স্মৃতির মণিকোঠায় বঙ্গবন্ধু

1975

Published on জানুয়ারি 7, 2021
  • Details Image

এইচ টি ইমাম: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে জানাই তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তার সাথে রয়েছে বাঙালির আত্মার সংযোগ; বাঙালি খুঁজে পেয়েছে আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। তিনি এমনভাবে আমাদের জীবনে-কর্মে-হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন, যেন মনে হয় আমাদের মাঝেই আছেন। দেশভাগের পূর্ব হতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অত্যন্ত কাছে থেকে জানার ও দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে; তন্মধ্যে, ৩ বছর ৭ মাস ৭ দিন তার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে ছিলাম। তার ভালোবাসা-স্নেহ ছিল অকৃত্রিম ও দরদমাখা। আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনও তার উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি আমার অগ্রজ জনাব তফাজ্জল ইমামের মুখ থেকে। তিনি তখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। সে-সময় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী নেতৃত্বের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইসলামিয়া কলেজ জুড়ে। কলকাতায় ধর্মীয় দাঙ্গা প্রতিরোধে তার সাহসী ভূমিকা আজও মনে গাঁথা। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের আহ্বানে সারা ভারতে ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালিত হয়। তারই ফলশ্রুতিতে কলকাতায় হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। সেই দাঙ্গায় আমি প্রত্যক্ষদর্শী র্ছিলাম। ঐ সময় শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে এক বিশাল ভূমিকা রাখেন।

দেশ ভাগের পর ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধুকে সশরীরে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়। আমি তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে রাজনৈতিক সফরে তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সে-সময় পাবনায় গিয়েছিলেন। আমরা কতিপয় ছাত্রনেতা বিশাল জনসভার আয়োজনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ঢাকা হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর খোঁজখবর নেওয়ার সুযোগ হয়। এ-সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। আমি এবং আমার সহকর্মী ও বন্ধু জনাব রফিকুল্লাহ চৌধুরী (বর্তমান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পিতা) নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর খোঁজখবর রাখতাম। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি আজও দেদীপ্যমান। বিজয়ী বীর উন্নতশির বিমানের দরজা দিয়ে হেঁটে এলেন; হাত তুলে বাঙালি জাতিকে জানালেন : ‘আমি তোমাদেরই লোক’। আমি শিহরিত হয়েছিলাম। আনন্দে-গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল।

প্রথম অত্যন্ত কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি সকালবেলা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেইলি রোডের বাসায়। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার পরও তার চোখ-মুখ উদ্দীপ্ত। যেমন দীর্ঘদেহী সুপুরুষ, তেমনই সুদর্শন। তার চেয়েও তার ব্যক্তিত্ব আরও বিশাল। প্রথম দেখাতেই কাছে ডেকে নিলেন; জিজ্ঞেস করলেন : ‘কী রে কেমন আছিস?’ মনে হলো কত দিন থেকে চেনেন। দীর্ঘদিন পর সন্তানকে দেখে পিতা যেমন কুশল জিজ্ঞেস করেন, ঠিক তেমনি। বঙ্গবন্ধুকে সেদিন দেখে ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আমাদের প্রিয় শিক্ষকের দেওয়া সার্থক নেতার সংজ্ঞা মনে পড়ে গেল। “তিনিই প্রকৃত নেতা, যাঁর আছে ‘Radiating Permeative Virtue.” এটি চীনের মান্ডারিন শাসকদের দেওয়া সংজ্ঞা। ভাবার্থ হলো : সার্থক এবং সফল নেতা তার গুণাবলি আশেপাশে সকলের মাঝে বিকিরণ ও অভিস্রবণ করেন। সেই গুণ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। উৎসারিত হয়, বিচ্ছুরিত হয়।

বঙ্গবন্ধু ১১ জানুয়ারি তারিখে তার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে সদস্যগণের বিষয় ও সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কে আলোচনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এই দিন রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ ১৯৭২ জারি করেন। রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ ১৯৭২-এ রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন, মন্ত্রিসভা নিয়োগ, শপথ, হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি স্থান পেয়েছিল। উল্লেখ্য যে, আমি এ-সময় মনে করিয়ে দিয়েছিলাম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর শপথ নেওয়া হয়নি; রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করাও প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে সাময়িক সংবিধান আদেশের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করেন। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পরিবর্তন করে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে গিয়ে প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করে সাথে সাথেই তিনি তার পদত্যাগ ঘোষণা করেন। পদত্যাগ ঘোষণার পর সাময়িক আদেশের ৮ নম্বর ধারা বলে মন্ত্রিপরিষদ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে এবং প্রধান বিচারপতি তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য পদত্যাগ করেন এবং রাষ্ট্রপতি সাময়িক আদেশের ৭ নম্বর ধারা বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু তার ১১ সদস্যবিশিষ্ট নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন এবং রাষ্ট্রপতির সাময়িক আদেশের ১০ নম্বর ধারা বলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ করান। ঘটনাবহুল এ দিনগুলোতে শপথ ও কার্যভার গ্রহণের সাথে সাথেই অতি দ্রুত গেজেট নোটিফিকেশন করা হয়েছিল।

১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নতুন মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে নিয়ে প্রথম বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠকে জাতীয় সংগীত এবং মার্চিং সংগীত সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” থেকে শুরু করে প্রথম ১০ লাইন অর্থাৎ “আমি নয়নজলে ভাসি” পর্যন্ত জাতীয় সংগীতের বাণী হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সশস্ত্র বাহিনীর মার্চিং সংগীত হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের “চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল” গানের বাণী অনুমোদিত হয়।

এর পরেই অন্য আরেকটি সমস্যা উদ্ভূত হয়। সেটি জাতীয় সংগীতকে কেন্দ্র করে। কবিগুরুর “আমার সোনার বাংলা” গানটি বাঁশি, অন্যান্য দেশীয় বাদ্যযন্ত্র এবং ব্যাগপাইপে বাজানো গেলেও সামরিক বাহিনীর ব্রাস ব্যান্ডে বাজানো খুব কঠিন ছিল এই কারণে যে তখন পর্যন্ত জাতীয় সংগীতের কোনো আন্তর্জাতিক স্টাফ নোটেশন ছিল না। এই কারণে আমাদের সামরিক ও অন্যান্য বাহিনীর বেশ কিছু অসুবিধা হচ্ছিল (যেমনÑ বিদেশি ভিভিআইপি মেহমান এলে গার্ড অব অনার প্রদান ইত্যাদি)। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে একটি উচ্চপদস্থ সরকারি দল যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন (যার মধ্যে আমিও ছিলাম)। আমার ভ্রমণসূচিতে অন্যতম বিষয় ছিল ব্রিটিশ সরকারের ক্যাবিনেট সচিবের সাথে বৈঠক। তাকে আমাদের জাতীয় সংগীতের স্টাফ নোটেশনের বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞাত করলে তিনি বিবিসি’র সাথে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেন। ঐ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ থেকে কোনো বিখ্যাত সুরকার ও সংগীত বিশেষজ্ঞকে বিবিসি’তে পাঠানো হবে এবং তিনি বিবিসি’র সংগীত বিভাগের সহযোগিতায় আমাদের জাতীয় সংগীতের আন্তর্জাতিক স্টাফ নোটেশনটি নির্ধারণ করে আনবেন।

দেশে ফিরে বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে জ্ঞাত করলে তিনি বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও সুরস্রষ্টা সমর দাসকে এ-কাজটি করার জন্য নির্বাচন করেন। একই সঙ্গে জাতীয় সংগীতের মূল সুর থেকে যেন কোনো বিচ্যুতি না ঘটে সেজন্য আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেশে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করি এবং বিবিসি থেকে সমর দাস কর্তৃক তৈরি করে আনা স্টাফ নোটেশনটি তাদের বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। এই বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন প্রয়াত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী কলিম শরাফী, প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার আবদুল আহাদ এবং সন্জীদা খাতুন (ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা)। এদের সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক আমিরুজ্জামান।

বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদৃষ্টি ছিল প্রখর। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে কেউ কোনো পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু অবশ্য ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফরে গিয়েছিলেন এবং তা খুবই ফলপ্রসূ ছিল। এই সফরের সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সৌহার্দপূর্ণ ও আন্তরিক আলোচনা হয়েছিল। আলোচনার সূত্র ধরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চের আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফর চূড়ান্তকরণের প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু নিজেই তাকে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। কার্যোপলক্ষে সৌভাগ্যবশত আমি বঙ্গবন্ধুর পাশেই ছিলাম। লক্ষ করেছিলাম বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত ভদ্র এবং বিনয়ী; কিন্তু দৃঢ় স্বরে মিসেস গান্ধীকে তার বাংলাদেশ সফরের আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনী ফেরত নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। পাশে থেকে মিসেস গান্ধীর সম্মতির কথা শুনলাম। মিসেস গান্ধীকে বলতে শুনেছিলাম, “I am overwhelmed at your outspoken manner and boldness in discussing on this very important issue. Well, it will be done as per your honest wish (আপনার স্পষ্টবাদী আচরণ এবং দৃঢ়তায় অভিভূত হয়েছি। ঠিক আছে, আপনার সদিচ্ছা পূরণ হবে)।” মিসেস গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের পূর্বেই ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সব সদস্যকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু এ-কথা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুবিন্যস্ত আর্থিক নীতিমালা এবং ব্যাংকিং খাতের সুষ্ঠু বিকাশ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাই, ব্যাংকিং সেক্টরে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ছিল সুদূরপ্রসারী। বিধ্বস্ত অর্থনীতি, মুদ্রা ব্যবস্থার অভাব ও ভগ্ন ব্যাংকিং ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৎক্ষণাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠন করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হয়Ñ সেটি ছিল পাকিস্তান আমলের নামগুলো পরিবর্তন করে নতুন বাংলা নাম দেওয়া। প্রাক্তন পাকিস্তান আমলের ১২টি ব্যাংককে একত্রিত করে নতুন নাম দিয়ে মোট ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিকথার উল্লেখ করার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। বাংলাদেশ সচিবালয়ের পুরাতন ক্যাবিনেট রুমে ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্তকরণ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আলোচনায় এসে যায়। আলোচনার বিষয় ছিল যে নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বাংলা নামকরণ কীভাবে হবে? প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করছিলেন। আকস্মিকভাবেই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তৎকালীন ক্যাবিনেট সচিব আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আপনিই কয়েকটি নাম সুপারিশ করুন।” তাৎক্ষণিকভাবেই কেন জানি না আমার এ বিষয়ে মনে কিছু প্রতিক্রিয়া হলো। অতি দ্রুত ভাবনায় এলো যে প্রাক্তন এই ব্যাংকগুলোর প্রধান কাজ কি ছিল এবং তখন তাদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য কি ছিল সেটি পর্যালোচনা করে নতুন নাম দেওয়া গেলে ভালো হয়। পাকিস্তান আমলে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান মূলত পাট রপ্তানি ব্যবসায় অর্থায়ন করত। সোনালি আঁশরূপে বিশ্বব্যাপী পরিচিত পণ্য পাটের প্রসারের পিছনে ব্যাপক অবদানের জন্য এই ব্যাংকের নতুন নামকরণ ‘সোনালী ব্যাংক’ করার প্রস্তাব রাখলাম। পাকিস্তান আমলের অত্যন্ত ব্যবসা-সফল এবং আধুনিক ব্যাংক হিসেবে সমাদৃত ছিল হাবিব ব্যাংক। নতুন ব্যাংকও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সে-রকমই অগ্রণী ভূমিকা যেন রাখতে পারে সেই চিন্তা মাথায় রেখে এর নামকরণের প্রস্তাব করেছিলাম। প্রস্তাব গ্রহণ করে এই ব্যাংকের নাম রাখা হলো ‘অগ্রণী ব্যাংক’। ইউনাইটেড ব্যাংক ব্যাংকিং ব্যবসায় একটি নতুন ধারা প্রচলন করেছিল। মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের ব্যাংক হিসেবে এই ব্যাংকটি পরিচিত হয়ে উঠেছিল। এ বিষয়টি ভেবে নতুন ব্যাংকের নাম প্রস্তাব করলাম ‘জনতা ব্যাংক’। এরপর, বাংলার সবচেয়ে প্রিয় মাছ ইলিশ যে বর্ণের, সেই নামটি ব্যবহার করে ‘মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক’ এবং অন্য দুটি ব্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত নতুন ব্যাংকের নাম প্রস্তাব করলাম ‘রূপালী ব্যাংক’। তৎকালীন পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানি (বাঙালি) উদ্যোক্তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক’-এর নাম স্বভাবতই ‘পূবালী ব্যাংক’ রাখা সংগত হবে বলে মত দিলাম। যেহেতু উত্তরবঙ্গের কোনো ব্যাংক ছিল না এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে এ অংশ অনেকটা পিছিয়ে ছিল, তাই এমন চিন্তা মাথায় রেখে ‘ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘উত্তরা ব্যাংক’ রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করলাম।

