‘এই লভিনু সঙ্গ তব’

2904

Published on জানুয়ারি 7, 2021
  • Details Image

গীতালি দাশগুপ্তাঃ

“ঐ মহামানব আসে / দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে / মর্ত ধূলির ঘাসে ঘাসে।”

আজ ইংরেজির ২০২০ সাল। এখন থেকে শত বছর আগে অর্থাৎ ইংরেজি ১৯২০ সালে প্রত্যন্ত অজপাড়াগাঁয়ে জন্মেছিলেন এক মুষ্টিবদ্ধ শিশু। সেদিন সেই গাঁয়ের নাম এমনিভাবে বিকশিত ছিল না। ছিল না মানুষের মুখেও সেই গাঁয়ের নামটি। কখনও খুব একটা শোনাও যায়নি। অথচ আজ, সেই অজপাড়াগাঁয়ের নামটি বিশ্বব্যাপী প্রতিটি বাঙালির কাছে অতি পরিচিত। শুধু কি তাই? সেই গ্রামটি এখন বাঙালি জাতির তীর্থক্ষেত্র। সেই গ্রামে, সেই জন্মস্থানে ঘুমিয়ে আছেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নরপিশাচ আর বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের বাণে জাতির পিতাকে অকালে অসময়ে ঘুমিয়ে যেতে হলো! ঈশ্বর যাকে অমৃত সুধা পান করিয়ে মাতৃজঠরে স্থান করে দেন, সে তো অমৃতের পুত্র! তাই তো, এখন থেকে ১০০ বছর আগে এক মহালগ্নে-

ঈশ্বর প্রদত্ত বিরাট-নিটোল হৃদয় নিয়ে
এক মাহেন্দ্র ক্ষণে জন্মেছিল যে শিশু,
মা আর মাটির কোলে বড় হলো ধীরে ধীরে,
স্রষ্টার এই বিশাল সৃষ্টিকে চিনলো না কেউ!
তারপর, বর্ণমালা থেকে ধারাপাত,
ধারাপাত থেকে মহাবিদ্যালয়,
শুরু হলো তাঁর পথ চলা।
চোখে তাঁর সূর্যের স্বপ্ন,
বুকে ছিল অপরিমেয় ভালোবাসা,
স্বপ্ন রূপায়ণে ছিল কৃচ্ছ্র সাধনা।
নাগ বিস্তৃত পথে চলা, নাগ বিষে জর্জরিত সর্বাঙ্গ,
তবুও, থেমে নেই! ধেয়ে চলেছে কাঙ্ক্ষিত বাসে।
হৃদয়ে তাঁর অভিসারের উদগ্র বাসনা,
কণ্ঠে উদ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’,
রুখবে তাঁকে, এমন সাধ্য কার?

মিলিত হলো কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার সনে,
একাকার হলো সার্বভৌম আর স্বাধীনতার মাঝে!
এ যেন জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মহামিলন!
সে মিলনে রূপ পেল তোমার সূর্য স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’,
যাকে তুমি চেয়েছিলে।
তুমি জয়ী তাত!
তোমার কীর্তি রইলো ধরিত্রীর বুক জুড়ে।
সে-ই শিশু আজ বঙ্গ জাতির পঞ্চপিতা, বন্ধু,
আর, কোটি মানুষের হৃদয় সম্রাট ॥
[বাংলার সম্রাট]

তাই তো সমগ্র বাঙালি জাতি আজ নত মস্তকে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।

দীপ্তমান দ্রাঘিমায় অবস্থান এই মনস্বীর সান্নিধ্য ক্ষণিকের জন্য পেয়েছিলাম আমি। তাই, নিজেকে ভাগ্যবান আর দুর্ভাগ্যবান দুটোই মনে করি। বড্ড অল্প সময়! তার স্নেহের পরশে আপ্লুত হয়ে উঠেছিলাম। মাত্র ৩টি বছর বা তার থেকে অল্প কিছু বেশি হবে। প্রথম তারিখটা আজ আর মনে পড়ছে না, তবে শেষ দিনের শুধু তারিখ নয়, শেষ সময়টাও গাঁথা হয়ে আছে হৃদয় মাঝারে।

১৯৭২ সালের জুলাই কি আগস্ট মাসে ছোট্ট শিশু রাসেলের গৃহশিক্ষক হিসেবে আমি ঐ পরিবারের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম, আর ঐ পরিবারের সাথে বিচ্ছেদ ঘটল ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাত ১১টা ৩০ কি ৩৫ মিনিট হবে। এরপরই হয় বিচ্ছেদের রক্তক্ষরণ। আজও বুকের ভেতর একইভাবে চলছে সে প্রদাহের যন্ত্রণা! এই মহাত্মা তার আপত্য স্নেহে আপন কন্যাসম শেষদিন পর্যন্ত জড়িয়ে রেখেছিলেন আমায়। আজ শত বছর পূর্তিতে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

চেষ্টা করছি, সেই মহান পুরুষ সম্পর্কে আমার জানা দু-চারটি অজানা গল্প সবার জন্য লিখতে। ভাবছি, ‘গল্প’ শব্দটি বলা কি ঠিক হলো? সেই দিনের সমস্ত ঘটনাবলি কি আজ সত্যি ‘গল্পে’ রূপ নিল? না, তা ঠিক নয়। সত্যি কথাগুলোই তো আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয় গল্পের স্রোতধারায়। আমার এ লেখাটি আজ গল্পের সংজ্ঞা পেলেও নিত্যধারায় পরম সত্যি। আগামী প্রজন্মই শুধু নয়, আজকের অনেকেরই এই নমস্য ব্যক্তির ব্যক্তি-জীবনের এ-ঘটনাগুলো জানা নেই। কেউ এমনি এমনিভাবে বড় হয়ে ওঠেনি বা হয়নি। আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েই সে বড় হয়। অহমবোধ বোধিসত্তাকে খাটো করে, অথচ এই অহমবোধকে যিনি দমন করতে পারেন তিনিই তো সবার নমস্য এবং শ্রদ্ধার পাত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন, এই দ্বিতীয় ধারার সদস্য। তার আদর্শ সম্পর্কে বলতে গেলে কবি গুরুর দ্বারস্থ হয়ে বলতে হয়-

“নিজের না যেন করি প্রকাশ নিজের আপন কাজে,
তোমার ইচ্ছা কর হে পূর্ণ আমার জীবন মাঝে।”

এই তো ছিল তার আদর্শ, আর এই আদর্শ নিয়েই ছিল তার পথ চলা।

আমি জন্মেছি এক মহান বিপ্লবী পরিবারে। যে পরিবার দু-দুটো স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় যোদ্ধা।

শুধু তাই নয়, দু-ভাই একই দিনে পরাধীন দেশ মাতৃকার জন্য ফাঁসিকাষ্ঠে আপন জীবন পরম তৃপ্তিতে উৎসর্গ করে মাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়ে গেছেন। সুতরাং, বঙ্গবন্ধুর মতো মহান পুরুষের নাম খুব ছোট বয়স থেকেই শুনে আসছি। তবে, প্রথম পরিচয় ও তাকে খুব কাছ থেকে দেখা হয়েছিল অনেক পরে, সেই ১৯৬৯ সালে। সে-কথায় পরে আসব।

১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আমাকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে পড়াবার দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছিল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ক্লাসের ছাত্রী। প্রথম এক মাস বা তার একটু বেশি হতে পারে, আমি ওকে গণভবনে গিয়ে পড়াতাম। আজ যার নাম ‘সুগন্ধা’। প্রায় ২৬-২৭ দিন পর্যন্ত আমি রাসেল, ফরিদ (কাজের ছেলে) ও ড্রাইভার মুন্সী ভাইকেই শুধুমাত্র দেখেছি ও চিনেছি। মাঝে একদিন অল্প একটু সময়ের জন্য ‘সুগন্ধা’র মালঞ্চের মালীকে দেখতে পেয়েছিলাম। এর মধ্যে বাড়ির আর কাউকে নয়।

সেদিনটি ছিল আমার রাসেলকে পড়াবার ২৮ দিন। এ দিনটি আমার জীবনের একটি অবর্ণনীয় স্মরণীয় মুহূর্ত ও মহিমান্বিত দিন। সেদিন আমি নতুন করে পরিচিত হই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে। আগেই বলেছি, এ কদিনে আমি তিনজন ব্যক্তিকে ছাড়া আর কাউকেই দেখিনি। ঐ তিনজনই ছিল আমার গণভবনের পরিচিত জগৎ।

২৮ দিনের দিন, পড়াতে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে রাসেলের জন্য অপেক্ষা করছি। পার করেছি ভয়াবহ ২৭টি দিন! আজ ২৮ দিনের সুন্দর একটা সকাল! রাসেলের কাছ থেকে চকলেট খেয়ে আর ফুল পেয়ে আমার অনেকটা ভয় এখন কমে গেছে। নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাসও বেড়েছে অনেকখানি। চকলেট ছিল আমার সাহস বেড়ে ওঠার টনিক, আর ফুলগুলো ছিল আগামীদিনের ভালোবাসা আর বিশ্বাসের মূর্তিমান প্রতীক।

আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেই রাসেল এলো। আমার চেয়ারের পিছনে একটা দরজা ছিল, সেটা দিয়েই সে রোজ ঢোকে, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সে ঐ দরজা দিয়েই এলো। বেশ কিছুদিন ধরেই সে নিজের ব্যাগ নিজে নিয়ে আসছে। আগে ফরিদ নিয়ে আসত। আমি ওকে বুঝিয়ে বলার পর থেকে ও এখন নিজেই ব্যাগ নিয়ে আসছে। সেদিন নিজেই ব্যাগটা এনে নিত্যদিনের মতোই ধপাস করে খাবার টেবিলে রেখে দিল। ডান পা’টা ঝুলছে কিন্তু মাটি ছুঁচ্ছে না, আর বাঁ পা’টা ভাঁজ করে চেয়ারের ওপর রেখে ব্যাগের চেইনটা খুলল। চেইন খুলে এক একটা করে বই ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলের ওপর রাখল। এরপর একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে, আমার দিকে তুলে ধরে বলল,

: এইটা আপনার জন্য।
: এটা কী? প্রশ্ন করলাম।
: আগে খোলেন, তবেই দ্যাখবেন। এই বলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। চোখ দুটো আমার দিকে নিবন্ধ। ঠোঁটে আর চোখে লেগে ছিল একটুখানি হাসির আভা। আমি আস্তে আস্তে ভাঁজ করা কাগজটা খুলতে থাকি। খুলে দেখি জলরং দিয়ে আঁকা একটা ছবি। নিচে অপটু হাতে লেখা, ‘আমার আপাকে’।
ছবিটি ছিল- নদী-নৌকো-ঘর দিয়ে একটি গ্রাম বাংলার দৃশ্য।
: ও-মা! কী সুন্দর ছবি! তুমি আমার জন্য এঁকেছো?
: কাইল রাত্রে আঁকছি। আব্বাও দ্যাখছে।
আমি ওর গালে হাত বুলিয়ে আদর করে ছবিটি টেবিলে রাখতে রাখতে বললাম,
: খু-উ-ব সুন্দর হয়েছে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
: ছবিটা বাসায় নেবেন না?
: নেব তো। এত সুন্দর ছবি, তাও আবার আমার জন্য তুমি এঁকেছো, আমি বাসায় নেব না? বাসায় নেব, সব্বাইকে দেখাব আর বলব,
: এ ছবিটা রাসেল আমার জন্যে এঁকেছে।

এখানে উল্লেখ থাকে যে, তখনও আমার বাসার কেউই জানেন না আমি কোথায় বা কাকে পড়াতে যাই। আমি বাসার কাউকেই তখনও বলিনি।

ঘরে আমি আর রাসেল। রাসেল লিখছে। প্রথামতো ফরিদ তিনবার আসে। একবার চা-খাবার দিতে, দ্বিতীয়বার আসে, চা-খাবারের শূন্য পাত্র নিতে, তৃতীয়বার আসে, আমাকে বিদায় দেবার জন্য। ফরিদ চা-খাবার দিয়ে গেল। রাসেলের বাংলা-ইংরেজি পড়া হয়ে গেছে, এবার অংকের পালা। ওকে কয়েকটা অঙ্ক দিয়েছি, ও বেশ মন দিয়েই অংকগুলো করছে। অংকটা হলেই আমাদের ছুটি। প্রতিদিন যেখানে বসি আজও আমি সেখানেই বসা। রাসেলের দিকে তাকিয়ে ওর অংক করা দেখছি। রাসেল আমার বাঁ-দিকের চেয়ারে বসে। অংকে ওর বেশ আপত্তি ছিল, তাই মাঝে মাঝে একটু তাড়া দিতে হতো। আমার বাসায় যাবার সময় হয়ে গেছে, তাই তাড়াটাও একটু বেশি ছিল। হঠাৎ দেখি রাসেল অংকের ওপর পেন্সিলটা রেখেছে ঠিকই; কিন্তু অংক করছে না, মিটমিট করে হাসছে। আর আমি বলে যাচ্ছি,

: আর তো মাত্র দু-তিনটে অংক বাকি আছে, করে ফেলো তাড়াতাড়ি।
রাসেল আমার কথা কানে না তুলে শুধু মিটমিট করে হেসে যাচ্ছে আর আমার মাথার পিছনের দিকে বারবার করে তাকাচ্ছে।
একবার খাতার দিকে চোখ, আবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মাথার পিছনের দিকে চোখ। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।
: আমার পিছনে কি দেখছো তুমি?

ও কিচ্ছু না বলে হেসেই যাচ্ছে মিটমিট করে। এবার আমিই আমার পিছনের দিকে তাকালাম। তাকিয়েই আমি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দেখতে পেলাম ‘মহেন্দ্র নিন্দিত কান্তি উন্নত দর্শন’, এ যেন সপ্তর্ষীম-লের নক্ষত্রদ্বয় বশিষ্ঠ্য আর তার পত্নী অরুন্ধতী দাঁড়িয়ে আছেন। সত্যি বলতে কী, সে-মূহূর্তে আমার সমস্ত বুদ্ধি একেবারেই লোপ পেয়ে গেছে!

আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখে, উনারা দুজনেই হেসে উঠলেন। আমি ঘুরে গিয়ে দুজনকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালাম। সে-মূহূর্তে…

“আলোকে মোর চক্ষু দুটি
মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি,
হৃদগগনে পবন হল
সৌরভেতে মন্থর!”

এর বেশি, ঐ মুহূর্তটিকে আমি রূপ দিতে অপারগ! অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ আমার আত্মাজুড়ে! নিশ্চয়ই কারোই বুঝতে অসুবিধা হবে না, এরা কারা ছিলেন।

এরা ছিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা। তার ডাক নাম ছিল ‘রেণু’। দুজনের ঠোঁটেই উষালগ্নের মহিমাময় অপূর্ব হাসি ঠিকরে পড়ছে। আমি সেথা বাক্যহারা, মাথা নত করা এক টুকরো পাথর। এর আগে ১৯৬৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে এত কাছ থেকে একবার দেখেছিলাম।

সেদিন তিনি আমাদের মাদারীপুরের বাসায় গিয়েছিলেন। সেদিনের অনুভূতি আর আজকের অনুভূতির শিহরণের মাঝে যে বিপুল ব্যবধান টের পেলাম সেই ক্ষণেই। রাসেলের দিকে তাকিয়ে দেখার অবস্থা আমার ছিল না। আমার সমস্ত দেহ-মন-আত্মা যেন কেমন এক নাম না-জানা বিহ্বলতায় জড়িয়ে ধরেছে।

ঐ দিব্য কান্তির সামনে কি করব বুঝতে পারছি না। বলতে পারিনি,

“ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু, তোমার পানে তোমার পানে।”

প্রণাম করে উঠতেই বঙ্গবন্ধু আমার মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়েই বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন,
: তুই! তুই আমার রাসেলের টিচার? রাসেলের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ওরে চেনো নাই?

ওরা দুজনই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অবাক দৃষ্টিতে! দুজনের মুখেই এক টুকরো প্রশান্তির হাসি। রাসেলকে পড়াবার জন্য যেদিন আমি প্রথম উনার সাথে দেখা করেছিলাম, সেদিনই রাসেলের মা অর্থাৎ কাকীমা আমাকে প্রথম দেখেছিলেন। এর আগে আমাকে কখনও দেখেননি, সুতরাং চেনার প্রশ্নই আসে না। এবার বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন,

: কামালের মা, আমি আমার রাসেলের টিচার পেয়ে গেছি, আর চিন্তা নাই। রাসেল, তুমি তোমার টিচার পেয়ে গেছ, আমার আর চিন্তা করতে হবে না। বঙ্গবন্ধুর ঐ চিৎকারে আমিও বিস্মিত! কেমন যেন ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম। উনি কী বলছেন, আমাকে কীভাবে চিনবেন? এ চেনার বিষয়টি বুঝে ওঠার আগেই উনি বলে উঠলেন,
: কী রে তুই তোর ‘কাকীমা’ রে পরিচয় দিস নাই?

শুধু মাথা দুলিয়ে বুঝালাম যে, দেই নাই। সেই মেঘমন্দ্র গলার স্বর বেজে উঠল। রাসেলের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

: তোমাকে ও পরিচয় দেয় নাই, না? ও তো দাদার ভাইয়ের মেয়ে, সাধুদার মেয়ে। ও খুব সুন্দর ফুলের মালা গাঁথে।

আমার শরীর-মন-বুদ্ধি সবকিছু যেন কেমন হয়ে গেছে। এ অনুভূতি প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই।

ভাবছি উনি আমাকে কী করে চিনলেন? যখন উনি বললেন, ‘ও খুব সুন্দর ফুলের মালা গাঁথে’ তখন বুঝতে পারলাম কী করে আমায় চিনতে পেরেছেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তির প্রখরতায় আমি বিস্মিত ও বিমোহিত হয়ে সে-মূহূর্তে থমকে গেলাম। আমাকে চিনতে পারার কাহিনিটুকু একটু সংক্ষেপে না বললেই নয়। তাতে তার স্মৃতিশক্তির প্রখরতার সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।

‘ও তো দাদার ভাইয়ের মেয়ে, সাধুদার মেয়ে।’

‘দাদা’ বলতে আমার জ্যেঠুকে বুঝিয়েছেন। জ্যেঠু তখন বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন (শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার), আর আমার বাবার ডাক নাম হচ্ছে ‘সাধু’। বঙ্গবন্ধু এদের অনেক আগে থেকেই চিনতেন।

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু মাদারীপুর এসেছিলেন।

সে-সময় খানিকক্ষণ তিনি আমাদের মাদারীপুরের বাসায় এসে বসেছিলেন। আগে থেকেই আমাদের জানা ছিল, উনি আমাদের বাসায় আসবেন। তাই, আমার ছোট ভাই ভাস্করের বাসা সাজানোর ইচ্ছে হয়েছিল।

ভাস্কর তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। ও আমাদের ঘরে ঢুকবার দরজাটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তুলল।

সেদিন কিন্তু আজকের মতো এত ‘আয়োজন’ কিনতে পাওয়া যেত না। তারপর, মাদারীপুরের মতো ছোট্ট শহরে ঐসব আয়োজন ভাবাই যায় না। তাই ভাস্কর নিজের বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে ঘরে ঢোকার দরজাটাকে সৌন্দর্য্যময় একটি গেটে রূপান্তরিত করেছিল। ব্যবহার করেছিল টর্চ-এর ছোট ছোট বালব, দেবদারু গাছের পাতা, বিভিন্ন রং-এর টাটকা ফুল, কুঞ্জলতা আর পাটকাঠি। ঠিক হলো বঙ্গবন্ধু যখন বাসায় আসবেন তখন গেটের আলোগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া উনাকে কীভাবে বরণ করা হবে তারও একটা ছক তৈরি করা হয়েছিল।

সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম। সন্ধ্যার দিকে বঙ্গবন্ধু, জ্যেঠু ও মাদারীপুরের কজন সজ্জন ব্যক্তি আমাদের বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। পিছনে বহুজনের বিশাল মিছিল। আমাদের উঠোনটাকে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তুলল। বঙ্গবন্ধুর গলায় বিভিন্ন জিনিস দিয়ে তৈরি মালা তার চিবুক ছুঁয়ে উপচে পড়ছে। আজ আর এই মালার চল নেই বললে চলে।

উনার গলায় ছিল- জরির মালা, বিভিন্ন রঙের কাগজের মালা, লিলি বিস্কুটের (ছোট ছোট গোল গোল বিস্কুট) মালা আর একটু বড় বিস্কুটের মালা।

ফুলের মালার সংখ্যা ছিল খুবই কম। বঙ্গবন্ধু আমাদের দরজার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গলার মালাগুলো খুলে সেøাগানে মুখরিত জনতার হাতে তুলে দিলেন।

বঙ্গবন্ধু বাসায় ঢোকার আগেই গেটের সাজানো আলোগুলো জ্বেলে দেওয়ায়, অনামিক মাদকতায় আচ্ছন্ন ধূসর সন্ধ্যা এক অপরূপ আলোকরশ্মির আবরণে সজ্জিত হলো। বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢুকছেন, ঘরের ভেতর থেকে আমার মা উলুধ্বনি দিচ্ছেন, সাথে আমার ছোট বোন গোপা শঙ্খধ্বনি করে যাচ্ছে, আমার ছোট পিসি (বিজলী দাশগুপ্তা) বঙ্গবন্ধুকে চন্দনের টিপ আর প্রদীপের আলোয় বরণ করার পর, জ্যেঠু (শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার) বঙ্গবন্ধুকে ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন। তিনি আমাদের ঘরে প্রবেশ করলেন। তার আগেই গেটের বালবগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ায় তারাও যেন আনন্দ আর উচ্ছ্বলতায় জ্বলছে আর নিভছে। সে এক মোহনীয় সন্ধ্যার আগমনী, সকলকে মোহময় মোহনায় পৌঁছে দিয়েছিল।

আগেই বলেছি, সেদিনটি ছিল প্রচণ্ড গরম।

বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢুকেছেন। উনার বসার জন্য আলাদা এক চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তিনি এই বিশেষ চেয়ারে না বসে, জ্যেঠুর বেতের ইজিচেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে বসলেন। সে-সাথে বলে উঠলেন-

: উহ! দাদা, কী শান্তি! এতক্ষণ কাগজ আর জড়ির মালায় গলার ছাল-বাকল উঠে গেছে মনে হয়। এত সুন্দর মালা কোথায় পেলেন? উনি গলা থেকে মালাটা খোলেননি, উনার গলায় তখনও মালাটি শোভা পাচ্ছিল।

জ্যেঠু আমাকে ডেকে বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,

: ও গেঁথেছে মালাটা। ও সাধুর মেয়ে গীতালি।

আমি পা ছুঁয়ে প্রণাম করে উঠতেই বললেন,

: তুই তো খুব সুন্দর মালা গাঁথিস! কী ঠাণ্ডা!

আসলে মালাটাকে টাটকা রাখার জন্য মাঝে মাঝে জলের ছিটে আর ভিজে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। সেদিন খুবই ভালো লেগেছিল আমার। এ ঘটনাটা বলার কারণ নিশ্চয়ই বোঝাতে পেরেছি আমি। কতটা স্মৃতিশক্তির প্রখরতা থাকলে একজন মানুষকে জীবনে একবার দেখে এত বছর পরও তিনি চিনতে পেরেছেন! ভাবতেও অবাক লাগে এখন।

এবার ফিরে আসা যাক গণভবনে। এরপর বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

: রাসেল তোরে কোনো ছবি দিয়েছে?
: হ্যাঁ! টেবিলের ওপর রাখা ছবিটা হাতে নিয়ে দেখালাম।
ছবিটা হাতে নিয়ে বললেন,
: কাল রাত্রে রাসেল বিছানায় বসে খুব মনোযোগ দিয়ে এই ছবিটা আঁকতে ছিল। তখন রাজ্জাক আর তোফায়েল ছিল। আমি রাসেলের অত মনোযোগ দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কী করিস? রাসেল বলল,
: আপার জন্য ছবি আঁকি।
: কোন আপার জন্যে?
: নতুন আপার জন্য। সকালে যে আপা আমারে পড়াইতে আসে তার জন্য।
রাজ্জাক আর তোফায়েল বলল,
: নতুন টিচারকে মনে হয় রাসেলের পছন্দ হইছে।
: তখন তোর কাকীমাকে বললাম, তবে তো রাসেলের টিচারকে দেখতে হয়। তুই আমার রাসেলের টিচার!
আমার আর চিন্তা নাই। এরপরই বলে উঠলেন, তুই যে এখানে পড়াতে আসিস দাদা জানে? দাদাকে বলছিস?
আমি ‘না’ সূচক মাথা নাড়লাম। মুখে কোনো শব্দ ছিল না আমার। এ-সময় ‘কাকীমা’ হেসে বললেন,
: তুই তো আমারে বলিসনি ‘মাগো’!

প্রথম দিন কাকীমা আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। আজ পরিচয় পেয়ে ‘তুই’ আর ‘মাগো’ বললেন। আমি দারুণ খুশি ও আনন্দ পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, সুযোগ পেলেই আমাকে ‘আপনি’ না বলতে অনুরোধ করব। সে-সুযোগ এসে গেল বড্ড অভাবনীয় পথে! আর ঐ স্নেহ-মমতায় জড়ানো ‘মাগো’ ডাকটি আমার জন্য ছিল শেষ দিনটি পর্যন্ত।

অন্যদিকে, সেই যে বঙ্গবন্ধু আমাকে ‘কাকীমা’ ডাক শিখিয়ে দিলেন, সেই থেকে শ্রদ্ধেয়া ফজিলাতুন্নেছা আমার কাছে আজও মাতৃসমা ‘কাকীমা’ হয়েই আছেন। আর বঙ্গবন্ধু হয়ে রইলেন ‘কাকা’ জ্যেঠু-বাবার সুবাদে। বঙ্গবন্ধু আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,

: নে পড়া। কোনো কিছুর দরকার হলে তোর কাকীমাকে বলিস। এ-কথা বলে উনারা দুজনে যে-পথ দিয়ে এসেছেন, সে-পথ দিয়েই ভেতরে চলে গেলেন। সেদিন অন্য এক ‘আমি’ বাসায় ফিরে এলাম। এরপরে অনেক ঘটনা ঘটেছিল। এ লেখাটিতে তার আর উল্লেখ করতে চাইছি না।

পড়ানোর দিনগুলো বেশ লম্বা হয়ে যাচ্ছে।

ভালোও লাগছে। প্রায় দু-আড়াই মাস হয়ে গেল। শুধু একটাই একটু অসুবিধা হলো, সেটা হচ্ছে আমার কোনো সাপ্তাহিক ছুটি রইল না। অনেক বুঝিয়েও রাসেলের কাছ থেকে ছুটি মিলল না। সুতরাং, রোজই পড়াতে যেতে হচ্ছে। এমনি একদিন সকালে হাসু আপার (শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) ঘরে রাসেলকে পড়াচ্ছিলাম। পড়াবার সময় ঘরের দরজা ভেজানো থাকত। সেদিনও তাই ছিল। আমাকে চা-খাবার দেওয়ার সময় রমা বা ফরিদ দরজা খুলে খাবার দিয়ে আবার দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেত।

সেদিন খুব ধীরে ধীরে দরজাটা খুলতে দেখে আমাদের দুজনেরই চোখ দরজাটার দিকে পড়ল। দেখি কাকা আর কাকীমা (বঙ্গবন্ধু ও শ্রদ্ধেয়া ফজিলাতুন্নেছা) হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকছেন। আমি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। কাকার গায়ে ছিল স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে ছিল সাদা পাজামা আর হাতে সেই কালো চশমাটি। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই কাকা বললেন,

: ‘মাস্টর’, আমাদের দেখলেই তোর দাঁড়াবার দরকার নাই। তুই তোর জায়গায় বস, বলেই তিনি আমার চেয়ারের পিছনে এসে আমার দু-কাঁধ ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।

উনারা দুজনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি চেয়ারে বসে। কী যে অস্বস্তি তা কীভাবে বলি!

আমি নিরুপায়! আরও বললেন,

: ‘মাস্টর’ তুই তোর ছাত্রকে শেখ সাদীর গল্প বলেছিস, তাই না? সে আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, আমি শেখ সাদীকে জানি কি না? প্রথমে তো বুঝতে পারি নাই, পরে তোর কাকীমার কাছে ঘটনাটা শুনে বুঝতে পারলাম কেন রাসেল শেখ সাদীর কথা জিজ্ঞেস করছে। এবার রাসেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাসেল ভালো করে পড়, তোমার টিচার খুব ভালো টিচার। নে পড় পড়। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে উনারা চলে গেলেন। বুঝতে পারলাম আমার ক্ষুদে ছাত্রটিকে আমি যা বলি বা করতে দেই, স-ব সব সে কাকাকে বলে।

উনারা দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই রাসেল বলে উঠল,

: আপা, শুনছেন, আব্বা আপনারে ‘মাস্টর’ ডাকলো?
: হেসে বললাম, আব্বা আদর করে আমাকে ‘মাস্টর’ ডেকেছেন বুঝলে?

এই ‘মাস্টর’ ডাকটি কাকা (বঙ্গবন্ধু) শেষদিন পর্যন্ত আমায় ডেকে গেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতেও কাকা ঐ ‘মাস্টর’ নামটি ধরে ডেকেই কথা বলেছিলেন। ঐ দিনের পর আমার এই আদরের নামটি ধরে আর কেউ ডেকে কথা বলেনি। কাকীমা (শ্রদ্ধেয়া ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) ডাকতেন, ‘মাগো’ বলে। দুটো নামই আমার একই দিনে, একই সঙ্গে হারিয়ে গেল! আমি আর এই ডাক শুনতে পাইনি! আমি কান পেতে রই, কেননা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অবিরত আজও শুনতে পাই স্নেহসিক্ত আদরের সেই নাম ধরে ডাক দুটো ‘মাস্টর’ আর ‘মাগো’।

আমার সপ্তাহে একদিনও ছুটি ছিল না। রাসেল পড়–ক আর নাই পড়–ক, প্রতিদিন আমাকে যেতে হতো। আমার শাস্তিস্বরূপ রোজ দুটো মিষ্টি খাওয়া আর রোজ ওর কাছে যাওয়া। এ নিয়ম দুটো ছিল রাসেলের নিজের তৈরি, বাসার কারও নয়।

এমনি একদিন সকালে হাসু আপার ঘরে পড়াচ্ছি।

যথারীতি দরজাটা ভেজানো। খুবই মনোযোগ দিয়ে বুঁচু (আমার দেওয়া আদরের নাম) পড়ছে। এর মধ্যে মনে হলো, নিঃশব্দে ধীরে ধীরে দরজাটা খুলতে শুরু করেছে। রমা ওরা এলে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে।

দরজা খোলার ভঙ্গি দেখে রমাদের মনে হচ্ছে না। আমি রাসেলের হাতে আস্তে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই রাসেলের চোখ দুটোও ঐ দরজাটার দিকে গেল। এখানে উল্লেখ না করে পারছি না, যখন আমি রাসেলকে পড়াতাম ওর ছোট্ট বাঁ-হাতখানা আমার ডান হাঁটু ছুঁয়ে থাকত। ওর ঐ স্পর্শে আমি অনুভব করতে পারতাম, ওর ছোট্ট মনের মধ্যে আমার জায়গাটা আর কতটা গভীর ভালোবাসা!

আমরা দুজনেই তাকিয়ে আছি দরজার দিকে। রাসেল আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু জোড়া নাড়িয়ে ইশারা করে যাচ্ছে। অর্থ, কে বা কি হতে পারে? দেখি হাতে কালো পাইপ, সাদা পাজামা, আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা কাকা (বঙ্গবন্ধু) পড়ার ঘরে ঢুকলেন। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই বলে উঠলেন,

: তোরা টের পেয়ে গেছিস? বলতে বলতে উনি আমার চেয়ারের পিছনে এসে আমাকে বসিয়ে দিয়ে বললেন, তোর উঠতে হবে না মাস্টর, তুই তোর জায়গায় বস। এবার রাসেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাসেল ঠিকমতো পড়াশোনা করছো তো?

পরীক্ষা কবে? টিচারের কথা শুনিস তো? এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর কথা রাসেল শুনছে তো?

মনে মনে বললাম, ও যে কী করে, তা তো আমিই জানি! কিন্তু মুখে বলতে হলো,

: শোনে, বলে একটুখানি হেসেছিলাম।

কেন হাসলাম এর জবাব আমাকে পরে দিতে হয়েছে। কার কাছে সেটা বলতে হবে না নিশ্চয়ই?

কাকা বললেন,

: ভালো করে পড় রাসেল। তোমার টিচার খুব ভালো টিচার! গীতালি শুধু তোমারই টিচার না, ও আমারও টিচার!

অবাক বিস্ময়ে দুজনেই উনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন। এ-কথা বলে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কাকা বেরিয়ে যেতেই, রাসেল আমাকে প্রশ্ন করে উঠল,

: আপা, আপনি কি আব্বারেও পড়াইছেন?

হেসে বললাম,

: না বুঁচু। আমি পড়াইনি।
: আব্বা যে বলল, আপনি আব্বারও টিচার।
: কাকা আদর করে দুষ্টুমি করেছেন, বুঝলে?

এ-কথাটি কাকা পরেও মাঝে মাঝে আমায় বলতেন। কিন্তু আমি আজও ভেবে এর উত্তর পাইনি, কেন তিনি আমায় তার টিচার বলতেন! আজও কাকার এ আশীর্বাদতুল্য ‘উপহার’ মাথায় তুলে পথ চলেছি।

কাকা যখন বাসায় ফিরতেন, নিচের থেকেই তার গলার আওয়াজ ওপরে শোনা যেত। এছাড়া বাঁশির হুইসেল তো রয়েছেই। উনার সাথে বেশ লোকও থাকত। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে সাথে থাকা দলীয় লোকদের সাথে কথা বলতে বলতে উঠতেন। এ সময় আমার বুঁচু (রাসেল) সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এমনি একদিনের কথা বলেছি, আমি ওকে পড়াচ্ছি, এ সময় কাকা বাসায় এসেছেন।

: ঐ যে আব্বা আসছে, বলেই ভোঁ দৌড়।

একটু পরেই দেখি, কাকা রাসেলের ঘাড়ে হাত রেখে সোজা আমাদের পড়ার ঘরে এসে ঢুকলেন।

: মাস্টর, তোর ছাত্রকে নিয়া এলাম। ও পড়ে না? ও পালায় ক্যান মাস্টর? অরে আটকাইয়া রাখতে পারিস না?
: ও তো পালায় নাই কাকা, আপনি আসছেন তাই ও আপনার কাছে গেছে।
: বুঝলাম। ও তোর পারমিশন নিয়ে গেছে? এবার রাসেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাসেল তুমি যখন গেলে তখন তোমার টিচারের পারমিশন নিছিলা?

আমরা দুজনেই চুপ করে আছি। পারমিশনের কথা রাসেলের টিচারের মাথাতেই তো আসে নাই, ছাত্রের মাথায় আসবে কী করে? দুজনেই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছি। কাকা বুঝতে পারলেন ঘটনাটা। তাই রাসেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

: রাসেল, টিচারের পারমিশন ছাড়া আর কখনও পড়ার ঘর থেকে বের হবে না। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোকেও বলছি মাস্টর, তোর পারমিশন ছাড়া ও যদি এ-ঘরের বাইরে যায়, তবে তুই ওকে শাস্তি দিবি। এ আমি তোদের দুজনকেই বলছি।

এরপর, যথারীতি তিনি আমার দু-কাঁধ ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিতে দিতে ওই একই কথা বললেন,

: মাস্টর, তুই দাঁড়াইয়া আছিস ক্যান? তোর জায়গায় তুই বস। এই বলে কাকা বেরিয়ে গেলেন।

সে-মূহূর্তে বা সে-সময় এত গভীরভাবে চিন্তা করতে চেষ্টা করিনি। আজ যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবি, শুধু বিস্মিত হই না, বিমুগ্ধ চিত্তে শ্রদ্ধায় নত হই। এ-কথা লিখতে গিয়ে ছোটবেলায় পড়া একটি কবিতার কথা বলতে হচ্ছে। দিল্লির বাদশা দেখেছিলেন তার পুত্র তার শিক্ষকের পায়ে জল ঢেলে দিচ্ছে, আর শিক্ষক আপন হাতে নিজের পা পরিষ্কার করে যাচ্ছেন। বাদশা এটা দেখে পরের দিন শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে শিক্ষক বাদশার কাছে যাবার সময় অনেক যুক্তি তৈরি করতে থাকেন। কিন্তু শিক্ষকের সমস্ত তৈরি যুক্তি ধূলিসাৎ হয়ে গেল বাদশার প্রশ্নের কাছে। বাদশা শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলেন,

“পুত্র আমার আপনার কাছে
সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর
গুরুজনে অবহেলা,
নইলে সেদিন দেখিলাম আমি
স্বয়ং সকাল বেলা।”

এখানেও আমি সেই একই জিনিস দেখতে পেলাম। ভাবছি, একটা দেশের প্রধান হয়েও সন্তানের সৌজন্যবোধ আর শিষ্টাচারের শিক্ষা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। পিতার দায়িত্ববোধ সম্পর্কেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। ভুলে যাননি তিনি রাসেলের পিতা!

উনি পড়ার ঘরে এলে আমি কোনোদিন চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে পারিনি। দাঁড়ালেই কাকা আমায় বসিয়ে দিতেন। আজ বুঝতে পারছি, তিনি শিক্ষা ও শিক্ষকের সম্মান কীভাবে দিতেন! উনি শিক্ষককে সম্মান করেছেন যেমন সত্যি, ঠিক ততটাই সত্যি, উনি আমার অন্তঃস্থলের গভীর শ্রদ্ধা ও নিমগ্ন ভালোবাসাটুকু অধিকার করে নিয়েছেন।

এই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ক’জন জানেন?

ক’জনই বা চিনতে পেরেছেন তাকে? তাকে চিনতে ও জানতে পারাটা তিনি নিজেই আমায় সহজলভ্য করে দিয়েছিলেন বলেই না, খুব সামান্য হলেও চিনতে পেরেছি আমি। সেদিন, তার মতো মহানকে চিনতে ও জানতে পারার গভীরতা আমার ছিল না। এখন স্মৃতির সাগরে ডুবুরি হয়েছি। ডুব দিয়ে যেটুকু রতœসম্ভার উঠাতে পারছি, আমৃত্যু সেটুকুই আমার চির সম্পদ হয়ে থাকুক।

কাকার সাথে দেখা হলে প্রায়ই খুনসুটি হতো।

সেটার একটু সামান্য ইঙ্গিত না দিয়ে পারলাম না। এ ইঙ্গিত থেকে বুঝতে পারা যাবে তিনি কতটা রসবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। কাকা যখন বাসায় থাকতেন, আমি কোনোদিন তার সাথে নিজের থেকে দেখা করতে পারিনি। উনি নিজেই চলে আসতেন পড়ার ঘরে। এমনকি, শত কাজের পর, যখন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতেন, আমি তখনও পড়াচ্ছি জানলেই তিনি হাসিমুখে তার দেওয়া ‘আ’-কার ছাড়া ‘মাস্টর’ নামটা ধরে ডেকে পড়ার ঘরে এসে ঢুকতেন। ঐ ডাকটার মধ্যেই ছিল আমার প্রতি তার গভীর স্নেহ আর মমতার অভুক্ত বহিঃপ্রকাশ। আর একটা জিনিস তিনি আমার সাথে করতেন, সেটা হলো চোখে-মুখে রাগের ভান করে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকতেন। মনে হতো তিনি আমার ওপর অনেক অনেক রাগ করেছেন। ঐ বাঁকা চাহনিতেও ঝরে পড়ত স্নেহের অমিয় ধারা। আমি সেটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে বেশ মজা পেতাম। আমার কাছে এ চাহনিটি ছিল বড় আনন্দের। ঐ তাকাবার ভঙ্গি আর ঐ ‘আ’-কার ছাড়া ‘মাস্টর’ ডাকটার মাঝে যে কি লুকিয়ে ছিল তা বর্ণনা করতে আমি অপারগ। আজও অনুভবে অভাববোধ করি। তবে, ঐ চাহনি, ঐ ডাক, আপনার মাঝে আজও দেখতে ও শুনতে পাই!

কাকা পড়ার ঘরে এসে রাসেলের পড়ার খবর নিতেন, সে-সঙ্গে আমার ও আমার পরিবার-পরিজনের কথাও জানতে চাইতেন। এ-সময়টাতে হতো খুনসুটি।

কাকার সাথে বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা ও মজার তর্ক (খুনসুটি) হতো আমার। বেশ ভালোই তর্ক করতাম দুজনে। যখন কাকা হেরে যেতেন তখন তিনি আমার দিকে ঐ বাঁকা চাহনিটি ছুড়ে দিতেন। ওই চাহনিতে লুকিয়ে থাকত সন্তানের কাছে হার হবার এক অপরূপ সৌন্দর্যের আলোকরশ্মি। মাঝে মাঝে কাকীমাও সঙ্গে থেকে এ আনন্দযজ্ঞের অংশীদার হতেন। আর আমার বুঁচু? সে তখন তার আপার জয়ের আনন্দে মজা লুটে নিয়ে বলত,

: আপু, আপনার সাথে আব্বা পারল না।

আমি সে-সময় স্নাতকোত্তরের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। ক্লাসে নতুন নতুন অনেক কিছুই শিখিছ-জানছি। যেমন : রবি ঠাকুর, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র এমন অনেকের সম্পর্কে। স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ে যেমন করে এই খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি, এর আগে এমন করে জানতে বা বুঝতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানী-বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ শিক্ষকদের কাছ থেকে এই খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের সম্পর্কে কতই না নতুন নতুন তথ্য, আলোচনা-সমালোচনা শুনতাম, জানার আগ্রহ নিয়ে নিজের মধ্যে লালন করতে চেষ্টা করতাম।

কাকার সাথে এদের নিয়ে যখন আলোচনা হতো, আমি তখন নব্য শেখা জ্ঞান দিয়ে তাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করতাম। কাকা শরৎচন্দ্রকে খুবই পছন্দ করতেন, তাই শরৎচন্দ্রের পক্ষে তার অকাট্য যুক্তি থাকত। আমি বঙ্কিমচন্দ্রকে পছন্দ করতাম বলে, আমার যুক্তি থাকত বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে। এভাবেই বেশ খানিকক্ষণ চলে যেত দুজনের মহা-আনন্দে মাখা মুহূর্তটুকু। আজ উপলব্ধি করতে পারি, সে মুহূর্তটুকু ছিল স্নেহময় পিতা আর স্নেহধন্যা কন্যার মধ্যে অদৃশ্য এক নিবিড় বন্ধন। রাসেল এ-সময়টা দারুণভাবে উপভোগ করত। একটা সময় কাকা বলে উঠতেন,

: দাঁড়া, বইগুলো আবার পড়ে নেই, তারপরে তোর সাথে ঝগড়া করতে বসব।

হেসে বলেছি,

: সেই ভালো কাকা। তা-ও তো আর একবার পড়া হবে বইগুলো।

কাকা সেই বাঁকা চাহনিখানা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন। আশ্চর্যের বিষয় এটাই, আমি এতক্ষণ কার সাথে তর্ক করলাম, সে-বিষয়ে আমার কোনো অনুভূতিই থাকত না! উনি যখন সেই স্নেহময় চাহনিখানা দিয়ে বেরিয়ে যেতেন, আমার অনুভূতিতে উপলব্ধ হতো পিতৃস্নেহের নির্মল পরশ।

এখন এ-কথা কি কেউ বিশ্বাস করবেন? কিন্তু আমি আজও এ সত্যের মুখোমুখি হয়ে আপন ভুবনে বিচরণ করে যাচ্ছি। আজ বড় বিস্ময় লাগে! ভাবি, কার সাথে আমি সেদিন তর্ক বা খুনসুটি করেছি বারবার! তিনি বিন্দুমাত্র রাগ কিংবা অহংকার দেখাননি। বুঝতেও দেননি উনার বিশাল অস্তিত্বের পরিধি; বরং আমায় উৎসাহ দিয়ে বলেছেন,

: দাঁড়া, বইগুলো আবার পড়ে নেই। তারপর তোর সাথে ঝগড়া করব।

কতটা বড় মনের মানুষ ও উদার হলে এমন কথা বলতে পারেন!

এবার আর একদিনের কথা বলছি। রাসেলের বইগুলোর মধ্যে এমন কতগুলো বই ছিল, যা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রয়োজন। আমার যেটা মনে হতো রাসেলের জন্য ভালো ও দরকার, তখন আমি দু-একটা সেই ধরনের বই মাঝে মাঝে কিনে আনতাম। এমনি কোনো একটা বইয়ের মধ্যে ‘ইলিশ ও কৈ’ মাছের ছবি ছিল। এই ছবি দেখে আমি বলেছিলাম,

: এই রে, এই দুটো মাছ খেতে দারুণ মজা! তাই না বুঁচু? যেমন মজা ইলিশ মাছ তেমন মজা কৈ মাছ!

: আপু, আপনি ইলিশ মাছ আর কৈ মাছ ভালো খান?

: খু-উ-ব ভালো খাই। কেন তুমি খাও না?

মাথাটা ওপর নিচ করে নেড়ে বলল,

: খাই, তবে অনেক কাঁটা। মা যদি কাঁটা বাইচ্ছা দেয়, তবে ইলিশ মাছ খাই। কৈ মাছ খাই না। বলেই না সূচক মাথাটা দুলিয়ে নিয়ে আবার বললে, কৈ মাছে বেশি কাঁটা।
: তা ঠিক। তবে দুটো মাছই খেতে ভালো। তুমি যখন বড় হয়ে কাঁটা বাছতে শিখবে, তখন খাবে। দেখবে কী মজা!
: আপু, আমি তো কাঁটা বাছতে পারি না।
: এখনের কথা বলেছি না! তুমি তো এখনও ছোট, বড় হলে পারবে। বুঝতে পেরেছ?

আমার বুঁচুর মুখে সুন্দর এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। আমাদের ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে কী সব গল্পই না হতো! এখন এগুলো ভাবলে হাসিও পায়, চোখটাও অবাধ্য হয়ে ওঠে।

পরের দিন পড়াতে গেছি, বুঁচুর প্রথম কথা,
: মা যেন আপনারে কি বলবে।
: কি বলবেন কাকীমা? তুমি কী জানো?
সুন্দর একখানা হাসি দিয়ে, সুর করে টেনে টেনে বলল,
: জানি, তবে আমি বলব না, মা-ই আপনারে বলবে।

একটু চিন্তা হচ্ছিল আমার! ভাবলাম আবার আমি কী করলাম রে বাবা! এ তো পাগল! কী দিয়ে আবার কী বলেছে কাকীমার কাছে কে জানে? এমনিতেই তো কাকীমার কাছে আমার নামে নালিশের অন্ত নাই।

আবার কোন নালিশ, কে জানে? লজ্জায় না পড়লেই হয়। মাথার মধ্যে এমনি নানারকম চিন্তা করতে করতে পড়াচ্ছি। পড়া শেষ। এবার আমার বাসায় ফেরার পালা। বই গুছিয়ে রেখে, রাসেল গিয়ে কাকীমাকে ডেকে নিয়ে এলো। কাকীমা হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে আমাকে বললেন,

: তুই না-কি ইলিশ মাছ আর কৈ মাছ ভালো খাস?

তোর দাওয়াত এই সপ্তাহের ছুটির দিনে (আজ মনে নেই, শুক্র না রবিবার তখন সাপ্তাহিক ছুটি থাকত)।

তুই দুপুরে রাসেলের সাথে খাবি, আর একবারে পড়াইয়া বাসায় যাবি।

আমি রাসেলের দিকে তাকালাম। খুশির হাসিতে তার মুখখানা ভরে উঠেছে। কালো চোখে দুষ্টুমি খেলে যাচ্ছে। ভাবখানা, ‘ক্যামন মজা হইছে এ্যাখন?’

কাকীমার মুখের ওপর না করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাই রাজি হয়ে গেলাম ইলিশ আর কৈ মাছ খাবার জন্যে। এই দাওয়াতের চিন্তা করতে করতেই সেই দিন বাসায় ফিরলাম।

নির্ধারিত দাওয়াতের দিনটি বড্ড তাড়াতাড়ি এসে গেল। যেহেতু সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে নিজের কিছু পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজের জন্য রাসেলের বাসায় যেতে একটু দেরি হয়ে গেল। গিয়ে দেখি, খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসে গেছে। যেহেতু ছুটির দিন তাই কাকাও (বঙ্গবন্ধু) আছেন টেবিলে। দেরি হয়ে যাওয়াতে আমিও বেশ লজ্জা পাচ্ছিলাম। মনে মনে খানিকটা অস্বস্তিবোধ করছিলাম। কাকা বলে উঠলেন,

: ‘মাস্টর’ আইছিস। দেরি করলি ক্যান? তোর ছাত্র তোর জন্যে না খাইয়া অপেক্ষা করছিল। তোর কাকীমা জোর করে রাসেলকে খাওয়াইছে। আয় খাইতে বস। এরপর রাসেলকে বললেন, রাসেল তোমার টিচারকে বসতে দাও।

এর মধ্যে জামাল আর রেহানার খাওয়া শেষ। ওরা উঠে পড়ল। রমা জায়গা পরিষ্কার করে দিল। আমার বুঁচু তো মহাখুশি। সে আমাকে বলল,

: আপু, এইখানে বসেন।

ওর দেখানো জায়গায় আমি বসলাম। রমা আমার সামনে থালা-গ্লাস দিতে দিতে বলে উঠল,

: আপা, আপনার থালা-গ্লাস রাসেল ভাই আগেই ধুইয়া রাখছে।

কাকা বলে উঠলেন,

: রাসেল ধুইছে মাস্টরের থালা গ্লাস?

কাকীমা হাসতে হাসতে বললেন,

: এখন তো গীতালির পানির গ্লাস রোজ রাসেল ধুইয়া রাখে। রমারে ধুইতে দেয় না।

এখানে একটু বলি, আমি রোজ ও বাসায় গিয়ে এক গ্লাস জল খেতাম। সেই গ্লাসটির কথাই কাকীমা বলেছেন। কাকীমার কথা শুনে কাকা বেশ জোরে বলে উঠলেন,
: খুব ভালো রাসেল, খুব ভালো!

বুঁচুর কথামতো ওর পছন্দের জায়গাতেই বসলাম। কাকীমা নিজেই আমার থালায় ভাত তুলে দিচ্ছেন। সে-সময় ‘আমি উঠলাম’ বলে কাকা উঠে গেলেন।

কাকীমার খাওয়াও শেষ; কিন্তু কাকীমা না উঠে আমাকে খাবার তুলে দিচ্ছেন। কাকা ওঠার আগে বললেন,

: মাস্টর, তুই না-কি কৈ মাছ খুব পছন্দ করিস, তাই আইজ আমরা সবাই কৈ মাছ দিয়া খাওয়া শেষ করলাম।

আমি কাকার দিকে না তাকিয়ে বললাম,

: আমারটা আছে তো? না-কি দেরি করে আসছি বলে সব কটা মাছ খাওয়া হয়ে গেছে?

কাকীমা হেসে দিলেন। আর কাকা? ঠিক বুঝলেন কথাটা কার উদ্দেশ্যে বলেছি। তাই তিনি না হেসে জোরে জোরে বলা শুরু করলেন,

: রাসেল, তোমার টিচারের কৈ মাছ কোথায়? যাও নিয়া আসো। অরটা যে আছে, সেটা ওরে দেখাও। এ-কথা বলে কাকা নিজেও হাসতে হাসতে উঠে গেলেন।

এর মধ্যে রমা আমার কৈ মাছ নিয়ে এলো। একটা কাঁধ উঁচু কাচের প্লেটে একটা নয়, বেশ বড় দুটো মাছ শুয়ে আছে, আর তার ওপরে পিঁয়াজের বেরেস্তা ছড়ানো আর দুটো কাঁচামরিচ দিয়ে সাজানো ছিল। তখন আমি রান্না বা কোনোটাকে কি রান্না বলে, তার নামও জানতাম না। এখন মনে হচ্ছে, সেদিন কৈ মাছের দোপেঁয়াজা ছিল। মসলাগুলো মাছের গায়ে মাখানো আর মাছ দুটো তেলের মধ্যে শোভা পাচ্ছিল।

রমা মাছের প্লেটটা আমার সামনে রাখতেই, কাকা বলে উঠলেন,

: তোর মাছ তো আমারটার চেয়েও বড় মাস্টর! এরপর একটু টেনে টেনে বললেন, তার উপরে দু-ই-টা! এই কথা বলে, কাকা হাসতে শুরু করলেন।
: এর উত্তরে কাকীমা হেসে বললেন, রাসেল অর আপার জন্য বাইচ্ছা রাখছে।
: তাই না-কি? এই বলে কাকা মুখ ধুতে চলে গেলেন।

কাকীমা আমার পাশের চেয়ারে বসে আমাকে পরিবেশন করছেন, রাসেল তো রয়েছেই। এবার মুখ ধুয়ে কাকা এসে বসলেন। আমার যে কী অবস্থা তখন!

আমি বলে বুঝাতে পারব না! ভাবছি, কোন কুক্ষণে যে বলতে গেলাম ‘কৈ মাছ আর ইলিশ মাছ ভালো খাই!’ খাব কি আমি?

: কাকা বলছেন, কামালের মা ওই মাছটাও দাও। এদিকে আমাকে বলছেন, দেখিস মাস্টর কাঁটা না ফোটে গলায়, সাবধানে খাস।

কাকা, কাকীমা আর রাসেল তিনজন আমাকে আপ্যায়ন করে যাচ্ছেন, আমি কীভাবে খাচ্ছি তা আমিই জানি! কাকা কাকীমা দুজনেই জোর করছেন দুটো মাছ খাবার জন্য। ভদ্রতা বলে তো একটা কথা আছে! সুতরাং, একটা মাছ আর অন্যান্য তরকারি দিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। ইচ্ছে থাকলেও অত বড় লোভনীয় মাছটা রেখে আমায় উঠতে হলো।
খাওয়া শেষে রাসেলকে পড়াতে বসেছি। বুঁচুর প্রশ্ন,

: আপনি ক্যান একটা মাছ খাইলেন?

নতুন উপদ্রবের কথা ভেবে, সত্যি কথাটি না বলে অন্যভাবে উত্তর দিলাম,

: অত বড় দুটো মাছ কি একবারে খাওয়া যায়? আমি কী রাক্ষস? তাছাড়া অন্য তরকারিও তো ছিল। আমি খু-উ-ব ভালো খেয়েছি বুঁচু। তবে এ-রকম আর কক্ষনো করো না। আমি খুব লজ্জা পাই!

উনাদের কাছ থেকে কতটা যে স্নেহ আর আদর পেয়েছি তা বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। কাকার এই রসিকতা আর দুষ্টুমির কথা যখন মনে ভাবি বা কারও কাছে বলতে শুরু করি, সে-মুহূর্তে আমি হারিয়ে যাই জোয়ার-ভাটার মতো হাসি-কান্নার তীব্র খরস্রোতা ঘূর্ণায়মান বেদনার নীল অতল প্রান্তে। যারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গ পেয়েছেন, তারা সকলেই আমার সাথে সহমত পোষণ করবেন বলেই আমার দৃপ্ত বিশ্বাস!

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার অনেক ঘটনাই ঠিক, তবে-

“যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে
চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।”

তাই আঁকার চেষ্টা করছি। আর সে-জন্যেই আর একটা ঘটনার কথা খুব মনে হচ্ছে। এ ঘটনাটি না বললে আমার লেখা যে অপূর্ণ থেকে যাবে। তাই, এ-ঘটনাটি না বলে পারছি না যে!

পৃথিবীর বুকে এমনি ঘটনা ঘটেছে বলে আমি শুনিনি বা আমার জানা নেই! অবিশ্বাস্য হলেও যে পরম সত্যি। বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী মহীউদ্দীন ভাই সে ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন। সে-সময় কাকার সাথে যারা ছিলেন আমি সকলকে চিনতাম না, শুধুমাত্র মহীউদ্দীন ভাইকেই চিনতাম। ঘটনাটা এমন ছিল-

কিছুদিন আগে আজকের রাসেল স্কোয়ার থেকে বত্রিশ নম্বর রোডে রিকশা চলাচল সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। কাজেই ঐ রোডে কোনো রিকশা যাচ্ছে না। প্রথম দিন একটু ধাক্কা খেয়েছি। পুলিশ আমার রিকশা আটকে আমাকে হেঁটে যেতে বলে। আমি রিকশা ছেড়ে ঐ বাসায় হেঁটেই গিয়েছি। এরপর আমি প্রতিদিন ঐ রাসেল স্কোয়ারের কাছে নেমে হেঁটেই পড়াতে যেতাম। এমনি একদিন বিকেলের দিকে আমার রিকশা রাসেল স্কোয়ার পর্যন্ত আসার আগেই বাঁশির হুইসেল শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম কাকা বাসা থেকে বের হয়েছেন। তাই, বত্রিশ নম্বর রোড পর্যন্ত রিকশাটা না নিয়ে একটু দূরে লেকের পাড়ে দাঁড় করালাম। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। রিকশাওয়ালাও দাঁড়িয়ে আছেন আমার সাথে। বত্রিশ নম্বর রোড থেকে গাড়ির বহর বের হয়ে ডান দিকে যেতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে দেখি পতাকা লাগানো গাড়িখানা মিরপুর রোডে এসে থেমে গেল। আমি দেখলাম গাড়ির পিছনের জানালার কাচটা খুলে বঙ্গবন্ধু হাতের ইশারায় কাকে যেন ডাকছেন। আমি বুঝতে পারছি না কাকে ডাকছেন।

তাই চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি উনি কাকে ডাকছেন। এর মধ্যেই দেখি মহীউদ্দীন ভাই গাড়ি থেকে নেমে আমার কাছে এলেন। এসে আমাকে বললেন,

: আপনাকে বঙ্গবন্ধু ডাকছেন।

আমার তো তখন কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়! এর মধ্যে আমার মাথায় অনেকগুলো ভালো-মন্দ প্রশ্নের জন্ম হয়ে গেছে! মহীউদ্দীন ভাইয়ের সাথে ধীরে ধীরে গাড়ির কাছে এগিয়ে গেলাম। গাড়ির পিছনের জানালার কাচ তেমনি খোলাই রয়েছে। সেই জানালা দিয়ে কাকা আমাকে ডাকলেন। আমি আদাব জানিয়ে জানালার কাছে গিয়ে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কাকার কথা শুনবার জন্য। কাকা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

: তুই হেঁটে আসছিস? তুই রিকশায় আসিস নাই?
: আমি রিকশায় আসছি কাকা।
: তাহলে তুই হেঁটে যাস ক্যান? তোর রিকশা কোথায়?

ব্যাস! আমি যে ভয়, যে চিন্তা মাথায় নিয়ে কাকার গাড়ি পর্যন্ত এসে ছিলাম তা নিমেষেই উবে গেল। সেখানে নতুন করে জন্ম নিল দুষ্টুমি। আগেই বলেছি, আমি আর কাকা দুজনেই দুজনের সাথে মজা করতাম। তাই হলো সেই সময়। আমি যে রিকশাতে এসেছিলাম সেটা তো তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। আমি কাকাকে রিকশাটা দেখিয়ে হেসে বললাম,

: বত্রিশ নম্বর রোডে একটা জমিদার বাড়ি আছে,

রিকশাটা তো আমি হাতে করে নিয়ে যেতে পারব না!
অগত্যা…!

আমার দুষ্টুমি ঠিক বুঝতে পেরে সেই রাগরাগ মুখ করে বাঁকা চাহনিখানা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে মহীউদ্দীন ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

: মহীউদ্দীন, সব গার্ডদের বলে দিবি, কাল থেকে ওর রিকশা বাসা পর্যন্ত যাবে। ওর রিকশা যেন আটকানো না হয়। এ-কথা বলে আমার দিকে আবার ঐ চাহনিখানা ছুড়ে দিয়ে গাড়ির জানালার কাচ উঠাতে শুরু করলেন।

এটুকুন সময়ের মধ্য আমি দেখলাম, গাড়িতে যারা ছিলেন তারাও এই দুষ্টুমির আনন্দ উপভোগ করেন মিষ্টি অথচ নিঃশব্দ হাসির মাঝে। যদিও এ-সুযোগ আমি কখনও নেইনি। হেঁটেই পড়াতে যেতাম।

কতটা ভালোবাসা, কতটা স্নেহ আর কতটা রসিকতাবোধ থাকলে এমন করতে পারেন একজন রাষ্ট্রপ্রধান! হয়তোবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজে তিনি যাচ্ছিলেন। আমি হেঁটে যাচ্ছি, তাই দেখে তার খারাপ লেগেছিল বলেই না গাড়ির বহর থামিয়ে আমায় কাছে ডেকে জানতে চাইলেন! অথচ, আমি তার ছেলের গৃহশিক্ষক মাত্র!

আজ ভাবতে বড় বিস্ময় জাগে! আমি সেদিন কার সাথে এতটা দুষ্টুমি আর রসিকতা করেছি বা করতাম! তিনি কখনও বিন্দুমাত্র রাগ বা বিরক্তবোধ করেননি। উল্টো আমার উৎসাহ বাড়াতে বলেছেন, ‘দাঁড়া, বইগুলো আবার পড়ে নেই। তারপর তোর সাথে ঝগড়া করব।’

কত্ত বড় মনের অধিকারী থাকলে এমন কথা বলতে পারেন? আকাশের মতো উদারতা আর নির্ঝরের মতো স্নেহ ধারায় পূর্ণ ছিল ঐ ‘মহাত্মার’ হৃদয়! তাই বাংলার মানুষের দুঃখ-কষ্ট আপন হৃদয় দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন। বাঙালি জাতিকে, বাংলার মানুষকে তার অপার ভালোবাসায় করেছেন অভিষিক্ত। বাঙালি জাতির সংকট মূহূর্তে ফুঁসে উঠেছে তার রুদ্রদ্রোহ। বন্ধুর পথ উপেক্ষা করে চলেছিলেন বাঙালি জাতিকে নতুন ঠিকানায় পৌঁছে দিতে। তার এই মহৎ উদ্দেশ্য স্বার্থক রূপ নিয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালি জাতি পেয়েছে এক বর্ণাঢ্য আপন ভূমি। যার নাম ‘বাংলাদেশ’।

হে পিতা, আজ তোমার শততম জন্মদিন। এতগুলো বছর কেটে গেল, তোমার মতো আর একজন নেতার তো আজও জন্ম হলো না এই বাংলার বুকে? তাই বলছি, তুমি ক্ষণজন্মা পুরুষ! শুধু তাই নয়, তুমি একজন দক্ষ শিল্পীও বটে! বাংলার আঁধার সরিয়ে, কী অপূর্ব সবুজের আস্তরণে মহাবিশ্বের মানচিত্রের বুকে এঁকে দিলে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের আলোকোজ্জ্বল নামখানি! অসীম তোমার মহিমা, কী গভীর তোমার দেশপ্রেম!

আমি একান্তে নিমগ্নচিত্তে দেখতে পাচ্ছি- সম্মুখে বিশাল সমুদ্র, বুকে নেই রুদ্রের আনন্দ নৃত্য, মহাকাশের সীমান্ত, বারিধীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ, তার মাঝে নতুন প্রভাতের রক্তিম আভা প্রতিভাত! সূর্যোদয়ের মহাক্ষণ! চারপাশে সুউচ্চ পাহাড় সবুজের আবরণে বেষ্টিত! ঝরনার ছন্দময় নৃত্য! সেই পাহাড়-পর্বত-বনভূমি আর আকশ-সমুদ্র মিলনের সন্ধিস্থল থেকে উঠে আসা আর একটি নতুন প্রভাতের জন্ম সূচনা! সেই ব্রাহ্মমূহূর্তে শুনতে পাচ্ছি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উদ্গীত কণ্ঠে উদাত্ত চিত্তে দেশমাতৃকার প্রশস্তি বন্দনা…

“অহনার আলোকে স্নাত,
আজানু লম্বিত কৃষ্ণ কেশদামে ঢাকা পিঠ,
উষসীর চন্দন রং তোমার সর্ব অঙ্গজুড়ে,
পরনে তোমার উষালোকের সাগর রঙের শাড়ি।

প্রথম প্রভাতের আলো
রাঙিয়ে তুলেছে তোমার কপোল,
ভালে জ্বলছে জবা কুসুমের রক্তিম রঙে
আঁকা মধ্যাহ্নের দীপ্ত সূর্য,
সে রঙে রঞ্জিত তোমার সীমান্ত।

হাতে তোমার কনকচাঁপার বলয়,
কানে তোমার ধুতরার ঝুমকো,
গলায় দুলছে গুঞ্জা ফুলের মালা,
কৃষ্ণ কেশদামে রেখেছো অস্ফুট বনফুলের গুচ্ছ।
পদ্মরাঙা পা রয়েছে
শিশির সিক্ত শিউলি আর সবুজ দূর্বাদামে।
ঠোঁটে এঁকেছো সূর্যোদয়ের
এক টুকরো মিষ্টি রোদের হাসি।
চারিদিকে তোমার সবুজ ফসলের সমারোহ!
এক অপূর্ব মোহনীয়া রূপে দাঁড়িয়ে তুমি!
এ রূপের আভায় আমি নির্বাক, আমি বিমূঢ়!
অনুভব করি লবণাক্ত অশ্রুবিন্দুর আবির্ভাব।
অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,
তুমি কে! কে তুমি?
সে স্বরে জেগে উঠি ‘আমি’!
মনের মাঝে প্রদীপ্ত হয়ে প্রতিভাত হয়,
রক্তস্নাত আলোকিত জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি
আমার বাংলাদেশ! মা আমার!!
মাগো তুমি, ‘স্বর্গাদপী গরিয়সী’!!
(মা আমার।)
হে পিতা, ‘তোমায় করি গো নমস্কার’।

লেখক : ১৯৭২ থেকে ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত রাসেলের গৃহশিক্ষিকা; পরে অধ্যাপনা করে অবসর নিয়েছেন। এখন সিডনি প্রবাসী

সৌজন্যেঃ উত্তরণ (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত