2269
Published on মে 31, 2023২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নামে যে অর্ধশতাধিক জঙ্গি সংগঠনের বিস্তার ঘটে বাংলাদেশে, তার নেপথ্যে ছিল জামায়াত-শিবিরের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতা। জেএমবি-বাংলা ভাইদের জঙ্গি তাণ্ডবে যখন দেশজুড়ে আতঙ্কে শ্মশানের নীরবতা নেমে আসে, এদের নির্মম নির্যাতনে আর্তনাদ করতে করতে যখন কারবালার প্রান্তরের মতো শুষ্ক হয়ে ওঠে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষদের গলা, নারী-শিশুদের সম্ভ্রম নিয়ে যখন রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে এই জঙ্গিরা, তখনও এসব জঙ্গিদের পক্ষে নির্লজ্জভাবে কথা বলেছেন জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার মন্ত্রীরা। এসব জঙ্গিদের বর্বর হত্যাযজ্ঞ-ধর্ষণ-লুটপাটে বাধা না দিতে আইনশৃঙ্খরা বাহিনীর ওপরেও চাপ সৃষ্টি করেছিল বিএনপি-জামায়াতের মন্ত্রী-এমপিরা। এমনকি এদের ধরার কারণে খালেদা সরকারের রোষে পড়ে চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়েছিল অনেক দেশপ্রেমী আইনরক্ষা বাহিনীর সদস্য ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার। আসুন তথ্য-প্রমাণসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে জঙ্গি পালনের মতো ঘৃণ্য অপকর্মের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং ফলাফল সম্পর্কে একটু জেনে আসি।
তাহলে ফিরে যেতে হবে আরো একটু পেছনে, মূলত ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পেশীশক্তির মাধ্যমে কেন্দ্র দখল এবং ব্যালটবাক্স লুট করে মাত্র দশমিক আট (.৮) শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জিতে সরকার গঠনের পরপরই সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশবাসীকে স্তব্ধ করে দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তার পুত্র তারেক রহমান এবং জামায়াতের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ জানতো যে, স্বচ্ছতার হিসেবে ভোটে প্রকৃতপক্ষে এগিয়ে ছিল আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রে কেন্দ্রে সন্ত্রাস করে সারা দেশে মাত্র ৫ লাখ ভোটের ব্যবধানে তারা যে ক্ষমতা দখল করেছে, আওয়ামী লীগ যে কোন সময় তা চ্যালেঞ্জ করলে জনরায় আওয়ামী লীগের পক্ষেই যাবে। তাই তারা সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করে আওয়ামী নেতাকর্মীদের নামে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি শুরু করে, আবার দলীয় ক্যাডারদের মাধ্যমে প্রতিটি স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী পরিবারগুলোর ওপর নির্যাতন-লুটপাট-চাঁদাবাজি চালায়। কিন্তু পরবর্তী নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যাতে আওয়ামী লীগকে একেবারে দুর্বল করে ফেলা যায়, সেজন্য জঙ্গিবাদী মাস্টারপ্ল্যান করে খালেদা-তারেক-নিজামী গং।
ইসলামী আন্দোলনের ছদ্মবেশে সাবেক শিবির নেতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী রাজাকার পরিবারগুলোর মাধ্যমে নতুন নতুন প্রায় অর্ধশত জঙ্গিবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয় দেশব্যাপী জামায়াতের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে । পুলিশকে নিবৃত রেখে, এসব জঙ্গির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও প্রগতিশীল মানুষদের ওপর বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ চালায় খালেদা জিয়ার সরকার। যাতে সাধারণ মানুষ ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে না পারে। এমনকি এসব জঙ্গিদের বিচার পর্যন্ত না হয় সেজন্য আদালত প্রাঙ্গণে বিচারকদের ওপরেও বোমা হামলা চালায় তারা। সাংবাদিক-শিক্ষক-সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ- কেউই রেহাই পায়নি বিএনপি-জামায়াত সরকারের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত জেএমবি-হরকাতুল জিহাদ- বাংলা ভাই প্রমুখ জঙ্গিগোষ্ঠীর নৃশংস বর্বর হামরা থেকে। গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ জঙ্গিদের গ্রেফতার করলেও সরকারের ইশারায় তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে অনেকবার।
এমনকি বাংলা ভাইকে আটকের পর তারেক রহমান ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নির্দেশে তাকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গিদের পাশে দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের ক্লিনচিট দিতেন জামায়াতের এমপি-মন্ত্রীরা। কোটালিপাড়ায় বোমা পুঁতে ও রাজধানীর সমাবেশে গ্রেনেড মেরে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল তারা। সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে আতঙ্কিত করেছিল সাধারণ জনগণকে। তাদের পরিকল্পনা ছিল ২০০৬ সালের শেষের দিকে জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হলে এসব জঙ্গিদের ব্যবহার করে আবারো কেন্দ্র দখল করে একচেটিয়াবাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার। সেই লক্ষ্যে সব ভয়ানক জঙ্গি, খুনি, হত্যা মামলার আসামিদের একের পর এক ছেড়ে দিয়ে নিজেদের বহরে করে নিয়ে ঘুরেছে বিএনপি-জামায়াতের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রী ও নেতারা। আসুন তথ্য-প্রমাণসহ একবার দেখে আসি জঙ্গিদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জিম্মি করে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা ও ভয়াল পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত।
জামায়াত-শিবির-স্বাধীনতাবিরোধীদের দিয়ে যেভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো:
জঙ্গবাদী নাশকতাকারী সংগঠন বলতে জেএমবি, হরকত উল জিহাদ, বাংলা ভাই প্রমুখের ভয়াবহতার নামই সবার আগে মনে হয় আমাদের। আসুন দেখে নেই কারা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছে এসব জঙ্গিবাদী গ্রুপগুলো। জঙ্গিরা ধরা পড়ার পর তাদের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা তৎপরতা, গণমাধ্যমের স্বাধীন তথ্য অনুসন্ধান, এমনকি বিএনপি-জামায়াতের সূত্রের এসব তথ্যকে সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে।
২০০৬ সালের ৩০ এপ্রিলের জনকণ্ঠের সংবাদে উঠে আসে জেএমবি নেতাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড। দেখা যায়, স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকার পরিবারের মাধ্যমেই সৃষ্টি করা হয়েছিল এই জেএমবি। জেএমবিতে যোগদানের আগে তারা শিবির ও জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। জেএমবির শুরা সদস্যের সাত জনের সবারই ধর্মীয় রাজনীতির হাতেখড়ি শিবিরের মাধ্যমে। জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের বাবা ছিল ১৯৭১-এ জামালপুরের আল বদর কমান্ডার, তার নাম আবুল ফজল। শায়খ আবদুর রহমান নিজেও শিবিরের অগ্রগামী সংগঠন ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। পারিবারিকবাবে তার সঙ্গে জামায়াতের সব শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
সাবেক ছাত্রসংঘ নেতা শায়খ আবদুর রহমানের ছোটভাই আতাউর রহমান সানি মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় ছিল শিবিরের সাথী, পরে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিবিরের অন্যতম প্রধান সাংগঠনিক নেতা হয়। ২০০০ সালে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকে। পরবর্তীতে জেএমবির সামরিক শাখার দায়িত্ব নেয় এবং সারাদেশের শিবিরের সঙ্গে জেএমবির নেটওয়ার্কিংয়ের কাজটি করতো সে।
জেএমবির আরেক অপারেশনাল কমান্ডার সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই আযিযুল হক কলেজে শিবিরের রগকাটা বাহিনীর নেতৃত্ব দিতো। পরে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর পরামর্শে জেএমবিতে যোগ দেয়। বগুড়ার রাজাকার পরিবারের সন্তান হওয়ায় তারেক রহমানের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল বাংলা ভাইয়ের। ফলে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জেএমবির সার্বিক যোগাযোর কাজটাও করতো সে। একারণে বাংলা ভাইয়ের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিত ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও নিজামী তা অস্বীকার করে বলেছিল- বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি! এমনকি ময়মনসিংহ অঞ্চলে গ্রামবাসীরা বাংলা ভাইকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও, তারেক রহমানের হুকুমে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জেএমবির শুরা সদস্য নুরুল হুদা আবেদও ছিল একজন প্রভাবশালী শিবির নেতা। পরবর্তীতে শায়খের সঙ্গে জেএমবি গঠন করে সে।
২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের পত্রিকায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাকারী, রমনা বটমূল, উদীচী ও সারাদেশে বোমা হামলার অন্যতম হোতা মুফতি হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। তার ভাই মতিয়ার রহমান মতি কোটালিপাড়া থানা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা। বিএনপি নেতা এই ভাইয়ের মাধ্যমে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার নির্দেশনা গ্রহণ এবং কোনো অপারেশন শেষ করার পর তাদের কাছে রিপোর্ট পেশ করতো মুফতি হান্নান।
তাদের সবার লক্ষ্য ছিল, জামায়াত-বিএনপির সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানো। আর মৌলবাদী সন্ত্রাসীর আড়ালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যা করা। এছাড়াও ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্টাইলে দেশের প্রগতিশীল শিক্ষক, বৃদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, বিচারক, পেশাজীবী, সংস্কৃতি কর্মীদের হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য থেকে দেশকে পাকিস্তানিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া।
জেএমবির মজলিসে শুরার হাফেজ মাহমুদ দেশব্যাপী বোমা হামলার ঘটনায় আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে জেতাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল জেএমবির ক্যাডাররা। বিএনপির পক্ষ থেকেও ক্যাডারভিত্তিক সাহায্য চাওয়া হয়েছিল তাদের কাছে।
২০০৫ সালের ২৩ আগস্টের পত্রিকায় গোয়েন্দাদের বরাতে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের সময়টাতে কমপক্ষে ১৪টি ভিন্নধারার উগ্রবাদী সংগঠনের ছদ্মবেশে দেশে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে জামায়াত। জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় ও শিবিরের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই সারাদেশে বিস্তার লাভ করেছে উগ্রবাদি জঙ্গিরা। এরপর জামায়াত-শিবিরের শক্তিতে ভর করেই সশস্ত্র তৎপরতা চালায় তারা। আধুনিক সমরাস্ত্রসহ একটি বড় জঙ্গিদলকে গ্রেফতারের পরেও সরকারে থাকা জামায়াত নেতাদের চাপে ওই জঙ্গিদের ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে চার্জশিট না দিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।
বাংলা ভাই জেএমবির কার্যক্রম শুরু করে জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজশাহীতে জামায়াত নেতার বাড়িতে বসেই শুরু হয়। ২০০৪ সালের ৩০মে রাজশাহীর বাগমারার আলোকনগর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার রমজান কায়ার বাড়িতে প্রথম ঘাঁটি গড়ে বাংলা ভাই। এরপর তার ছাত্র জীবনের শিবিরের বন্ধু রফিকের বাড়িতেও আরেকটি বৈঠকখানা করে সে। ২০০৫ সালের জুন মাসে গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রফিক জানায়, জামায়াত-শিবিরের ওপর ভর করেই মাঠপর্যায়ে কাজ করেছে তারা। রফিকের মাও জানান, জামায়াত-শিবিরকে সঙ্গে নিয়েই সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলতো বাংলা ভাই। রাজশাহী মহানগরের এক জামায়াত নেতা পরের নির্বাচনে এমপি ভোট করার থাকায়, তাকে জেতাতে বাগমারার একটি ক্লিনিকে আস্তানা গড়ে বাংলা ভাই। পরবর্তীতে ভবানীগঞ্জের সেই ক্লিনিকের মালিক ড. বারী তার সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততা আছে স্বীকার করে।
এমনকি দেশজুড়ে জঙ্গি কার্যক্রমের অন্যতম হোতা, বাংলা ভাইয়ের সহকারী ও বোমা বিশেষজ্ঞ আসাদুল্লাহ গালিব রাজশাহীতে ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করার সময় তার সঙ্গে উপস্থিত থাকতের খুলনার জামায়াত দলীয় এমপি আবদুল খালেক ও রাজশাহী সিটির মেয়র মিজানুর রহমান মিনু। এসময় বিএনপি-জামায়াতের এসব শীর্ষ নেতারা গালিব ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে জঙ্গি তৎপরতার কোন সম্পর্ক নাই বলে সার্টিফিকেট প্রদান করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যে কতো অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, তা স্পষ্ট হয় তাদের সরকারি দায়িত্বে থাকা শীর্ষ নেতাদের এরকম উদ্ধত কর্মকাণ্ডে।
২০০৫ সালের ২৩ জুলাইয়ের খবরে পুলিশের বরাতে জানা যায়, রাজশাহী থেকে গ্রেফতার বাংলা ভাইয়ের অনুগত ১১ জেএমবি জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর তারা তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিএনপি সরকারের প্রধান জোটসঙ্গী জামায়াতের নাম বলেছে। এছাড়াও বাংলা ভাইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান ও সৌদি আরব থেকে তাদের অর্থের সংস্থান হয় বলেও জানায় তারা। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলের সদস্যরা এসব তথ্য জানার পর হতবাক হয়ে যায়।
২০০৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিস্ট ব্রাঞ্চের তদন্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদী জঙ্গিদের তৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়। ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের অদৃশ্য পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাইসহ এসব জঙ্গিরা নাশকতা পরিচালনা করে তদন্ত প্রতিবেদনে জানায় তারা। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চার সদস্যের টিম বাংলাদেশে সরেজমিনে তদন্তের পর এই প্রতিবেদন দেয়। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরীর ওপর সিলেটের মাজারে বোমা হামলার ঘটনা তদন্ত করতে এসে তারা এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে।
২০০৫ সালের ২ অক্টোবর জনকণ্ঠের সংবাদে দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াত সরকারের শাসনামলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলের জঙ্গিবাদী নেটওয়ার্ক পরিচালনা হতো বগুড়া থেকে। বগুড়ায় তারেক রহমানের নিয়মিত যাতায়াত থাকায় সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম তারেককে প্রটোকল দেওয়ার মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ায় এবং সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা-নির্যাতন করার জন্য উগ্রবাদি জঙ্গীদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে বগুড়া। গাবতলী, কাহালু, নন্দীগ্রাম, সারিয়াকান্দি, শেরপুরের বিভিন্ন চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত গ্রামে জেএমবির জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এছাড়াও বগুড়ার উপকণ্ঠে বিভিন্ন মেস ও বাড়িতে ছদ্মবেশে সারাদেশ থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের ক্যাডাররা এসে আশ্রয় নেয়। পুলিশ জানায়, ক্লিন শেভ ও বেশভূষা পরিবর্তন করে জঙ্গিরা অবস্থান করায় তাদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের খবর থেকে জানা যায়, বগুড়ায় বাংলা ভাইয়ের বাড়িকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি নেটওয়ার্ক পরিচালিত হয়। বিশেষ করে গাবতলীর কয়েকটি গ্রাম, একটি হাটের পাথার ও প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে এসব জঙ্গিদের ট্রেনিং, বোমা বানানোর স্কোয়াড, মহিলা ক্যাডার তৈরির মূল কার্যক্রম চালানো হতো। গাবতলীর গোলাবাড়ি থেকে গ্রেফতার জঙ্গি ক্যাডার রাজ্জাক ওরফে হাসান এসব তথ্য জানায়। রাজ্জাক জানায়, ১৭ আগস্ট বগুড়ার বোমা হামলার পর সেসহ আরো কয়েকজন জঙ্গি রিকশা চালকের ছদ্মবেশে অংশ নিয়েছিল।
যেভাবে খুনি ও বোমাবাজ জঙ্গিদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে বিএনপি-জামায়াত সরকার:
২০০৬ সালের ২ এপ্রিলের জনকণ্ঠ পত্রিকার সংবাদে দেখা যায়, দেশে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সন্ত্রাসীদের পরিবারের অধিকাংশই জামায়াত ও জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিএনপির এমপি-মন্ত্রীরা নাশকতামূলক কার্মকাণ্ড ও আওয়ামী লীগ দমনের জন্য সরাসরি এই জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কক্সবাজার সদর আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মো. শহীদুজ্জামানের উপস্থিতিতে বিএনপির সভায় জেএমবির ক্যাডার জাবেদ ইকবাল ওরফে মুহাম্মদের মুক্তির জন্য দোয়া করা হয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা, বিচারপতি হত্যা এবং চট্টগ্রাম আদালতে বোমা হামলার প্রধান আসামি এই জাবেদ ওরফে মুহাম্মদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় জেমবির কমান্ডার। তার পিতা জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নেতা মাওলানা আবদুল আউয়াল।
২০০৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির সংবাদে দেখা যায়, জঙ্গি সংগঠন জেএমবির নেতারা ছাত্রজীবনে শিবিরের নেতা ছিল। এমনকি অনেক শীর্ষ জঙ্গির পিতা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও আল বদর বাহিনীর কমান্ডার। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সঙ্গে তাদের সথ্য গড়ে ওঠে। ১৭ আগস্ট গোপালগঞ্জে বোমা হামলার হোতা জিয়াউর রহমান ওরফে সাব্বির ওরফে সাগরের ঘটনাটিও তেমন। এই সাগরের বাড়ি নাটোর জেলার শাইলকোন গ্রামে। মাদ্রাসার ছাত্র থাকাকালে সে ছাত্রশিবিরের সাথী ছিল। পরবর্তীতে সে জেএমবিতে যোগ দেয় এবং গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার দায়িত্ব পায়।
২০০৬ সালের ১১ মার্চের সংবাদে দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াত সরকারের নির্দেশে প্রশাসনের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতাতেই রাজশাহী-নওগাঁর বিস্তৃত অঞ্চলে নৃশংস সন্ত্রাস চালায় বাংলা ভাইয়ের জঙ্গিরা। জেএমবির দুই শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমান প্রকাশ্যে বিএনপির এমপির বাসা, ইউপি চেয়ারম্যানের অফিস, সরকারি দফতর এবং অফিস-আদালতে গিয়ে বৈঠক করতো। ২০০৪ সালে রাজশাহীর বাগমারা ও নওগাঁর রানীনগর ইউপি ভবনে বসে প্রকাশ্যে নাশকতার পরিকল্পনা করে শীর্ষ জঙ্গিরা। এসব বৈঠকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত থাকতো। দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমে ছবিসব এসব বৈঠকের সংবাদ ছাপা হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার সরকার এসব দেখেও না দেখার ভান করে জঙ্গিবাদকে উস্কে দিয়েছিল।
এমনকি ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী জেএমবির হামলার পর বিএনপি নেতার বাড়িতে গোপন আশ্রয় দেওয়া হয় বাংলা ভাইকে। এসময় জেএমবিকে জামায়াতের সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাবও দিয়েছিল জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। কিন্তু জেএমবির সদস্যরা স্বাধীনভাবে কর্ম পরিচালনার উদ্দেশ্যে এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তবে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আগের মতোই ভবিষ্যতেও তারা জঙ্গিবাদি কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করে। এছাড়াও বিভিন্ন অপারেশনে জামায়াত-শিবির এবং জেএমবির ক্যাডাররা যৌথভাবে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে সহমত হয়।
জামায়াতের সঙ্গে জেএমবির ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা প্রকাশের পর বিএনপির সঙ্গেও তাদের গোপন আঁতাত কোনোভাবেই গোপন রাখা সম্ভব ছিল না। নির্যাতন, হত্যা ও লুটের শিকার পরিবারগুলো সরাসরি বিএনপি-জামায়াত সরকারের ছত্রছায়ায় জেএমবি ও বাংলা ভাইয়ের সন্ত্রাস পরিচালনার তথ্য ফাঁস করে দিতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই খালেদা জিয়ার তিন মন্ত্রী, এক এমপি এবং রাজশাহীর মেয়রের নাম উঠে আসে। নওগাঁর রাণীনগর ও ভোপাড়ার ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বিএনপি নেতা ও প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির তাদের নামে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে তা বাস্তবায়নের জন্য জঙ্গিদের লেলিয়ে দিয়েছিল।
২০০৬ সালের ১৫ জুনের সংবাদে দেখা যায়, খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে নওগাঁ অঞ্চলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালায় জেএমবির জঙ্গিরা। এমনকি আত্রাই-রানীনগরের সংখ্যালঘু যুবকদের ভয় দেখিয়ে নিয়মিত চাঁদাবাজি করে তারা। এসব নির্যাতনের ঘটনা ও একজন সাবেক সেনাসদস্যকে হত্যার ঘটনায় জেএমবি সন্ত্রাসী রুস্তমের বিরুদ্ধে মামলা হলেও প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্থানীয়রা জানান, প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সথ্যের কারণে জঙ্গিনেতা শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা আবদুল আউয়াল ১৭ আগস্টের বোমা হামলার পর দীর্ঘদিন আত্রাইয়ের ভরতেতুলিয়া গ্রামে রুস্তমের চাচা খলিলুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয়ে ছিল। রুস্তম ও তার চাচাতো ভাই মোয়াজ্জেম প্রতিমন্ত্রীর সরাসরি শেল্টারে জেএমবির কার্যক্রম চালিয়ে যায় পরে।
২০০৫ সালের ৮ এপ্রিলের খবরে দেখা যায়, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে বোমাবাজ জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের হরকত উল জিহাদের সদস্যদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বিএনপি নেতাদের সরাসরি নেতৃত্বে। বিএনপি নেতা মাওলানা আবদুল খালেকের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন থেকে জঙ্গিদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছিল বলে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন মোড়েলগঞ্জ থানা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক খান আলতাফ হোসেন ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শামছুল আলম তালুকদার।
২০০৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বরের সংবাদ জানায়, সারাদেশে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত খুলনা অঞ্চলের জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসী শোয়ের ওরফে রিপনের পিতা মাওলানা আব্দুল ওহাব হলেন জামায়াতের শীর্ষ নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর আধ্যাত্মিক গুরু, বুলবুলে বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে জামায়াতের মতাদর্শ প্রচার করতেন তিনি। সেই সূত্রে গুরু ওহাবের পুত্র শোয়েবের সঙ্গে নিজের পিরোজপুরের এক আত্মীয়ার বিয়ে দেন দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। দিনে জনযুদ্ধের কমান্ডার হিসেবে থাকলেও রাতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করতো এই শোয়েব। জনযুদ্ধের খুলনা অঞ্চলের অন্য নেতারা জানান, শোয়েবের দুই ভাই সুমন ও কামরুলও এই জঙ্গিবাদী হামলার সঙ্গে জড়িত। কামরুলকে র্যাব গ্রেফতার করলেও সাঈদীর সরাসরি সুপারিশে স্বয়ং খালেদা জিয়ার নির্দেশে মুক্তি দেওয়া হয় তাকে।
২০০৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদে দেখা যায়, জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী নিধনের অংশ হিসেবে রাজশাহীর বাগমারায় ২২ জন ব্যক্তিকে হত্যা করে বাংলা ভাইয়ের জঙ্গি বাহিনী, গুম করে ১০ জনকে, অমানুষিক নির্যাতনে আহত ও পঙ্গু হয় শতাধিক। এমনকি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় সহস্রাধিক মানুষ। নওগাঁর রানীনগরের আবদুল কাইয়ুম বাদশাকে হত্যার পর বগুড়ার নন্দীগ্রামে নিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা এবং মায়ের সামনে আত্রাইয়ের ছাত্রলীগ নেতা খেজুর আলীকে চার টুকরো করে পুঁতে ফেলার ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশের পরও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলা ভাইকে নির্দোষ এবং সরকার সমর্থিত টেলিভিশনে তাকে শান্তির দূত বলে দাবি করেছে।
বাংলা ভাইয়ের সহকারী ড. গালিব এবং তার ভাগ্নে বোমারু মহসীন তিন বছরের বেশি সময় ধরে রাজশাহী অঞ্চলের মসজিদকেন্দ্রিক জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটালেও কখনো তাদের গ্রেফতার করেনি পুলিশ। উল্টো বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতা এমপি-মন্ত্রী-মেয়রেরা তাদের ক্লিনচিট দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান চালানো থেকে নিবৃত রেখেছে। এমনকি ২০০৪ সাল থেকে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার আলোকনগর গ্রামে রাজাকার রমজান আলীর বাড়িতে ঘাঁটি গড়ে টর্চার সেল পরিচালনা করে বাংলা ভাই। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে সর্বহারা বলে অপবাদ দিয়ে চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। জামায়াত অধ্যূষিত সেই গ্রামে জেএমবির ৬০-৭০ ক্যাডার মিলে বাংলা ভাইয়ের সেই বাড়ির প্রহরীর কাজ করতো। সেখানে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল পলাশ গ্রামের বাবু নামের এক যুবককে ধরে নিয়ে নিজের হাতে প্রকাশ্যে জবাই করে বাংলা ভাই। এরপর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত এভাবেই প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় ২২ জনকে। কপিকলে উল্টো করে বেঁধে মানুষকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হতো, মাইকে সেই আর্তনাদ শোনানো হতো গ্রামবাসীকে। মারা যাওয়ার পর আলোগনগর গ্রামের মাঠে ফেলে রাখা হতো সেই লাশ। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য শেখ ফরিদকে পিটিয়ে হত্যা- এসব ঘটনা নিয়মিত পত্রিকায় এলেও খালেদা জিয়ার সরকার বাংলা ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর ও ৪ অক্টোবরের পত্রিকার খবরে জানা যায়- গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৫ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা, উদীচী, রমনা বটমূল, ১৭ আগস্টের দেশব্যাপী বোমা হামলার ঘটনায় নিষিদ্ধ হরকত-উল-জিহাদের প্রধান মুফতি হান্নানকে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করলে, তা নিয়ে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে বিএনপি-জামায়াতের এমপি-মন্ত্রীরা। কোটালিপাড়া থানা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মতিয়ার রহমান মতির ভাই ও নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকত উল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানকে নিতান্তই সরজ-সরল মানুষ বলে দাবি করে। এমনকি বিএনপির সংসদ সদস্যরা দাবি করেন যে, আওয়ামী লীগ নিজেরাই বোমা পুঁতে রেখে নিস্পাপ হরকত উল জিহাদের ওপর চাপাচ্ছে! অথচ আটকের পর তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হান্নান জোট সরকারের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা জানায়।
হান্নানকে আটকের পর তাৎক্ষণিকভাবে র্যাব জানায়, জঙ্গি হান্নান ১৭ আগস্ট বোমা হামলার পরেও দেশ ছেড়ে না পালানোর কারণ হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা বলেছে। জোট সরকারের অন্যতম শরিক ও ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা মুহিউদ্দিন খান তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আলতাফ চৌধুরী তখন ক্ষমা প্রার্থনার জন্য দরখাস্ত দেওয়ার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামি মুফতি হান্নান ক্ষমা চেয়ে আবেদন করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কার্যালয় এবং তারেক রহমানের হাওয়াভবনে মুফতি হান্নানের পক্ষে সুপারিশ করেন বিএনপির প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির, উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা, রাজশাহীর মেয়র মিজানুর রহমান মিনু। গ্রেফতারের পর সাংবাদিকদের সামনে মুফতি হান্নান এসব তথ্য প্রকাশ করায় জঙ্গিবাদের সঙ্গে খালেদা জিয়া সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতার তথ্য জনগণের সামনে চলে আসে।
১ অক্টোবর আটকের পর মুফতি হান্নান আরো জানায়, হরকত উল জিহাদের জঙ্গি নেতারা জেএমবির সঙ্গে মিলে একসঙ্গে অপারেশন পরিচালনা করতো। তারা ধীরে ধীরে জেএমবিতে যোগ দেয়।
২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের পত্রিকায় জানা যায়- শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাকারী, রমনা বটমূল, উদীচী ও সারাদেশে বোমা হামলার অন্যতম হোতা মুফতি হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। তার ভাই মতিয়ার রহমান মতি কোটালিপাড়া থানা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা। বিএনপি নেতা এই ভাইয়ের মাধ্যমে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার নির্দেশনা গ্রহণ এবং কোনো অপারেশন শেষ করার পর তাদের কাছে রিপোর্ট পেশ করতো মুফতি হান্নান।
প্রকাশ্যে হত্যাযজ্ঞ-লুটপাট-ধর্ষণকারী জঙ্গিদের বাঁচাতে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মরিয়া প্রচেষ্টা:
২০০৫ সালের ৭ অক্টোবরের খবর থেকে জানা যায়- শেখ হাসিনাকে বোমা মেরে হত্যাচেষ্টাকারী জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানের বিচার স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর সুপারিশ করেন খালেদা জিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও প্রভাবশালী বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবতী, গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুর রহমান নান্টু এ সিনিয়র সহসভাপতি মনিরুজ্জামান পিনু। তারা সুপারিশে জানান, হান্নান একজন বিএনপি পরিবারের সন্তান। সে কোটালিপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চায়নি। অথচ ১ অক্টোবর র্যাবের হাতে আটকের পর তাৎক্ষণিকভাবে মুফতি হান্নান নিজেই গণমাধ্যমের সামনে তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে। এমনকি এই ঘটনার যারা জড়িত তাদের নামও বলে দেয়।
২০০৫ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জনকণ্ঠে দেখা যায়, চরমপন্থী ক্যাডার লাকীকে গ্রেফতারের পরেও ধরে রাখতে পারেনি পুলিশ। কারণ প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের নির্দেশে তার বাহিনীর লোকেরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে লাকীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। মূলত, জাতীয় নির্বাচনে লাকীর বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে রানীনগরের বিশাল এলাকার ভেআটকেন্দ্র দখলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য লাকীকে মুক্ত করেন তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বিএনপি নেতা আলমগীর কবির। জেএমবি এবঙ সর্বহারাদের মধ্যে গোপন সমঝোতা করে তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে ভোটে জেতার নীল নকশা করেছিল এই বিএনপি নেতা। সাধারণ মানুষের মনে ভীতি ছড়ানোর জন্য তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী লাকীকে গাড়িতে নিয়ে আত্রাই-রানীনগরের নিজের নির্বাচনি এলাকা ঘুরতেন তিনি।
২০০৫ সালের ২ অক্টোবরের আরেকটি খবরে দেখা যায়, নওগাঁর রানীনগর উপজেলার দেউলা গ্রামে বাংলা ভাইয়ের ক্যাডার গোবরার হাতে ধর্ষণের শিকার হয় স্থানীয় এক গৃহবধূ। কিন্তু বাংলা ভাইয়ের অন্য ক্যাডার শহীদুল ও মান্নানের সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের সুসম্পর্ক থাকায় তারা ধর্ষক গোবরাকে গ্রেফতার না করার জন্য থানাকে চাপ দেয়।
২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের পত্রিকায় আরো দেখা যায়, জঙ্গিদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে উগ্রবাদী জঙ্গিরা দেশের ৪টি আদালতে হামলা চালায়। চট্টগ্রাম, লক্ষীপুর, রংপুর ও চাঁদপুরের আদালতে তাদের বোমার আঘাতে মারা যান ২ জন, বিচারকসহ আহত হন অর্ধশত ব্যক্তি। এই ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও তারেক রহমানের ডান হাত বলে পরিচিত বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর বলেন, এমন আশঙ্কাই করেছিলাম!
২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সংবাদে জানা যায়, দেশজুড়ে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পর্ক এতোটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে- কোথাও জঙ্গি ধরা পড়লে এমপি সরাসরি ফোন দিয়েও সেই জঙ্গিকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। সরকারি অফিসে চাঁদাবাজি, স্কুলে বোমা রাখা প্রভৃতি বিষয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে জামালপুরের সড়িষাবাড়ী উপজেলায় জঙ্গি ধরতে যায় পুলিশ। তখন স্থানীয় এমপি ও প্রভাবশালী বিএনপি নেতারা অভিযান চালাতে নিষেধ করে। তারা পুলিশকে বলেন- কোনো জঙ্গি ধরা যাবে না, তাদের এলাকায় কোনো জঙ্গি নেই।
১৬ সেপ্টেম্বর এক চমকপ্রদ সংবাদ প্রকাশ হয় দৈনিক জনকণ্ঠে। দেখা যায়, জাতীয় সংসদ ভবনে প্রবেশের সময় দুই জঙ্গিকে আটক করেছিল পুলিশ। তবে তাদের আটকের খবর প্রকাশ হওয়ার পরপরই তাদের ছাড়াতে স্পিকারকে ফোন করেন জামায়াতের এমপিরা। মধ্যরাতে তারা জামায়াতের এক এমপির সঙ্গে দেখা করার জন্য সংসদ ভবনের আবাসিক অঞ্চলে প্রবেশ করছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায় আটক দুই জঙ্গি। এরপর সেই রাত ও পরের দিনভর আলী আহসান মুজাহিদ ও মতিউর রহমান নিজামী দুই জঙ্গিকে ছাড়ানোর জন্য বিভিন্ন স্তানে ফোন দেয়। একপর্যায়ে স্পিকারকেও চাপ দিয়েছিল বলে স্পিকার জমিরউদ্দীন সরকার সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন। পরে অবশ্য সেখান থেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হয়ে সেদিনই আদালতের মাধ্যমে দুই জঙ্গিকে জামিনে ছাড়িয়ে নেন জামায়াতের এমপিরা।
১৭ জুলাইয়ের সংবাদ থেকে জানা যায়, নওগাঁয় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যের পুত্র আওয়ামী লীগ কর্মী জিয়াউল হককে হত্যা করে বাংলা ভাইয়ের ক্যাডার শরিয়তুল্লাহ সীমার। কিন্তু খালেদা জিয়ার প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের নির্দেশে পুলিশ চার্জশিট থেকে তার নাম গোপনে বাদ দিয়ে দেয়। রানীনগর থানার ওসি মোহসীনুল হক এই তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেন সাংবাদিকদের কাছে। স্থানীয়রা এই ঘটনার পর জঙ্গিদের গডফাদার বিএনপি নেতা আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলো ধিক্কার জানায়।
১৭ সেপ্টেম্বরের খবরে দেখা যায়, ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলার পর জেএমবির জঙ্গিদের আত্মগোপনে সহায়তা করে জামায়াত-শিবির। কেন্দ্রীয়ভাবে তারা যেমন অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য আইনশৃঙ্খরা বাহিনীকে প্রভাবিত করা, আদালতে হামলা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে সুপারিশ করে; তেমনি স্থানীয়ভাবেও জামায়াত নেতাদের বাড়িতে জঙ্গিদের গোপনে আশ্রয় দেওয়ার নির্দেশনা জারি করে। এরকম পরিস্থিতিতে, রাজশাহীতে জামায়াত নেতা মেছের উল্লার বাড়ি থেকে গভীর রাতে জেএমবির দুই আঞ্চলিক শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শায়খ আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ এই দুই শীর্ষ জঙ্গির নাম- চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেএমবি কমান্ডার শহীদুল্লাহ ও তার সহযোগী তুফান। এসময় তাদের সাথে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, অস্ত্র ও বোমা পাওয়া যায়। পুলিশ জানায়, ১৩ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সেখান থেকে জেএমবির জঙ্গি মহব্বত আলী গ্রেফতার করে। এরপর তার দেওয়া তথ্য অনুসারে রাজশাহীর তানোর থানার পুলিশ জানতে পারে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেএমবির কমান্ডার শহীদুল্লাহর বাড়ি তানোরের চাঁনপুর গ্রামে। এরপর সোর্সের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে পুলিশ জানতে পারে, সেখানকার স্থানীয় প্রভাবশালী জামায়াত নেতা মেছের উল্লাহর বাড়িতে অবস্থান করছে জঙ্গিরা। পরে মধ্যরাতে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।
২০০৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সংবাদে পুলিশের বরাতে জানা যায়, আড়াই বছরে তিন শতাধিক উগ্রবাদি জঙ্গিকে অবৈধ বোমা-অস্ত্র-দলিল-দস্তাবেজসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে সব প্রমাণ থাকার পরেও তারা পরে অজ্ঞাত কারণে ছাড়া পেয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এসব জঙ্গিদের কৌশলে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এবিষয়ে কোনো পুলিশ সদস্য আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা আরো জানান, রাজশাহী এলাকা থেকে বাংলা ভাইয়ের ৬২ জন ক্যাডার, উত্তরাঞ্চল থেকে জেএমবির ৫৯ জন জঙ্গি, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লা থেকে হিযবুতের ২২ জনকে, ফদিরপুর থেকে ১৮ জনকে; এছাড়াও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনা, বগুড়া, গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরো দুই শতাধিক জঙ্গিকে আটক করে পুলিশ। তবে তাদের কাউকেই ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তেলেসমাতিতে বাংলা ভাইয়ের ৬২ জন জঙ্গির সবাই খুব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বের হয়ে যায়, যা যে কোন আইনি প্রক্রিয়ার জন্য এক ব্যতিক্রম ঘটনা।
২০০৫ সালের ১৯ মার্চের খবরে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যার পর জঙ্গিরা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে রাতভর বৈঠক করে তাদের আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত করার দেনদরবার করতো। নওগাঁর প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের মাস্টারপাড়ার বাসভবনে তার ভাই আনোয়ার হোসেন বুলু ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে জেএমবির কমান্ডার ও জঙ্গিবাদী নেতা ড. গালিবের অনুসারীরা। হত্যা, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী মামলার এই দুর্ধর্ষ আসামিরা ১৮ মার্চ রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত সেখানে বৈঠক করে। বাংলা ভাইয়ের ক্যাডার ও আওয়ামী লীগ কর্মী জিয়া হত্যার মূল দুই হোতা মোস্তাফিজুর রহমান খাজা ও শরিয়তুল্লাহ সীমার, আবদুস সালাম; একডালা ইউপি বিএনপির সভাপতি মোহন চেয়ারম্যান, সহসভাপতি আজিজার রহমান, সাধারণ সম্পাদক আকবর মেম্বার। এ ব্যাপারে পুলিশ জানায়, সরকার সমর্থিত ব্যক্তি ও স্থানীয় গজফাদারদের শরণাপন্ন হওয়ায় জঙ্গিরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করে ত্রাস ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে।
২০০৫ সালের ২০ আগস্টের খবরে দেখা যায়, ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর চাঙ্গা হয়ে ওঠে জেএমবির জঙ্গিরা। এরপর উত্তরাঞ্চলের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার মন্ত্রী আলমগীর কবিরের সঙ্গে বৈঠকে বসে তারা। এমনকি রাজশাহীর পুলিশে কমিশনার নূর মোহাম্মদ বাংলা ভাইয়ের হাতে ১৭ হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ চান, কিন্তু সেই ১৭ খুনের দায়িত্ব কে নেবে বলে পুলিশের কাছে জানতে চান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আমিনুল হক এবং প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির। এর জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, যারা এসব খুনের নির্দেশ দিয়েছেন তারাই দায়িত্ব নেবেন। এরপরেই বাংলা ভাইকে ধরার অভিযান থেকে বিরত করা হয় পুলিশের ডিআইজি নূর মোহাম্মদকে।
শিবির পরিচয়ে জঙ্গিদের মুক্তি দিতো সরকার, নাশকতা চালাতে স্থানীয় সাহযোগিতা দিতো জামায়াত:
২০০৫ সালের ২১ মার্চের খবরে জানা যায়, ২০০৬ সালের শেষের দিকে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বোমা, সন্ত্রাস ও হত্যা মামলা থেকে সন্ত্রাসীদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণারয়। আর বোমা বিস্ফোরণ ও জঙ্গিবাদী মামলাগুলোর অপমৃত্যু ঘটানো হয়। চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের এভাবে মুক্ত করে দেওয়ার ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থা ক্ষুব্ধ হয়। এমনকি এসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের গ্রেফতারে সম্পৃক্ত গোয়েন্দাদের অনেকের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, চাঞ্চল্যকর এসব মামলা থেকে যারা রেহাই পাচ্চে তারা অধিকাংশই জঙ্গি সংগঠনের সদস্য এবং শিবিরের নেতা-কর্মীর সংখ্যাই বেশি।
২০০৫ সালের ২০ আগস্টের পত্রিকায় দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে জামায়াতের প্রভাবশালী স্থানীয় নেতাদের বাড়িতে বোমা তৈরির কারখানা বসানো হয় এবং শিবিরের নেতাকর্মীরা বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে হাতবোমা তৈরি করতো। এসব ঘটনায় রাজশাহীতে ৯টি কারখানায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটলেও কোনোটিরই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পবা উপজেলায় জামায়াত নেতার বাড়িতে বোমা বানোর সময় বিস্ফোরণে দুই ক্যাডার শুকুর ও জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হরেও রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার করে নেয় খালেদা জিয়ার সরকার। এছাড়াও বহরমপুর এলাকায় বোমা বানাতে গিয়ে শিবির নেতা মনিরুলের বিস্ফোরণ, মেহেরচণ্ডি গ্রামে বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণ, কাঁকনহাট ও নারিকেলবাড়িয়ায় বোমা বানানোর সময় জামায়াত নেতাদের বাড়িতে বিস্ফোরণে শিবির ক্যাডারদের মৃত্যু, দারুসা বাজার সংলগ্ন জামায়াত নেতা ড. মোজাম্মেল হকের বাড়িতে বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণে চার জন শিবির ক্যাডার আহত। এবং আহতরা হাসপাতালে পুলিশকে জানান, বোমা বানানোর সময় এই বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে পরবর্তীতে এসব ঘটনা চাপা দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং জড়িতদের ছেড়ে দেওয়া হয় বিএনপি-জামায়াত হাইকমান্ডের নির্দেশে।
২০০৫ সালের ২৩ আগস্টের পত্রিকায় গোয়েন্দাদের বরাতে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের সময়টাতে কমপক্ষে ১৪টি ভিন্নধারার উগ্রবাদী সংগঠনের ছদ্মবেশে দেশে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে জামায়াত। জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় ও শিবিরের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই সারাদেশে বিস্তার লাভ করেছে উগ্রবাদি জঙ্গিরা। এরপর জামায়াত-শিবিরের শক্তিতে ভর করেই সশস্ত্র তৎপরতা চালায় তারা। আধুনিক সমরাস্ত্রসহ একটি বড় জঙ্গিদলকে গ্রেফতারের পরেও সরকারে থাকা জামায়াত নেতাদের চাপে ওই জঙ্গিদের ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে চার্জশিচ না দিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।
২০০৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদে দেখা যায়, জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী নিধনের অংশ হিসেবে রাজশাহীর বাগমারায় ২২ জন ব্যক্তিকে হত্যা করে বাংলা ভাইয়ের জঙ্গি বাহিনী, গুম করে ১০ জনকে, অমানুষিক নির্যাতনে আহত ও পঙ্গু হয় শতাধিক। এমনকি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় সহস্রাধিক মানুষ। নওগাঁর রানীনগরের আবদুল কাইয়ুম বাদশাকে হত্যার পর বগুড়ার নন্দীগ্রামে নিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা এবং মায়ের সামনে আত্রাইয়ের ছাত্রলীগ নেতা খেজুর আলীকে চার টুকরো করে পুঁতে ফেলার ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশের পরও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলা ভাইকে নির্দোষ এবং সরকার সমর্থিত টেলিভিশনে তাকে শান্তির দূত বলে দাবি করেছে।
বাংলা ভাইয়ের সহকারী ড. গালিব এবং তার ভাগ্নে বোমারু মহসীন তিন বছরের বেশি সময় ধরে রাজশাহী অঞ্চলের মসজিদকেন্দ্রিক জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটালেও কখনো তাদের গ্রেফতার করেনি পুলিশ। উল্টো বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতা এমপি-মন্ত্রী-মেয়রেরা তাদের ক্লিনচিট দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান চালানো থেকে নিবৃত রেখেছে। এমনকি ২০০৪ সাল থেকে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার আলোকনগর গ্রামে রাজাকার রমজান আলীর বাড়িতে ঘাঁটি গড়ে টর্চার সেল পরিচালনা করে বাংলা ভাই। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে সর্বহারা বলে অপবাদ দিয়ে চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। জামায়াত অধ্যূষিত সেই গ্রামে জেএমবির ৬০-৭০ ক্যাডার মিলে বাংলা ভাইয়ের সেই বাড়ির প্রহরীর কাজ করতো। সেখানে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল পলাশ গ্রামের বাবু নামের এক যুবককে ধরে নিয়ে নিজের হাতে প্রকাশ্যে জবাই করে বাংলা ভাই। এরপর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত এভাবেই প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় ২২ জনকে। কপিকলে উল্টো করে বেঁধে মানুষকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হতো, মাইকে সেই আর্তনাদ শোনানো হতো গ্রামবাসীকে। মারা যাওয়ার পর আলোগনগর গ্রামের মাঠে ফেলে রাখা হতো সেই লাশ। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য শেখ ফরিদকে পিটিয়ে হত্যা- এসব ঘটনা নিয়মিত পত্রিকায় এলেও খালেদা জিয়ার সরকার বাংলা ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পত্রিকার প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে জানা যায়, সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অপারেশন পরিচালনা করতো জেএমবি, হরকতসহ জঙ্গি সংগঠনগুলো। জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমানের পিতা রাজাকার আবুল ফজল মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালপুরের আল বদর কমান্ডার এবং পরে কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতা ছিল, সেই সূত্রে শায়খ নিজেও স্বাধীনতার পর ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা হয়। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে দীর্ঘ পারিবারির ও সাংগঠনিক সম্পর্ক থাকায় জামায়াতের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান। শায়খের ছোটভাই জেএমবির অপারেশনাল কমান্ডার আতাউর রহমান সানিও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সাংগঠনিক নেতা এবং সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই আজিজুল হক কলেজে অধ্যয়নকালে শিবিরের ক্যাডার থাকায় তাদের মাধ্যমে দেশজুড়ে শিবির নেতাদের সহযোগিতা পেত এই জঙ্গি সংগঠনটি। এছাড়াও শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টারী মুফতি হান্নানের ভাই মতিউর রহমান মতি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া বিএনপির প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল জঙ্গি হান্নান।
বাঙালির মুক্তির ইতিহাস ঐতিহ্যের ওপর জঙ্গি হামলা এবং বিএনপি-জামায়াতের হিংস্র থাবা:
২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির সংবাদে দেখা যায়, মহান একুশে পালনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তাণ্ডব চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা। কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার অজুহাতে সাধারণ মানুষদের শহিদ মিনারে যেতে দেয়নি। নীলফামারীতে শহিদ মিনার গুড়িয়ে দিয়েছে জিয়া পরিষদেন নেতাকর্মীরা। নোয়াখালীতে মাইক কেড়ে নিয়ে উগ্রবাদী বক্তব্য দেয় সন্ত্রাসীরা। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় প্রশাসনের প্রভাতফেরিতেও বাধা দেয় বিএনপির ক্যাডাররা। খুলনায় পুলিশি বাধার মুখে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।
২০০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির খবরে জানা যায়, ফরিদপুর জেলার নগরকান্দায় ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে এলাকাবাসীর তৈরি করা অস্থায়ী শহিদ মিনার ভেঙে ফেলেছে জামায়াত নেতারা। ফলে ২০০৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারেনি এলাকাবাসী। একুশের প্রভাতে শিক্ষার্থীরা ও এলাকাবাসী ফুল দেওয়ার জন্য গিয়ে দেখে যে শহিদ মিনারটি নেই। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নস্যাৎ করার জন্য জামায়াতের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তখন সহযোগিতা করেছে বিএনপি নেতারা। এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও বিএনপি সরকার এসব করার জন্য মদত দিয়েছে জামায়াতকে।
২০০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির খবরে আরো জানা যায়, জামায়াতকে খুশি করার জন্য নাটোরে ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহিদদের স্মরণে কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে দেয়নি বিএনপি। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ফজলুল হক পটলের এলাকা নাটোরের লালপুরে বিএনপি নিজেও অমর একুশে পালন করেনি, এমনকি বিএনপির অফিসেও ওড়েনি অর্ধনমিত জাতীয় পতাকা।
২০০৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির খবরে জানা যায়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একুশের সঙ্গীতের পরিবর্তে সমবেতভাবে শিবিরের দলীয় গান গেয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করেছে ছাত্রশিবির। অমর একুশে পালনের নামে তারা জাতীয় পতাকার অবমাননা এবং রাজাকার প্রধান গোলাম আযমকে একুশে পদক দেওয়ার দাবিতে ক্যাম্পাসে শোভাযাত্রা ও হৈহুল্লোড় করে গণউৎপাত সৃষ্টি করে। লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে বহিরাগতদের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে শো-ডাউন দেয় ছাত্রশিবির, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকেরা ভয়ে আতঙ্কিত হয় এবং মহান একুশের ভাবগাম্ভীর্য ভূলুণ্ঠিত হয়।
২০০৫ সালের ২৩ আগস্টের পত্রিকায় গোয়েন্দাদের বরাতে জানা যায়, ২০০৪ সালে দেশের চার জেলায় বাংলা ভাইয়ের ক্যাডারদের হাতে আওয়ামী লীগ ও সমমনা প্রায় ১৭ ব্যক্তি খুন ও শত শত মানুষ নির্যাতনের শিকার হলে দেশের গণমাধ্যমে এসব নৃশংস তথ্য উঠে আসে। এরপর জামায়াত আমির নিজামী বলে যে, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। খুনি ও জঙ্গি বাংলা ভাইকে বাঁচানোর জন্য ৭১-এর খুনি ও জাাময়াত আমির নিজামীর এরকম অপচেষ্টার কারণ হলো- সাবেক শিবির ক্যাডার বাংলা ভাইকে আলাদা সংগঠনের ব্যানারে সন্ত্রাস করার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল জামায়াতের সর্বোচ্চ মহলের সংঘবদ্ধ সিদ্ধান্তে। বাংলা ভাইকে দিয়ে জঙ্গিবাদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং প্রগতিশীল শিক্ষক-বিচারক-সাংবাদিক-সংস্কৃতি কর্মীদের হত্যার পরিকল্পনাটি ছিল নিজামী-মুজাহিদদেরই।