575
Published on আগস্ট 16, 2023স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল এবং দণ্ডিত দালালদের ভোটাধিকার বাতিল করেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ বাতিল করে আবারো উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ খুলে দেয়। এমনকি সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগও করে দেয়। ফলে সমাজে পুনর্বাসিত হয় যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর সাজাপ্রাপ্ত সদস্যরা।
মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে যে লাল-সবুজের পতাকা অর্জন করে বাঙালি জাতি, সেই পতাকাও বদলে দিতে চেয়েছিল স্বৈরাচার জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে কমলা রঙের বৃত্তের নতুন জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। কিন্তু দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে, এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয় হয়।
এমনকি সেনাবাহিনী থেকে শত শত মুক্তিযোদ্ধা সেনাকে বিনাবিচারে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতকে শক্তিশালী করে তোলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া।
১৯৭৯ সালে যে লোক দেখানো নির্বাচনে বিএনপি থেকে যে ৩০০ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় সেনাপ্রধান জিয়া, তাদের মধ্যে ২৫০ জনই ছিল চিহ্নিত, অভিযুক্ত ও দণ্ডিত স্বাধীনতাবিরোধী।
১৯৭১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য যে শাহ আজিজুর রহমান জাতিসংঘে গিয়েছিল পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে, সেই ঘৃণিত দেশদ্রোহী রাজাকার আজিজকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয় বিএনপি-প্রধান জিয়াউর রহমান। এরপর সংসদে দাঁড়িয়ে 'বাংলা ভাষা'র নাম বদল করে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ হিসেবে নতুন নামকরণ করে শাহ আজিজুর রহমান। কারণ, বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল ভিত্তিটা রচিত হয়েছিল মূলত এই বাংলা ভাষার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। তাই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আমাদের ভাষার নামই বদলে দিতে চেয়েছিল। এমনকি বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল স্লোগান 'জয় বাংলা' এবং মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল-খ্যাত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জিয়াউর রহমান।
আরেক কুখ্যাত রাজাকার মসিউর রহমান যাদু মিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর সমমর্যাদা দিয়ে বানানো হয় সিনিয়র মন্ত্রী। বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার দায়ে এই যাদু মিয়াকে দালাল আইনে বিচার করে কারাদণ্ড দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েই তাকে জেল থেকে ছেড়ে দেয় জিয়া।
জিয়ার অন্য রাজাকার মন্ত্রীদের মধ্যে খন্দকার আবদুল হামিদ বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত, হিসামসুল হুদা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তান বেতার থেকে অনুষ্ঠান প্রচার করতো, আব্দুল আলিম জয়পুরহাটে সংখ্যালঘুদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়, মির্জা গোলাম হাফিজ মুক্তিযুদ্ধকে ষড়যন্ত্র বরে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, আবদুর রহমান বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এরকম স্বীকৃত দেশবিরোধীরা জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হওয়ায় আবারো দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতির ওপর হত্যাযজ্ঞ-লুটপাট-ধর্ষণ-নির্যাতন চালানো দেশবিরোধী চক্রকে বাংলার মাটিতে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন খালেদা জিয়া। ১৯৯১ সালে জামায়াতের সাহায্যে সরকার গঠনের পর রাস্ট্রীয়ভাবে রাজাকারদের পুনর্বাসনের কাজ অব্যাহত রাখেন তিনি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেন স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকায় থাকা আবদুর রহমান বিশ্বাসকে। এর আগে, ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের এমপি ও মন্ত্রী ছিল এই আবদুর রহমান। বাংলাদেশ সরকারের একজন তালিকাভুক্ত রাজাকার সে।
শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৮ সালে পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে আসা রাজাকার সর্দার গোলাম আজমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন খালেদা জিয়া। একইসঙ্গে তাকে রাজনীতি করার সুযোগ দেন। খালেদা জিয়অর এসব ভূমিকার প্রতিবাদে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে প্রতিবাদ শুরু হয় দেশজুড়ে। কিন্তু খালেদা জিয়ার সরকার জাহানারা ইমাম ও মুক্তিযোদ্ধাদের দেশাদ্রোহী হিসেবে বিচারের মুখোমুখি করে সমাজে রাজাকারদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। এসময় জিয়াউর রহমানের সময়কার প্রধানমন্ত্রী ও আরেক কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দাপটের সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকে।
খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর তার ছায়ায় দেশেই নিরাপদে ব্যবসা বাণিজ্য করতে থাকে খুনি ফারুক ও রশীদ। এমনকি খালেদা জিয়া সঙ্গে সম্পর্ক এতোটাই মধুর ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তখন নিজেদের মালিকানায় একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। কিন্তু বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে চলে যাওয়ায় তা আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে খুনি সুলতান শাহরিয়ার। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শাহরিয়ারকে আবারো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর খুনি বজলুল হুদা প্রকাশ্যে বলে বেড়াতো: কোনোদিনই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে না। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় বুঝতে পেরে দেশ থেকে পালিয়ে যায়।
১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমানের স্নেহধন্য হয়ে সৌদি আরবে পোস্টিং পায় রাশেদ চৌধুরী। ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারে থাকার সময়, খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় পলিটিক্যাল কাউন্সেলর হিসেবে জাপানের টোকিওতে কর্মরত ছিল সে।
খুনি আজিজ পাশাও জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় আর্জেন্টিনা, কেনিয়া, ইতালিতে দায়িত্ব পালন করে। এমনকি খালেদা জিয়ার একান্ত বিশ্বাসভাজন কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯১ সালের পর থেকে জিম্বাবুয়ের ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবে নিয়োজিত ছিল সে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার গঠন করার পর আজিজ পাশাকে পদচ্যুত করা হয়। ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতেই মারা যায় এই খুনি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত আবারো ক্ষমতায় আসার পর, মৃত আজিজ পাশার চাকরি ফিরিয়ে দেয় এবং তাকে মরণোত্তর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আর্থিক সুবিধা প্রদান করে।
এদিকে, ২০০১ সালে আবারো সরকার গঠন করে বিএনপি। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা জিয়া ১৯৭১-এর আল বদর ও আল শামস বাহিনীর দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দেন। বাংলাদেশের পতাকাবাহী গাড়ি থেকে নেমে প্রকাশ্য গণমাধ্যমে মুজাহিদ দম্ভ করে বলে, 'বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নাই।' এসময় দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও উগ্রবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্রের তকমা পায়।