সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বয়কট করে বিএনপির অর্জন কী?

452

Published on মে 24, 2023
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পান্ডে:

বছরের পর বছর ধরে, বিএনপি দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তার প্রভাব জাহির করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। এ রকম একটি কৌশল হলো নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত, যাকে অনুভূত নির্বাচনী অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। ২০২৪ সালের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে, চলতি বছরের মে/জুন মাসে দেশে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে: বিএনপি কি নির্বাচন বয়কট থেকে কোনো সুবিধা আদায় করতে পারবে?

নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সুষ্ঠুতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের মতে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে অংশ নেয়া একটি অন্যায্য ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়ার শামিল এবং তাই তারা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করলেও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের সমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

বিএনপির নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত জনমনে নানাভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। এক দিকে, দলটি সমর্থকদের কাছ থেকে সহানুভূতি অর্জন করার জন্য এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দেশের এই শ্রেণির জনগণ বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেও বেশিরভাগ জনগণ এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানায়নি। ফলে, বিএনপির বয়কট কৌশল ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ অনেক ভোটার এই ধরনের নির্বাচন বয়কটকে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার চিহ্ন বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জড়িত হতে অনিচ্ছুক বলে মনে করতে পারেন। তারা বিএনপিকে এমন একটি দল হিসেবে দেখতে পারে, যারা জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এই নেতিবাচক ধারণার ফলে যারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেন তাদের মধ্যে বিএনপির সমর্থন কমে যেতে পারে।

নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বিএনপি এই জাতীয় কৌশল থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য লাভকে পুঁজি করার চেষ্টা করবে।

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন থেকে বিরত থেকে, দলটি নির্বাচনী পরাজয়ের ঝুঁকি এড়াতে চেষ্টা করছে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে তার অবস্থানকে আরও দুর্বল করতে পারে। যদিও নির্বাচন বয়কটের মাধ্যমে দলটির লক্ষ্য নির্বাচনী স্বচ্ছতা, সুষ্ঠুতা এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু গত প্রায় ১৫ বছরে দলটি জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য তেমন কোনো কাজ করতে পারেনি যা জনগণকে তাদের পক্ষ অবলম্বন করতে অনুপ্রাণিত করবে।

এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে নির্বাচন বয়কট কৌশল অবলম্বন করে বিএনপি বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছে। একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো যে, নির্বাচন বর্জন করা দলের রাজনৈতিক ক্ষমতায় সরাসরি প্রবেশাধিকার থাকে না। ফলে, তাদের সমর্থকরা দলের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। নির্বাচন বয়কটের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বিএনপির প্রতিনিধিত্ব কমে যাচ্ছে এবং স্থানীয় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মতামত প্রদানের কোনো সুযোগ থাকছে না। প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্বের এই অভাব দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের ক্ষমতাকে সীমিত করতে পারে এবং নীতিনির্ধারণে এর সামগ্রিক প্রভাবকে হ্রাস করতে পারে।

তাছাড়া, নির্বাচন বর্জন করলেই যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপির উদ্বেগ কার্যকরভাবে সমাধান করা হবে সেই বিষয়ে এই দলটিকে কেউ কোনো গ্যারান্টি দেয়নি। ফলে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য নির্বাচন বয়কটের যে কৌশল বিএনপি নিয়েছে সেটি আখেরে তাদের জন্য কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না বলেই দেশের বেশিরভাগ মানুষের ধারণা। একই সাথে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকারি দলের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সংসদীয় নির্বাচনের সময় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে দলটিকে সহায়তা করবে।

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জন করার মাধ্যমে দলটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি পাবার চেষ্টা করছে। এখন প্রশ্ন হলো, তাদের এই কৌশল কতটা কার্যকর হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের পক্ষ হয়ে সরকারকে কতটা চাপ প্রয়োগ করবে? এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করার সময় বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখা দরকার। এ কথা ঠিক যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাধারণত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনসহ গণতন্ত্রের নীতিগুলিকে মূল্য দেয়। বিএনপি যেভাবে কয়েক মাস ধরে লবিস্টদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে, তাতে কোনো কোনো রাষ্ট্র হয়তো তাদের পক্ষে কিছুটা সংবেদনশীল আচরণ করেছে।

কিন্তু, বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আছে এমন রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশের সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না কারণ তা হবে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গের শামিল। কিছুদিন আগে যেসব দেশের রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তাদের উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, তারাই আবার সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের নির্বাচনকে এই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফলে, নির্বাচন বয়কটের মাধ্যমে বিদেশিদের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করা হলেও সেটি কতটা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি অর্জনের জন্য, বিএনপিকে নির্বাচনী অনিয়ম বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ত্রুটির দাবি প্রমাণ করতে হবে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এবং একটি শক্তিশালী বর্ণনা ছাড়া, যথেষ্ট সহানুভূতি তৈরি করা বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি অর্জন করার ক্ষমতা বিএনপির মিডিয়া কভারেজ এবং অ্যাডভোকেসি প্রচেষ্টার উপরও নির্ভর করবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া আউটলেট, মানবাধিকার সংস্থা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলির সাথে জড়িত হওয়া দলের উদ্বেগগুলিকে প্রসারিত করতে এবং সম্ভাব্যভাবে আন্তর্জাতিক মনোযোগ এবং সমর্থন আকর্ষণ করতে সহায়তা করতে পারে। তবুও, বর্তমান সরকারের বিদ্যমান শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে, আন্তর্জাতিক চাপ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিশীলতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে বলে মনে হয় না।

দেশবাসীর অধিকাংশই মনে করে যে, বিএনপি যদি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত এবং ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে কারচুপির কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারতো, তাহলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিকে আরও শক্তিশালী করতে পারতো। ফলে, এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তটি বিএনপির জন্য একটি ভালো সুযোগ নষ্ট করেছে। আমার এই দাবির সাথে অনেকেই ভিন্ন মত পোষণ করতেই পারেন। প্রকৃতপক্ষে এটি বিএনপির জন্য একটি ভালো সুযোগ ছিল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া, এই নির্বাচন বিএনপিকে ভোটারদের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার, তাদের বার্তা পৌঁছে দেয়ার এবং জনপ্রিয়তা প্রমাণের সুযোগ করে দিয়েছিল। নির্বাচনী সংস্কার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারতো।

নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল স্থানীয় পর্যায়ে তাদের অনুসারীদের চাঙ্গা করতে পারে। এক দশকের ওপর সময় ধরে এই দলটি নির্বাচন বর্জনের যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে তাতে করে স্থানীয় পর্যায়ে দল সাংগঠনিকভাবে একেবারে দুর্বল হয়ে গেছে। তাছাড়া দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় না থাকার কারণে দল এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। দলের অনেক নেতা-কর্মী সরকারি দলে যোগদান করেছে। দলের প্রতিনিধিত্ব কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্থানীয় সরকারে না থাকার কারণে দলের প্রতি মানুষের হতাশা দিনে দিনে বাড়ছে।

তাছাড়া গত প্রায় এক দশকে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনসহ অন্য সকল আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মীদের তেমনভাবে মাঠে নামাতে ব্যর্থ হয়েছে এই দলটি। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন বর্জনের কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের ওপরে চাপ প্রয়োগের যে কৌশল সেটি পূর্বের নির্বাচনগুলোতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে এই নির্বাচনের আগেও সেটি তেমনভাবে ব্যর্থ হবে এমনই মনে করা যায়।

তাছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে বর্তমান সরকার নিজেদের অবস্থানকে অনেকটা সুদৃঢ় করেছে। একদিকে যেমন দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক উন্নয়ন জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। ফলে, আন্তর্জাতিক কোনো চাপের মুখে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার নতি স্বীকার করবে না। যার ফলশ্রুতিতে, নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি অর্জনের প্রত্যাশা বিএনপির জন্য খুব ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে না বলেই দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে।

লেখকঃ অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত