845
Published on মে 23, 2023ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):
সাম্প্রতিক দুটি অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। কয়েক দিন আগে ভারতের লাক্ষাদ্বীপে জি২০-এর একটি সাইড কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে আগামী সেপ্টেম্বরে জি২০-এর যে শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের আলোচনার জন্য নানা বিষয়ভিত্তিক প্রস্তাব তৈরির জন্য ভারতজুড়ে ৬৫টি শহরে মোট ২০০টি মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে এই বছরজুড়ে। ইউনিভার্সাল হলিস্টিক হেলথের ওপর এমন একটি কনফারেন্সে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের মনোনয়নে আমার লাক্ষাদ্বীপ যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে সেখানে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য।
বাংলাদেশ জি২০-এর সদস্য রাষ্ট্র না হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের যে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি, তার সূত্র ধরেই এ বছর জি২০-এ অবজারভার কান্ট্রির মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। জি২০-এর বাইরে অবজারভার দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশকেই লাক্ষাদ্বীপের এই কনফারেন্সটির মূল অধিবেশনে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং সে কারণেই এই কনফারেন্সে আমার বক্তব্য দেওয়া।
বাংলাদেশে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিয়ে বলতে গিয়ে আমার একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। সম্মেলনটিতে জি২০ সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছাড়াও জি৭ভুক্ত বেশ কিছু সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
তাঁরা যত না অবাক হয়েছেন বাংলাদেশের প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিকের কথা জেনে, তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক আমি হয়েছি এটি জানতে পেরে যে পৃথিবীর এই নেতৃস্থানীয় উন্নত দেশগুলোর কোনোটিতেই আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো অমন তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত এমন সুসংগঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো নেই। আর লাক্ষাদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে তাঁরা যতটা না বিস্মিত হয়েছেন, তার চেয়েও ঢের বেশি বিস্মিত তাঁদের মনে হচ্ছিল এটি জানতে পেরে যে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে পাশাপাশি বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে ইনসুলিনসহ ২০টি কমন ওষুধ, কিন্তু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কথা বিবেচনায় এনে তুলে নেওয়া হয়েছে যাবতীয় অ্যান্টিবায়োটিক।
লাক্ষাদ্বীপে আমার প্রেজেন্টেশনের পর বেশির ভাগ ডেলিগেট আমাদের ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিয়ে যে মন্তব্যটি আমার কাছে করেছেন, তার অনুরণন আমি শুনতে পেলাম এই কয়েক দিন আগে ঢাকায় একটি উচ্চ পর্যায়ের ইভেন্টে যোগদানের সুযোগ পেয়ে। সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এই ইভেন্টটির আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কিভাবে আমরা বাংলাদেশে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজকে দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারি।
ইভেন্টটির প্রথম সেশনে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা নাতনি সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর বিশেষ অতিথির আসনটি অলংকৃত করেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাইট অনারেবল হেলেন ক্লার্ক, যিনি বর্তমানে চ্যাথাম হাউস কমিশন নামে ইউনিভার্সাল হেলথকেয়ার সংক্রান্ত বিশ্বের একটি শীর্ষস্থানীয় থিংকট্যাংকের কো-চেয়ারের গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। প্রাণবন্ত আলোচনার শেষ পর্যায়ে তিনি জানালেন যে তাঁর বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০৩০ সালে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টে গোলটি অর্জন করতে যাচ্ছে এবং অবশ্যই এই বিশাল অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো মূল ব্যাকবোনের ভূমিকাটি পালন করছে।
কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে সফল উদাহরণ। এই ক্লিনিকগুলো স্থাপনের জমি আসে ব্যক্তিগত কন্ট্রিবিউশিন থেকে আর ক্লিনিকগুলোর অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি আর মানবসম্পদ সরবরাহ করে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাস্থ্যকে এ দেশের নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যার মস্তিষ্কপ্রসূত কনসেপ্ট এই কমিউনিটি ক্লিনিক, যা মানুষের এই মৌলিক অধিকারটির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। জোট সরকারের শাসনামলে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তখন দিনে চরত গরু। রাতে বসত মদ আর জুয়ার আসর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আবারও রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব পেলে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। একে একে চালু করা হয় বিএনপির সময় বন্ধ করে দেওয়া ক্লিনিকগুলো আর পাশাপাশি স্থাপন করা হয় আরো নতুন নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক। ওই সময়টায় সরকারের মাঠ পর্যায়ের একজন তরুণ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিকের এই ধ্বংসযজ্ঞ এবং অতঃপর নব-উত্থান আমার নিজ চোখে দেখা। বঙ্গবন্ধুকন্যার এই মৌলিক কনসেপ্ট, ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ এবার বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেল। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সম্প্রতি বাংলাদেশের উত্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিক সংক্রান্ত একটি রেজল্যুশন পাস হয়েছে। এই রেজল্যুশনটিতে জাতিসংঘ বিশ্বের তাবৎ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকের মডেল অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে। কয়েক দিন আগেই শ্রদ্ধেয়া প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি মৌলিক কনসেপ্ট আশ্রয়ণ প্রকল্প তাঁর মেধাস্বত্ব হিসেবে কপিরাইট পেয়েছে। আর মাস ঘুরতে না ঘুরতে এবার তাঁর আরেকটি মৌলিক কনসেপ্ট কমিউনিটি ক্লিনিক পেল বিশ্বস্বীকৃতি। অজস্র ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী। আপনি জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি, আপনি জাতির গৌরব।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