আজ ভাবতে অত্যন্ত গর্ববোধ করি যে, সেদিন সম্মানিত মন্ত্রিসভার সদস্যগণ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতেই আমার উপরোল্লিখিত সব প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন, যার প্রতিফলন ঘটে The Bangladesh Banks (Nationalization) Order, 1972 শিরোনামে প্রণীত রাষ্ট্রপতির আদেশে। জাতীয়করণকৃত ব্যাংকগুলো সেই নামেই বাংলাদেশে সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

এর পরেই আর একটি বিরাট পদক্ষেপ নিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেটি হলো পরিকল্পনা কমিশন স্থাপন। ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় পরিকল্পনা কমিশন, যার চেয়ারম্যান ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর নূরুল ইসলাম তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। ঐ সাক্ষাৎকারের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। প্রফেসর ইসলাম খুব সুচিন্তিতভাবেই কাজ করতেন। তিনি পরিকল্পনা কমিশন স্থাপনের জন্য এবং তার গঠন, দায়িত্ব ও কার্যপ্রণালি কীভাবে হবে সেগুলো লিখে নিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমার হাতে সেটি দিয়ে বললেন, পরে বিবেচনা করে দেখব। প্রফেসর ইসলাম প্রস্তাবিত পরিকল্পনা কমিশন স্থাপন করা হলে এবং যেভাবে ক্ষমতায়ন তিনি চেয়েছিলেন তাতে অপর একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করতে হতো। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তখনও আমাদের সরকারের রুলস্ অব বিজনেস চূড়ান্ত হয়নি এবং আমার একটি অস্থায়ী খসড়া রুলস্ দ্বারা সরকার পরিচালনা করছিলাম। ব্যাপকভাবে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করায় এবং পূর্ব ঘোষিত আওয়ামী লীগের ইশতেহারের বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন বাংলাদেশ সরকারের অবয়ব ছিল অত্যন্ত আধুনিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক। এরপর একটি ক্রান্তিকালে যে শ্রম, ধৈর্য এবং সময় বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিগতভাবে দিয়েছিলেন এর সাথে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। এটি মনে পড়লে এখনও শিহরিত হই।

১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধু প্রত্যাবর্তনের পরপরই জনাব তোফায়েল আহমেদকে তার রাজনৈতিক সচিব (পলিটিক্যাল সেক্রেটারি) নিয়োগ করেন। সেই সাথে তিনি তার অত্যন্ত আস্থাভাজন দুই পুরনো কর্মকর্তাকে নিয়ে আসেন। এদের একজন হলেন মোহাম্মদ হানিফ (যিনি আলফা ইন্স্যুরেন্সে কাজ করতেন), অপরজন হলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী ও টাইপিস্ট রোজারিও। ১৯৭২-এর জুন/জুলাই মাসে মশিউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু তার একান্ত সচিব নিয়োগ করেন। ঐ বছরের শেষ দিকে ফরাসউদ্দিন যোগদান করেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব-২ হিসেবে। প্রথম দিকে জনাব নুরুল ইসলাম (অনু) বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেন। অল্প কয়েকদিন পর তার স্থলাভিষিক্ত হন জনাব মাহে আলম। ’৭২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যোগদান করেন জনাব মনোয়ারুল ইসলাম (যুগ্ম সচিব)। মনোয়ার সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। জীবনে কখনও দ্বিতীয় হননি; চারিত্রিক দৃঢ়তা অসাধারণ। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো দায়িত্ব তাকে ন্যস্ত করেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আমি সহায়ক শক্তি হিসেবে পাই কাজী হাবিবুল হককে। তিনিও যুগ্ম সচিব পদে যোগদান করেন এবং মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকের বিবরণী লিখতেন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার আলোচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়বস্তু প্রথম দিকে আমি নিজ হাতে লিখতাম। কাজী হাবিবুল হক যোগদান করার পর তিনি আমাকে সহায়তা করেন। বৈঠকে যেসব বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো সেগুলো আমরা নোট খাতায় টুকে নিতাম। পরে এগুলো যথাযথভাবে টাইপ করা হলে আমি ও হাবিবুল হক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্বাক্ষর করতাম। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে উপস্থাপন করতাম। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে তৎকালে আমি যে নোট খাতা সঙ্গে রাখতাম, সেগুলো আজও আমার সংরক্ষণে আছে।

বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন সকালে গণভবনে (প্রাক্তন রাষ্টীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা এবং বর্তমান ফরেন সার্ভিস ট্রেনিং একাডেমি) আসতেন। আমরা তাকে অভ্যর্থনা জানাতাম এবং তার সাথে গিয়ে বসে দিনের কর্মসূচি আলোচনা করতাম। রফিকুল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সচিব পদে যোগদান করার পর আমাদের টিমটি আরও শক্তিশালী হয়। গণভবনের দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কত রকমের সমস্যা নিয়ে অথবা কেবল বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য দলে দলে লোক আসত। বারান্দায় বসতেন বঙ্গবন্ধু। সম্মুখে ঘন সবুজ ঘাসের লন। সেখানেই জমতো মানুষের ভিড়। বলা বাহুল্য যে, ঐ সময়ে সরকারের কর্মকা- বিপুলভাবে প্রসারিত হওয়ায় এবং সরকারি জনবল বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানের অভাবে দাপ্তরিক কাজকর্ম বিঘিœত হচ্ছিল। সে-সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে বড় দুটি পূর্ত কর্ম মন্ত্রণালয়কে দিয়ে শুরু করাই। প্রথমটি হলো সচিবালয়ের ০১ নম্বর ভবনের তিন তলার উপরে আরেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ তলা বা ফ্লোর নির্মাণ, যেখানে বঙ্গবন্ধু অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব কামরা থাকবে এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা বসতে পারবেন। অন্যদিকে কেবিনেট রুম সম্পূর্ণ নতুন করে নির্মিত হবে, যেখানে টেবিল-চেয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র আধুনিক হবে; সাথেই থাকবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কক্ষ। এখন আমরা যে কাজগুলো দেখতে পাই এবং যে ব্যবস্থাপনা তার পিছনে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা ও আমার শ্রম উল্লেখ করতেই হয়।

অপর বড় পূর্ত কর্মটি ছিল স্থায়ী গণভবন তৈরি। শেরে বাংলা নগরে প্রাক্তন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের একটি স্থাপনা ছিল যেখানে কয়েকটি দপ্তর এবং সেই সাথে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। বঙ্গবন্ধু উক্ত স্থাপনাটি পরিদর্শন করেন এবং তার সাথে আলাপের পর আমরা ঠিক করলাম যেহেতু ঐ ভবনটির ভিত্তি খুব ভালো ছিল সেজন্য এটিকে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। যে-কথা সেই কাজÑ কয়েক মাসের মধ্যেই দোতলায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য কর্মকর্তাদের কক্ষ নির্মিত হয়ে গেল। এরপর বঙ্গবন্ধুর জন্য সরকারি বাসভবন নির্মাণ করা হলো। যেটি গণভবন নামেই পরিচিত হয়। এটি ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হয়ে গণভবন কমপ্লেক্স রূপ ধারণ করে। যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছাড়াও তার নিজস্ব দপ্তর, চত্বরের পাশে ছোটখাটো একটি লেক, মূল ভবনের বাইরে মসজিদ, ব্যাংক এবং প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব কর্মকর্তাদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীকালে সেখানে একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বেইলী রোডস্থ পুরনো গণভবন থেকে শেরে বাংলা নগরে নবনির্মিত গণভবন কমপ্লেক্সে স্থানান্তরিত হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২ থেকে ৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর উপলক্ষে ঐ দেশের দুটি প্রধান সংবাদপত্র ‘প্রাভদা’ ও ‘ইজভেস্তিয়া’ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে উল্লেখ করেছিল যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, জোট নিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, জাতি বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সুদৃঢ় করা।

সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ব্রেজনেভ এবং প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন এবং রাষ্ট্রপ্রধান পদগর্নি বঙ্গবন্ধুকে যে সম্মান প্রদর্শন ও অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন তা ছিল অভূতপূর্ব। পৃথিবীর ইতিহাসে এ দৃশ্য এক বিরল ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কতখানি শ্রদ্ধা করতেন তার প্রমাণ মস্কো বিমানবন্দরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট উভয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন, যা তারা ইতোপূর্বে কখনও করেননি।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিনের মধ্যে দু-দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সোভিয়েতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছিলেন। দুই মহান দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বাংলাদেশ-সোভিয়েত যুক্ত ঘোষণায় বলা হয়েছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফর ফলপ্রসূ হয়েছে। সফরের শেষ দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাসখন্দ পরিদর্শনে গেলে সেখানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের স্মৃতিতে এখনও সেই দৃশ্য অমলিন হয়ে আছে। রাস্তার দু-পাশে দাঁড়ানো হাজার হাজার ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীর উচ্ছ্বাস-আনন্দ ভাষায় বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তারা সেøাগান দিয়েছিল, ‘বাংলাদেশ’, ‘মুজিবুর রকমান’। রুশ ভাষায় রহমানকে ‘রকমান’ বলে উচ্চারণ করা হয়।
সরকারি পর্যায়ে আলোচনা এবং মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু এবং তার সফরসঙ্গীদের সোভিয়েত-ভ্রমণ আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর করার জন্য সোভিয়েত সরকার কোনো আয়োজনেরই ত্রুটি রাখেননি। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর মহড়া, বলশয়ে থিয়েটারে অপেরা এবং ক্রেমলিনসহ মস্কো শহরের উল্লেখযোগ্য প্রতিটি স্থাপনা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও জাদুঘরসমূহ পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। মস্কো নগরীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের বীর যোদ্ধাদের সমাধি (মন্যুমেন্ট) দর্শন একটি বিশেষ আবহ তৈরি করে। মস্কোর পর বঙ্গবন্ধুর সফরের দ্বিতীয় পর্যায় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্পূর্ণ সময় ধরে অবরুদ্ধ থাকা নগরী লেনিনগ্রাড (বর্তমানের সেন্ট পিটসবার্গ)। লেনিনগ্রাড শহরটি সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করেও জার্মান নাৎসী বাহিনী এই মহানগরীর পতন ঘটাতে পারেনি। যুদ্ধে যেমন অগণিত সোভিয়েত সৈন্য প্রাণ দিয়েছেন, তেমনই অবরুদ্ধ নগরীতে খাদ্যাভাবে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান। এদের এই মহান ত্যাগ স্মরণীয় করে রাখার জন্য লেনিনগ্রাডে একটি বিশাল স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এই নগরীর আরেকটি তাৎপর্য হলো এই যে, বলশেভিক বিপ্লব এই লেনিনগ্রাড শহর থেকেই শুরু হয়েছিল। এই স্মৃতিসৌধ এবং এর সংলগ্ন জাদুঘর অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে দেখে সেদেশের জনগণ। স্মৃতিসৌধটি এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা বিভিন্ন ভাস্কর্য এবং পাশাপাশি জাদুঘরে রক্ষিত বিভিন্ন নিদর্শন দেখে বঙ্গবন্ধু ভাবাবেগে আপ্লুত হন। তার সফরসঙ্গী আমরা যারা ছিলাম তারাও ব্যাপকভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করি। এই স্মৃতিসৌধ আমার স্মৃতিতে অমøান হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু ঐ স্মৃতিসৌধের সামনেই আমাকে নির্দেশ দেন এটির একটি নকশা (sketch) করে রাখতে, যাতে বাংলাদেশেও ত্রিশ লক্ষ শহিদের স্মরণে ও সম্মানে আমাদের সরকারও এ-রকম একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারে।

দেশে ফেরার পর আমার কাঁচা হাতের এই স্কেচ এবং স্মৃতিতে ধরে রাখা ছবিটি তৎকালীন প্রধান স্থপতি জনাব আবুল বাশারকে দেখাই এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ঐ রকম একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ডিজাইন করার জন্য তাকে অনুরোধ করি। তিনি মোটামুটি ঐ আদলেই একটি নকশা প্রস্তুত করেন। ১৬ ডিসেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একই সাথে মিরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আরেকটি ছোট আকারের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শুরু হয়।

বঙ্গবন্ধু সরকারের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত এবং সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত অতি বামপন্থি এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস-এর আত্মগোপনে থাকা সদস্যরা ক্রমাগতভাবে অপতৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। বিশেষত মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধু-সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব দেশে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে দল ত্যাগ করে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে নতুন একটি দল গড়ে তোলে। এই দলের নেতৃত্বে সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব, এমএ জলিল, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ ছিলেন। মুজিব সরকারকে উৎখাতের ঘোষণা দিতেও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল কুণ্ঠিত হয়নি। জাসদের উগ্র ও সন্ত্রাসী কর্মকা- দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটায়। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে অতি বাম শক্তিগুলোও অপতৎপরতায় নেমে পড়ে। ১৯৭৩ সালের পাঁচ মাসের মধ্যেই ৬০টি থানা আক্রমণ করে। সরকার-বিরোধী শক্তিসমূহের ঢাকা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, খুলনা ইত্যাদি স্থানে নাশকতামূলক কাজ সরকারকে বিব্রত করে তোলে। চরম বামপন্থি দল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখায়। “মুসলিম বাংলা” নামের চরম ডানপন্থি, চরম বামপন্থি গোষ্ঠী (মাওবাদী সিরাজ সিকদারের সর্বহারা দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর গণবাহিনী, কমরেড আবদুল হকের ইপিসি এম-এল, কমরেড তোয়াহার কমিউনিস্ট পার্টির হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধমূলক তৎপরতায় লিপ্ত হয়। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির ফলে দেশে অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি Special Powers Act, 1974 জারি করা হয় এবং পরবর্তীতে ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।

বঙ্গবন্ধুর সাথে আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হলো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন আজকের আইএমইডি (বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৪ সালের মধ্যভাগে কুয়ালালামপুরে জাতিসংঘের ‘এপড্যাক’ (Asia Pacific Development Centre)-এর সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনটি ছিল জাতিসংঘের এসকাপের সহায়তায় কমনওয়েলথভুক্ত এশীয় রাষ্ট্রগুলোর নেতৃবৃন্দকে নিয়ে। এই সম্মেলনে আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করি। ঐ সময় মালয়েশিয়া খুব দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং উন্নয়নের পিছনে চালিকাশক্তি ছিল ঐ দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। আমাদের দূতাবাস ঐ দপ্তর পরিদর্শনের একটি বিশেষ আয়োজন করেন। উদ্দেশ্য ছিল তাদের কার্যপ্রণালি দেখা এবং সেই সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করা। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি সংস্থা ছিল ‘মাম্পু’ (MAMPU)। সংস্থাটির প্রধানতম দায়িত্ব ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহ পরিদর্শন করে তাদের কর্মতৎপরতা ও বাস্তবায়ন-অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয়ভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে যে সকল বাধা-বিপত্তি ছিল সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা। ঐ সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির এত উন্নয়ন হয়নি; কিন্তু ‘মাম্পু’র সদস্যগণ টেলিফোনে এবং সশরীরে ঐ প্রকল্পসমূহ পরিদর্শন করে প্রতি সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রতিবেদন জমা দিতেন। এই অভিজ্ঞতাটি বাংলাদেশে প্রয়োগ করার বিষয়টি সম্পর্কে আমি বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করি এবং তিনি তাৎক্ষণিকভাবেই এ-ধরনের একটি সংস্থা বাংলাদেশে স্থাপনের জন্য উদ্যোগী হন। এর প্রেক্ষিতেই সৃষ্টি হয় আইএমইডি। প্রাথমিকভাবে এ সংস্থার নামকরণ করা হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন সংস্থা (Project Implementation Bureau)।

জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির ডিক্রির মাধ্যমে দেশের সমস্ত বৈধ রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে “বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)” নামে একটি নতুন জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বাধীনতা-বিরোধী দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং দেশের অর্থনীতি বিকাশে অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল। মানবতাবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে দেখা যায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের। তারা ১৯৭৪ সালে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষাবস্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্য ছিল বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি। এ জন্য বঙ্গবন্ধু শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এই দলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তিফ্রন্ট এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ যোগদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত হন বাকশালের চেয়ারম্যান। কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্যদের মধ্যে আমিও অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। পার্টির চেয়ারম্যানকে সহায়তা করার জন্য বঙ্গবন্ধু আমাকে চেয়ারম্যানের সেক্রেটারি নিয়োগ করেন। এ দায়িত্ব ছিল ক্যাবিনেট সচিবের অতিরিক্ত।

প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করেন। বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালের ২৩ জুন ৬১টি জেলায় বিভক্ত করে ১৬ জুলাই ৬১ জন গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। গভর্নরদের মধ্যে ৩৩ জন সংসদ সদস্য, ১৩ জন বেসামরিক অফিসার, একজন সামরিক অফিসার এবং অবশিষ্ট ১৪ জন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। এসব গর্ভনরদের প্রশিক্ষণের মূল দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু আমার ওপর ন্যস্ত করেন। বঙ্গবন্ধুকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যার পূর্ব পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলমান ছিল। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট রাত ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে বিদায় নেই আমি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না; তিনি এই দেশটির সার্থক স্থপতি। এই দেশের এমন একটি ভিত্তি তিনি গড়ে গেছেন যার ফল পরবর্তীতে সকলেই ভোগ করেছেন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের যে অবকাঠামো প্রয়োজন তিনি সেটি স্থাপন করেছিলেন। আধুনিক যুগের একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান যার মাধ্যমে স্বাধীন জাতীয় সংসদ, নির্বাহী বিভাগ এবং পৃথক বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা তিনি করেছিলেন। সেই সাথে রাষ্ট্রের পরিচয় বহনকারী জাতীয় সংগীত (আন্তর্জাতিক স্টাফ নোটেশনসহ), জাতীয় পতাকা (সেজন্য বিধি) এবং জাতীয় প্রতীক- এগুলো তিনি আমাদের দিয়ে গিয়েছেন। এগুলোর পাশাপাশি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে দেশকে পুনর্গঠন করতে যে ভৌত অবকাঠামো প্রয়োজন সেটিও বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়ে গেছেন। আজকের বাংলাদেশে আমরা যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাই, তার সবই বঙ্গবন্ধুর কীর্তি। জাতিসংঘ এবং এর সকল সংস্থার সদস্যপদ অর্জন, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং রাষ্ট্রের জন্য একটি চমৎকার বৈদেশিক নীতি (‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’) প্রণয়নও বঙ্গবন্ধুর অবদান। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সম্পাদিত ভারতের সাথে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি, সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে আইন- যা জাতিসংঘ করেছে আরও অনেক পরে, ভারতের সাথে পানি বণ্টন চুক্তি, শেল অয়েল কোম্পানি থেকে গ্যাস ফিল্ড ক্রয় করে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলককরণ, ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণÑ এগুলো অবিস্মরণীয় কীর্তি।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ক্যারিশমা (সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব) এমন উচ্চ স্তরের ছিল যে, তিনি শুধু সার্থক সরকার পরিচালকই ছিলেন না, একজন বিশ্ববিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এত উঁচু মাপের বিশ্বনেতা ছিলেন যে, তাকে স্বয়ং ব্রেজনেভ, কোসিগিন, টিটো, বুমেদিন, ফিদেল কাস্ত্রো, অ্যাডওয়ার্ড হিথ, সুকর্ন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সত্যিই বঙ্গবন্ধুর তুলনা বঙ্গবন্ধু নিজেই। যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায় স্মরণ করবে। তার জীবনের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা থেকে পাঠ নেবে।

আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতো। ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর’- যে ব্রত নিয়ে জাতির পিতা রাজনীতি শুরু করেছিলেন এবং আজীবন বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য তার যে দরদ তার প্রতিফলন ঘটেছিল তিনি দেশে ফিরে আসার পরপরই। তার প্রতিটি বক্তব্য এবং কার্যক্রম ছিল দেশে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ। এজন্যই তিনি প্রণয়ন করেছিলেন প্রথম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনা। তার পুনর্বাসন পরিকল্পনা এবং দেশ পুনর্গঠনের জন্য যে রোডম্যাপ তিনি প্রণয়ন করেছিলেন, তার মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব একটি আধুনিক এবং উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা। তার সে স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেননি বটে; কিন্তু তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের মে মাসে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে প্রথমেই যে লড়াই শুরু করেন তা ছিল বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা। পিতার মতোই তিনি বাংলাদেশের সকল প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন মানুষের বুকে সাহস ফিরিয়ে আনতে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব, কঠোর পরিশ্রম, প্রজ্ঞা এবং পিতার আদর্শ অচিরেই বাংলাদেশে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং এক সময় তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। প্রতিক্রিয়াশীল এবং বাংলাদেশ বিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন করেন ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এ-সময়টি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণ যুগ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে এবং চিন্তা-ভাবনাকে ধারণ করে তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক নতুন উচ্চতায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ যে গতিতে এগিয়ে চলেছে তা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় প্রদান এবং তাদের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা করা ছিল মানবিকতার এক নতুন দৃষ্টান্ত। গত প্রায় এক বছর যাবত বিশ্বব্যাপী চলমান ভয়াবহ করোনাভাইরাসের মহামারি এক কঠিন সমস্যা। তারও চমৎকার মোকাবিলা বাংলাদেশ করতে পেরেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা নিজে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ তার আদর্শের আলোকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লেখক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা

সৌজন্যেঃ উত্তরণ (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত