আইলে আইলে কৃষকের ক্রন্দন আর হাহাকারের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়।

সারা দেশে বোরো আবাদের এই পরিস্থিতিতে চাষিরা আশঙ্কা করেন যে. বোরো আবাদ অন্যবারের তুলনায় অর্ধেকে নামবে। শষ্য ভাণ্ডারখ্যাত দিনাজপুর জেলাতের সারের তীব্র সঙ্কটে হতভম্ব হয়ে যান উত্তরের মানুষরা। ১২ মার্চের খবরে আরো জানা যায়, সার সঙ্কটের সুযোগে বিএনপি নেতারা নকল সার তৈরি করে বাজারে ছাড়ায় প্রতারিত হয়েছেন লাখ লাখ কৃষক। এরপরেও সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায়, তারা এটিকে কৃষকদের সঙ্গে সরকারি দলের চরম প্রতারণা বলে অভিহিত করেন। কৃষকরা অসহায় আর্তি জানিয়ে সংবাদ কর্মীদের বলেন, বিচার দেওয়া জায়গা নেই!

নওগাঁর চিত্রও প্রায় একই রকম, ১২ মার্চের পৃথক সংবাদে জানা যায়- সেচের অভাবে বৃহত্তর নওগাঁর অধিকাংশ জমির ফসলই মাঝে পুড়ে গেছে। রাজশাহী থেকে আত্রাই-রাণীনগর হয়ে নওগাঁ প্রায় ৮০ কিলোমিটার, এরপর পোরশা ও ধামুরহাট আরো ৫৬ কিলোমিটার। দীর্ঘ এই এলাকাজুড়ে শুধু ধান আর ধান। কিন্তু ২০০৬ সালে এই বিস্তীর্ণ ভূমি অধিকাংশ ধানের গাছই মাঠেই মারা গেছে। ১৩ মার্চের পত্রিকা জানায়, জয়পুর হাটের বিস্তীর্ণ শস্যভাণ্ডারও প্রায় শেষ হয়ে গেছে তীব্র খরায়, বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিদ্যুত নিয়ে সীমাহীন লুটপাটের কারণে পুরো সময় বিদ্যুৎহীনতার সৃষ্টি হয় জয়পুরহাটে। কৃষকরা বরেন, 'কারেন ভুকুত করি আসে আর যায়'। ফলে সেচের অভাবে ঋণ করে বোরো চাষ করা কৃষকদের আবাদ মার যাওয়ার পাশাপাশি ঋণ শোধের জন্য বাড়ি-জমিও বিক্রি করতে হয় অনেককে।

২০ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদন জানায়, বিদ্যুৎ সঙ্কট, সার নিয়ে সিন্ডিকেট, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি, সেচের অভাব প্রভৃতি কারণে উত্তরাঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বোরো জমি আবাদের আওতাদেই আসেনি। আর যারা আবাদ করেছিলেন, সেচের অভাবে তাদের ফলনও মাঠে মারা গেছে। ফলে উত্তরাঞ্চলজুড়ে খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টির পাশাপাশি সারা দেশেই নীরব দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছেন নিম্ন ও স্বল্প আয়ের প্রায় দুই কোটি মানুষ।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত