বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রশ্নে শেখ মুজিব

3678

Published on জানুয়ারি 25, 2021
  • Details Image

১৯৫২ সালে নূরুল আমীন সরকার প্রাদেশিক আইন পরিষদে বাংলাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা প্রদান ও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করলেও ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর দমন, নির্যাতন অব্যাহত রাখে। ভাষা আন্দোলনকারীরা ভারতের এজেন্ট 'পাকিস্তানের শত্রু', পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টকারী' প্রভৃতি অভিযোগে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আবুল হাশিস প্রমুখ নেতাসহ অসংখ্য কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম। ছাত্রনেতা মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন প্রমুখকেও গ্রেফতার করা হয়। শীর্ষস্থানীয় এসব নেতার গ্রেফতারের ফলে ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তা সত্ত্বেও অবশিষ্ট নেতৃবৃন্দ ভাষার দাবির সমর্থনে এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে প্রদেশব্যাপী ৫ মার্চ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ কর্মসূচী ঘোষণা করে। অধিকাংশ নেতাকর্মী জেলে থাকায় এই ধর্মঘট মোটামুটি পালিত হয়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক লিখেছেন, "যাই হোক, ৫ ই মার্চের হরতালকে পরিপূর্ণভাবে সাফল্যমণ্ডিত করা যায়নি।...কোনও প্রচার নেই, কোনও সংগঠনের ডাক নেই তবু সুদূর প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাট-বাজারে হরতাল হয়ে গেছে, স্কুল। কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। সারা পূর্ব বাংলার মানুষ সেদিন ভাষার দাবিতে মুখর হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনের এই যে ব্যাপকতা, এই যে বিস্তৃতি এবং পূর্ব বাংলার মানুষের এই যে প্রাণচাঞ্চল্য, এই যে আত্মনিবেদন, এটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার মানুষের সাথে এদেশের গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক কর্মীদের একটা প্রাণের যোগ সংস্থাপিত হয়, যা এর পূর্বে আর কখনও হয়নি।” 

আমরা আগেই বলেছি যে,ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও মুসলিম লীগ সরকারের বড় ভীতি শেখ মুজিব প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় জেলখানা থেকে। মুক্তি পান। মুক্তি লাভের পর ওই দিনই তাকে গ্রামের বাড়ি টুঙ্গীপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় এক মাস অবস্থানের পর একটু সুস্থ হলে তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন এবং এপ্রিল মাস নাগাদ আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি আবার অসমাপ্ত ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল তৃতীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ" এর সম্মেলনে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় তিনি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্তাক্ত পথ ধরে আন্দোলনকে সফল করার আহ্বান জানান। উক্ত সভায় তিনি মুসলিম লীগ সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। এবং বলেন, 'আপনারা সংঘবদ্ধ হোন। মুসলিম লীগ সরকারের ভণ্ডামীর। মুখোশ খুলে ফেলুন। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তিনি জনগণের রায় নেয়ার জন্য গণভোটের দাবি জানান এবং স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ সরকারকে উৎখাতের আহ্বান জানান।

চীনে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে মুজিবের বাংলা ভাষায় বক্তৃতাঃ

১৯৫২ সালের ৩ থেকে ১১ অক্টোবর চীনের পিকিং-এ অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বশান্তি সম্মেলন। এই সম্মেলনে সাঁইত্রিশটি দেশের প্রায় চারশ’ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। চীন সরকারের আমন্ত্রণে এই বিশাল শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন, যুগের দাবির সম্পাদক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। মোট ছিয়াশি জন বক্তা এখানে বক্তৃতা করেন। এসব বক্তার অধিকাংশই ইংরেজী, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জাপানি, রুশ, চীনা, হিন্দি ভাষায় বক্তৃতা করলেও পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি মুজিবের যে গভীর মমত্ববোধ, শ্রদ্ধা বাংলা ভাষায় দেয়া এই বক্তৃতাই তার সাক্ষ্য বহন করে। উল্লেখ্য যে, উক্ত সম্মেলনে আর একজন বক্তা বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে সবার নজর কেড়েছিলেন তিনি হলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লেখক মনোজ বসু।”

ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী পালনঃ

ভাষা আন্দোলনের অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ থাকায় ও মুসলিম লীগ সরকারের দমননীতির কারণে ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী পালন বেশ কঠিন ছিল। তা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান প্রমুখের নেতৃত্বের তৃতীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এই বার্ষিকী পালনের এক কর্মসূচী গ্রহণ করে। কর্মসূচীর মধ্যে ছিল ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে রোজা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সারা প্রদেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ ও আরমানীটোলায় জনসভা। এই কর্মসূচী মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পূর্ণ দিবস হরতাল পালিত হয়। দুই একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়া সকল সরকারী কর্মচারী এই হরতাল পালন করে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই হরতালের সমর্থনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে যে বিশাল মিছিল বের হয় তার নেতৃত্ব প্রদান করেন শেখ মুজিব। মিছিল শেষে আরমানীটোলায় হাজার হাজার লোকের জনসভায় শেখ মুজিব মুসলিম লীগ সরকারের তীব্র সমালোচনা করে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন এবং ভাষা আন্দোলনের বন্দীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করেন। সেদিনের (২১ ফেব্রুয়ারি) হরতাল জনসভায় শেখ মুজিবের ভূমিকা সম্পর্কে ভাষা সৈনিক গাজীউল হক লিখেছেন :

"২১ শে ফেব্রুয়ারি মিছিল শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে। ভোর বেলাতেই জনাব আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জমায়েত হয়েছিলেন। মিছিল শুরু হলো। মিছিলের সামনে জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব শেখ মুজিবুর রহমান, ইমাদুল্লাহ (অলি আহাদ গ্রেফতার হবার পর থেকে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক)। কালো পতাকাটি কখনো আমি, কখনো বা আব্দুল ওয়াদুদ পাটোয়ারি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সকল স্তরের জনগণ ছিল আমাদের সংগে। সারা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে মিছিল এসে জমায়েত হলো আর্মানীটোলা ময়দানে। আর্মানীটোলা ময়াদানের সভায় সেদিন সভাপতিত্ব করেন জনাব আতউর রহমান খান। ছাত্রদের প্রত্যেক দল থেকে একজন করে এ সভায় বক্তৃতা করেন। যুবলীগ থেকে জনাব ইমাদুল্লাহ এবং আওয়ামী লীগ থেকে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান। সভায় ভাষা আন্দোলনের বন্দীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করা হয়। শহীদদের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে মোনাজাত করা হয়"।

যুক্তফ্রন্ট গঠন, নির্বাচন ও প্রধান ইস্যু রাষ্ট্রভাষা বাংলাঃ

১৯৫৩ সালে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন আবার চাঙ্গা হতে থাকে। সেই সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের আর্থ- সামাজিক শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধেও জনগণ ক্ষুব্ধ হয়। শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে আবারও এগিয়ে আসেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের অসুস্থতার কারণে দল সেই গুরু-দায়িত্ব মুজিবের ওপর অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হয়। ১৯৫৩ সালে মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তৎকালীন পূর্ব বাংলার সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের মত বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শেখ মুজিব বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্রতী হন। দলের একজন শীর্ষ নেতা হয়েও শেখ মুজিব নিজেকে কখনই নেতা হিসেবে মূল্যায়ন করতেন না বরং নিজেকে সব সময় একজন কর্মী/সেবক ভাবতেন। সে সময় মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নেতৃত্ব যখন ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও পূর্ব বাংলার জনগণকে শোষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মকৌশল নিয়ে ব্যস্ত, কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতারা যখন মতাদর্শগত বিতর্ক (বিটি রণদীভে ও পিসি যোশী বিতর্ক) নিয়ে ব্যস্ত তখন শেখ মুজিব বাংলার মানুষের দ্বারে দ্বারে ফিরছেন, তাদের দুঃখ-দুর্দশা, অভিযোগ শুনছেন, স্বীয় অধিকার, দাবী-দাওয়া সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলছেন, আন্দোলনে শরীক হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।

মোটকথা, শেখ মুজিবের রাজনীতির মূল বিষয়ই ছিল সাধারণ মানুষ, মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ । তাই খুব অল্প দিনের মধ্যেই শেখ মুজিব শুধু আওয়ামী মুসলিম লীগেরই নয় সারা বাংলার একজন জনপ্রিয় নেতাতে পরিণত হন। এসময় ফজলুল হক সাহেব কৃষক শ্রমিক পার্টি নামে একটি দল গঠন করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। গণতন্ত্রের পূজারী, অখণ্ড বাংলা আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি পূর্বেই আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, তিনিও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় ফিরে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

এসময় পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিলে বাংলার ছাত্র জনতা হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দীকে একই মঞ্চে আসার দাবি উত্থাপন করে। পূর্ব বাংলার শোষিত বঞ্চিত ছাত্র-জনতার দাবি গ্রাহ্য হয়। ফলশ্রুতিতেই ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলামকে নিয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্ট রক্তস্নাত ২১ ফেব্রুয়ারিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য নির্বাচনী দাবি-দাওয়াকে ২১ টি দফার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে এবং প্রথম দফায় মায়ের ভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করে। ২১ দফার মধ্যে ছিল:

  • ১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা;
  • ২. বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ ও সকল প্রকার মধ্যস্বত্বের বিলোপ সাধন, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বণ্টন; ভূমি রাজস্বকে ন্যায়ঙ্গতভাবে হ্রাস করা এবং সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল করা;
  • ৩. পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, পাট উৎপাদনকারীদের পাটের ন্যায্য মূল্য প্রদানের ব্যবস্থা, মুসলিম লীগ আমলের পাট-কোলেঙ্কারির তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা;
  • ৪. সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা; কুটির শিল্পের বিকাশ ও শ্রমজীবীদের অবস্থার উন্নয়ন সাধন করা;
  • ৫. পূর্ব বাংলাকে লবণের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে কুটির ও বৃহৎ পর্যায়ে লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করা;
  • ৬. অবিলম্বে বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন করা;
  • ৭. সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করা;
  • ৮. পূর্ব বাংলাকে শিল্পায়িত করা এবং আই.এল.ও কনভেনশন অনুযায়ী শিল্প শ্রমিকদের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা;
  • ৯. অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন ও শিক্ষকদের জন্য ন্যায্য বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা।
  • ১০, সরকারী ও বেসরকারী বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিভেদ বিলোপ করে সমগ্র মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন করা এবং মাতৃভাষাকে মাধ্যম করা;
  • ১১. বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত সকল প্রতিক্রিয়াশীল কলাকানুন বাতিল করে তাকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা;
  • ১২. প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচ করা এবং উচ্চ ও নিম্ন বেতনভোগী সরকারী কর্মচারীদের বেতনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা; যুক্তফ্রন্টের কোন মন্ত্রী এক হাজারের বেশি বেতন গ্রহণ না করা;
  • ১৩. দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ উচ্ছেদের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের পর থেকে সকল সরকারী কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী কর্তৃক অর্জিত সম্পত্তির হিসেব গ্রহণ করা এবং সকল অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা;
  • ১৪. নিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স বলে আটককৃত সকল নিরাপত্তা বন্দীকে মুক্তিদান এবং সমিতি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা;
  • ১৫. শাসন বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথক করা;
  • ১৬. 'বর্ধমান হাউস' আপাতত ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগার করা;
  • ১৭. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাদের পবিত্র স্মৃতিকে রক্ষা করার জন্য শহীদ মিনার নির্মাণ করা;
  • ১৮. একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ঘোষণা ও তাকে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালন করা;
  • ১৯. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সব বিষয় পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে অর্পণ, সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে রেখে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব বাংলায় স্থানান্তর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে পূর্ব বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য এখানে বস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং আনসার বাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ মিলিশিয়া হিসেবে গড়ে তোলা;
  • ২০. যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোন অজুহাতেই আইনসভার আয়ু বৃদ্ধি করবে না; সাধারণ নির্বাচনের ছয় মাস পূর্ব মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
  • ২১. আইনসভার কোন আসন শূন্য হবার তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের মাধ্যমে তা পূরণ করা হবে এবং যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীরা পরপর তিনটি উপনির্বাচনে পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।

সরকার বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ২১ ফেব্রুয়ারিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২১ দফা কর্মসূচী ঘোষিত হওয়ায় সারা বাংলায় ছাত্র-জনতার মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সরকারের অব্যাহত দমন, নির্যাতন উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা সারা দেশে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান ও শহীদ দিবস পালন করে। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' ধ্বনিতে সারা দেশ যেন আবার মুখরিত হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ তোয়াহা বলেন, ১৯৫৩ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বেশ সাংঘাতিক আন্দোলন; '৫৪ সালে এ আন্দোলন আরো ভয়ানক হয়ে উঠেছিল।

এদিকে যুক্তফ্রন্টের একজন অন্যতম নেতা হিসেবে শেখ মুজিব এই ২১ দফা দাবি নিয়ে প্রদেশের একপ্রান্ত হতে অপর প্রান্ত চষে বেড়ান । বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও ছুটির দিন ঘোষণা, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ ২১ দফার সমর্থনে তিনি বড় বড় জনসভায় যে গুরুত্বপূর্ণ ও জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন তাতে করে তিনি লাভ করেন জনগণের অকুণ্ঠ ভালবাসা ও সমর্থন।

এই নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগ প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে টুঙ্গিপাড়া এলাকা থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়ী হয় এবং মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। মুসলিম লীগ মাত্র ৯ টি আসন লাভ করে।

যুক্তফ্রন্টের এই বিজয়ের পিছনে কাজ করেছিল ২১ দফা কর্মসূচী যা অন্যতম প্রধান দফা ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণের মনে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ, ঘৃণার সঞ্চার হয়েছিল, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফলাফলে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

যাই হোক, নির্বাচনের পরপরই যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে আবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামান যিনি ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের হায়দ্রাবাদ সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি যুক্তফ্রন্টের সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে কে এস পি নেতা ফজলুল হক সাহেবকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করলে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিব চোধুধী খালেকুজ্জামানের এমন আচরণে বিস্মিত হন এবং এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যুক্তফ্রন্টের এ বিজয় সহজে মেনে নেবে না। ভবিষ্যতে তারা বার বার আঘাত হানতে থাকবে। তা সত্ত্বেও তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হক সাহেবকে মেনে নেন এবং ক্ষমতার বাইরে থেকেই দেশ ও জাতির সেবাই নিজেকে নিয়োজিত করেন। উল্লেখ্য যে ১৯৫৪ সালের এই নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩টি এবং কেএসপি মাত্র ৪৮টি আসন লাভ করে। পরবর্তীতে অবশ্য পারিপার্শ্বিকতার চাপে মুখ্যমন্ত্রী যে ১০ জন মন্ত্রি নিয়োগ করেন তার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান হক মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। তিনি কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন।

এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, ভাষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও দক্ষ সংগঠক, আওয়ামী মুসলিম লীগের সুযোগ্য সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা, এরপর হলেন দেশসেবক, মন্ত্রী। কিন্তু প্রথমেই হোচট খেলেন। কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পিতভাবে আদমজী জুট মিলে বাঙালি অবাঙালি দাঙ্গা বাধিয়ে (এ দাঙ্গায় প্রায় পাঁচশত বাঙালি নিহত হয়) এর সব দায়-দায়িত্ব যুক্তফ্রন্ট সরকারের ওপর চাপিয়ে দেয় এবং ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ৯২ (ক) ধারা বলে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে। একই দিনে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মীর্জাকে পূর্ব বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই গভর্নর মীর্জা পূর্ব বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। যুক্তফ্রন্টের হাজার হাজার নেতা কর্মীকে জেলখানায় ঢোকানো হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রায় তিন হাজার কর্মী ও তিপ্পান্ন জন এমএলএ গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে। ফজলুল হক হন গৃহবন্দী। এসময় মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী বিদেশে অবস্থান করছিলেন। ফলে একটি নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সে সময় পূর্ব বাংলায় কোন প্রতিবাদ সভা বা বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়নি।

উল্লেখ্য যে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বেশ কিছু উদ্যোগ নেন। যেমন ২১ ফেব্রুয়ারিকে ছুটির দিন ঘোষণা, বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমিতে রূপান্তর প্রভৃতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল কিন্তু পূর্ব বাংলায় ৯২-ক ধারা জারি ও ইস্কান্দার মীর্জার দমন নীতির কারণে তা ভেস্তে যায়। সরকার নতুন করে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত সকল কর্মতৎপরতা খর্ব করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয় এবং পরবর্তী বছর (১৯৫৫ সালে) যাতে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত না হয় তার জন্য ষড়যন্র শুরু করে।

১৯৯৫ সালে সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি এবং সংগ্রাম পরিষদের বেশ ক'জন নেতাকে গ্রেফতার করা হলে ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। শেখ মুজিব ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিলাভ করার পর সাংগঠনিক কাজে ঢাকার বাইরে অবস্থান করছিলেন। ফলে ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ছাত্রসমাজ ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতেই বাংলার বীর ছাত্রসমাজ সরকারী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সকল ছাত্রাবাসে পতাকা উত্তোলন করে এবং রাত ১২টার পরপরই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', "শহীদ স্মৃতি অমর হোক' ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন,

"১৯৫৫ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে আমরা হাজতে। দেশে তখন স্বেচ্ছাচারী শাসন চলছে। কয়েক হাজার কর্মী জেলে আটক অথবা আত্মগোপন করে আছেন। এমতাবস্থায়, ২১ শে ফেব্রুয়ারি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হবে কিনা স্বভাবতই মনে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু আমাদের এ ধরনের সন্দেহকে অমূলক ও ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিয়ে ২০ শে ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে সমস্ত ঢাকা শহর শ্লোগানে পর শ্লোগানে গর্জে উঠলো। বাংলা ভাষার দাবিতে, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে সেদিন ঢাকার বুকে গণকণ্ঠের ঢল নেমেছিল"।

গণপরিষদ বিতর্ক ও মুজিবের বাঙালি মানসঃ

১৯৫৫ সালের জুন মাস নাগাদ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ৫ জুন পূর্ব বাংলা থেকে কেন্দ্রীয় শাসন প্রত্যাহার করা হয় এবং যুক্তফ্রন্টের সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে কে এস পি-র আবু হোসেন সরকারকে প্রাদেশিক সরকার গঠনের অনুমতি দেয়া হয়। শেখ মুজিব বিরোধী দলে থেকেই কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের অগণতান্ত্রিক সকল নীতি ও কার্যক্রমের সমালোচনায় অবতীর্ণ হন। এ সময় পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে "দ্বিতীয় গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে শেখ মুজিব গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হবার পর তিনি আবারও বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি দাবিতে সোচ্চার হন। এসময় পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করার প্রস্তাব করলে শেখ মুজিব এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ১৯৫৫ সালের আগস্ট সেপ্টম্বর মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের বিতর্কে পাকিস্তান সরকারের এমন হীন প্রয়াসের বিরোধিতা করে বলেন,

...স্যার, আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, তারা পূর্ববঙ্গের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি ব্যবহার করতে চাচ্ছে। পাকিস্তানের পরিবর্তে বেঙ্গল শব্দটি ব্যবহার করার জন্য আমরা অনেকবার দাবি করেছি । বেঙ্গল শব্দটির একটি ইতিহাস আছে, একটি নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। জনগণের সাথে আলোচনা করেই কেবল আপনি নাম পরিবর্তন করতে পারেন। আপনি যদি এই পরিবর্তন করতে চান, তবে আমাদেরকে পূর্ব বাংলায় ফিরে গিয়ে জনগণকে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা তা মানতে রাজী আছে কি-না। ..বাংলাকে কেন রাষ্ট্রভাষা করা হচ্ছে না? পূর্ব বাংলাকে কেন স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হচ্ছে না?"

শেখ মুজিব মনে প্রাণে ছিলেন একজন খাটি বাঙালি । সাম্প্রদায়িকতা, লোভ-লালসা তাকে কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি। যেখানে সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক এর মত নেতারাও ক্ষমতার লোভে অনেক সময় নীতি, আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়েছেন সেখানে শেখ মুজিব থেকেছেন অবিচল, দৃঢ়, শান্ত। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলার মাটি, বাংলার মানুষই তার আদর্শ। আর এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। যদিও এজন্য তিনি নিজ দলের মধ্যেই বহুবার বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর আদর্শ, নীতি থেকে পিছু পা হননি। তাই তো ১৯৫৫ সালের ২১, ২২, ২৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম' শব্দটি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এতে করে বিরোধী দলসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন। এমনকি বেশ ক'জন সদস্য দল থেকে বের হয়ে যান। শেখ মুজিব সেদিন দলের বলেছিলেন: এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেনঃ

"প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িকীকরণ প্রসঙ্গে একথা অনস্বীকার্য যে, যে সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম হয় তখনকার বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী আমাদের সংগঠনকে একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হয়েছিল।...কিন্তু বর্তমানে অবস্থা নেই। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আজ অবসান ঘটেছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানবাসীর নিজস্ব রাজনৈতিক জোট হিসেবে গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করার মহান দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে।...আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে এ কথা ঘোষণা করতে পারি যে, দেশের সকল ধর্মের, সকল বর্ণের এবং সকল ভাষাভাষির মানুষকে একটি গণ-প্রতিষ্ঠানে সমবেত করা প্রয়োজন। বস্তুত আওয়ামী লীগ দলকে সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অবারিত করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হবো"।

বস্তুত আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেয়ার সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলেই রূপান্তরিত হয়নি। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সুস্পষ্ট সূচনা হয়। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগও ইতোপূর্বে 'মুসলিম' শব্দটি বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম ধারণ করে।

যাই হোক, গণপরিষদের বিতর্ক শেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয় কিন্তু পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান।

১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের সংবিধান : নামমাত্র ভাষার স্বীকৃতিঃ

১৯৫৬ সালের সংবিধানের ২১৪ অনুচ্ছেদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়া হলেও এতে এমন কিছু শর্ত আরোপ করা হয় যাতে করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিষয়টি শুধুমাত্র কাগুজে বিষয়-এ পরিণত হয়। কারণ, সংবিধানের ২১৪ অনুচ্ছেদে ভাষা সম্পর্কে বলা হয় :

(১) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ও বাংলা। তবে শর্ত থাকে যে, সংবিধান দিবসের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানের যে সকল সরকারী উদ্দেশ্য পরিপালনের জন্য ইংরেজী ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, সেই সকল উদ্দেশ্যে উক্ত ভাষা সংবিধান-দিবস থেকে আরম্ভ করে ২০ বছর মেয়াদের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকবে এবং উক্ত ২০ বছর অতিবাহিত হবার পর সংসদ আইন দ্বারা যেরূপ উদ্দেশ্য নিরূপণ করবে, সেরূপ উদ্দেশ্য পরিপালনের জন্য ইংরেজী ভাষা ব্যবহারের বিধান করা যাবে।

(২) সংবিধান দিবস থেকে আরম্ভ করে ১০ বছর মেয়াদ অতিবাহিত হলে ইংরেজী ভাষা পরিবর্তনকল্পে সুপারিশ করার জন্য রাষ্ট্রপতি একটি কমিশন নিয়োগ করবেন।

(৩) অবশ্য ২০ বছর মেয়াদ অতিবাহিত হবার আগেও প্রাদেশিক সরকার প্রদেশে ইংরেজীর পরিবর্তে যে কোন একটি রাষ্ট্রভাষা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নিবৃত্ত হবে না।

উপরোক্ত অনুচ্ছেদ আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়টি ছিল দীর্ঘসূত্রিতার মাধ্যমে বাংলার জনগণকে ধোকা দেয়ার নামান্তর। তাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল এবং ১৯৫২ সালের রক্তস্নাত ২১ ফেব্রুয়ারির মাধ্যমে বাংলার ছাত্র-জনতা যে প্রতিশ্রুতি (বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা) আদায়ে সক্ষম হয়েছিল, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে তা কেবল লিপিবদ্ধই থেকে গেল, প্রয়োগের মুখ দেখলো না। অবশ্য যদিও এই সংবিধানে ২০ বছর মেয়াদ অতিবাহিত হবার পূর্বে ইংরেজী ভাষা পরিবর্তন করে বাংলা বা উর্দুকে প্রাদেশিক ভাষা করার ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারকে দেয়া হয়েছিল, ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা সারা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করলে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে সেই সুযোগও ভেস্তে যায়।

১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এমনই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে যে ভাষার বিষয়টি প্রায় চাপা পড়ে যায়। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ সামরিক প্রেসিডেন্ট আইউব খান যে সংবিধান চালু করেন। তাতে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে ২১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়:

(১) পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা বাংলা ও উর্দু; কিন্তু এই অনুচ্ছেদকে। অন্য কোন ভাষা ব্যবহারের প্রতিবন্ধকরূপে কাজে লাগানো যাবে না; বিশেষত ইংরেজী ভাষা পরিবর্তনের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এই ভাষা সরকারী ও অন্যান্য উদ্দেশ্য পরিপালনের জন্য ব্যবহৃত হতে পারবে।

(২) সরকারী উদ্দেশ্য পরিপালনের জন্য ইংরেজী ভাষা পরিবর্তনের প্রশ্নটি পরীক্ষা ও তার উপর প্রতিবেদন পেশকল্পে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি একটি কমিশন গঠন করবেন।

এভাবে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মত ১৯৬২ সালের সংবিধানেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দেয়া হয়। ফলে পরবর্তীতে পাকিস্তানে কোন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় (১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত) বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

১৯৬২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত অস্পষ্ট বিধি বিধান, মৌলিক গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থেই তা ছিল 'গণতন্ত্রের পােশাকে মোড়ানো। এক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা প্রভৃতি গ্রহণ করায় শেখ মুজিব এই সংবিধানকে অগণতান্ত্রিক ও অচল বলে প্রত্যাখ্যান করেন। এসময় ৯ জন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আইউব খানের এই অগণতান্ত্রিক সংবিধানের বিরুদ্ধে একটি যুক্ত বিবৃতি দেন যা বাংলার ইতিহাসে ৯ নেতার বিবৃতি নামে খ্যাত। এই ৯ নেতার মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন একজন। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালেও শেখ মুজিব পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা এবং পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন (১৯৫৫ সালের আগস্ট-সেপ্টম্বর নাগাদ গণপরিষদে বক্তৃতা) এবং ২৯ জানুয়ারি (১৯৫৬) প্রতিরোধ দিবসের ডাক দেন।

এছাড়া গণপরিষদে এই সংবিধান পাস হওয়ার পূর্বেই তিনি তাঁর দলীয় সদস্যদের নিয়ে ওয়াক আউট করেন।

ভাষার বিরুদ্ধে আবার ষড়যন্ত্র শুরু : রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণাঃ

ষাটের দশকে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আবার নতুন করে যড়যন্ত্র শুরু হয়। ১৯৬০-৬১ সালে রবীন্দ্র শতজন্মবার্ষিকী পালনে সরকার এবং প্রতিক্রিয়াশীল চক্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তৎকালীন দৈনিক আজাদ। সরকার সমর্থক এই পত্রিকাটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ,বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আপত্তিকর সংবাদ ও বিবৃতি প্রকাশ করে। এই জঘন্য ভূমিকা প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে দৈনিক ইত্তেফাক। ইত্তেফাক যথাযথ জবাব ও যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি, বাঙালির গৌরবকে অক্ষুন্ন রাখে।

এই সময় (১৯৫৮-৬২) সমগ্র পাকিস্তানে পূর্ণ সামরিক আইন বলবৎ এবং শেখ মুজিব কারারুদ্ধ থাকায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবক্তা হিসেবে কাজ করে। ছাত্র সংগঠনগুলো আইউবশাহীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে এবং রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, বাংলা নববর্ষ প্রভৃতি পালনের মাধ্যমে বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে রক্ষা করে।

১৯৬২ সালে জেলখানা থেকে মুক্ত হয়েই শেখ মুজিব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগকে পুরুজ্জীবিত করে তিনি বলেন, "ভোটাধিকার না দিলে জনগণ ট্যাক্স দেবে না। আওয়ামী লীগ বাংলার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ডিক্টেটর আইউবশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।"

ষাটের দশকের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আর্থ-রাজনৈতিক শোষণের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করলে শেখ মুজিব বাধ্য হয়েই ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ৬-দফার জনপ্রিয়তায় আইউব খান ক্ষিপ্ত হয়ে একে বিচ্ছিন্নতাবাদের চক্রান্ত ও 'অন্ত্রের ভাষা' ব্যবহারের হুমকি দিলে শেখ মুজিবও ঘোষণা করলেন 'আমার জনগণ অস্ত্রের ভাষার যথার্থ জবাব জানে'। মুজিব গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের প্রতিবাদে জনগণ হরতাল পালন করে এবং রেললাইন উপড়ে ফেলে। ঐদিন (১৯৬৬,৭ জুন) পুলিশের গুলিতে ১১ জন নিহত হয়।

১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সংগীত ও নাটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলার প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সংবাদিক ও শিক্ষাবিদগণ এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং একটি যুক্ত বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে যারা সই করেন তাদের মধ্যে ছিলেন-ড, কুদরত-ই- খোদা, ড, কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, শিল্পী জয়নুল আবেদিন, এম. এ. বারী, অধ্যাপক আব্দুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. খান সারওয়ার মুর্শিদ, কবি সিকান্দার আবু জাফর, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. আহমদ শরীফ, কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ড. মোঃ মনিরুজ্জামান এবং শহীদুল্লাহ কায়সার। বিবৃতিতে তারা দাবি করেন যে, রবীন্দ্রনাথ, 'বাংলা ভাষাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এই প্রতিবাদ শুধু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ৬৯-এর ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিব জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি বন্দী ছিলেন) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) তাকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য আয়োজিত জনসভায় অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, "আমরা এই ব্যবস্থা (সরকার কর্তৃক রবীন্দ্র চর্চার নিষেধাজ্ঞা আরোপ) মানি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত এদেশে গীত হইবেই।" উল্লেখ্য যে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত ২৩ ফেব্রুয়ারির সেই ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিব ছাত্র জনতা কর্তৃক ‘বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত হন।

শেখ মুজিব মনে প্রাণে ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যেন তার রক্তমজ্জায় মিশে ছিল। তাই পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়েও তিনি চীনে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে ইংরেজী ভাষায় বক্তৃতা না করে সেদিন বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই বক্তৃতা শুধু বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ, ভালবাসা আর শ্রদ্ধার সাক্ষ্যই বহন করেনি তখন থেকেই তার হৃদয়ে লালিত ও বিকশিত হতে থাকে এক স্বাধীন বাংলাদেশের ছবি । ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু বার্ষিকীতে তিনি তার হৃদয়ের সেই লালিত, বিকশিত অনুভূতিতে প্রকাশ করেন এবং বলেন, এ অঞ্চলের (পূর্ববঙ্গের) নাম হবে বাংলাদেশ। শুধু এটুকুই না, তার দু'বছর পর তিনি এক ঘরোয়া পরিবেশে এই আশা ব্যক্ত করেছিলেন যে, দেশটা যদি কোন দিন স্বাধীন হয়, তবে কবি গুরুর 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হবে।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের এক মহান পৃষ্ঠপোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবঃ

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আইউব খানের পতনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতার মসনদে বসেন এবং বাধ্য হয়েই ১৯৭০ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কেন্দ্রীয় আইনসভায় (জাতীয় পরিষদ) আওয়ামী লীগ ৩১৩ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনের পরপরই বঙ্গবন্ধু বাংলার কবি সাহিত্যকদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। তিনি তৎকালীন সংস্কৃতি ও চলচিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিকী পূর্বানীর ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭০ ঢাকার হোটেল পূর্বানীর এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন:

"জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্যে সাহিত্যকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি। আমি তাঁদের আশ্বাস দিচ্ছি শিল্পী, কবি এবং সাহিত্যকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যেকোন অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে। আজ আমাদের সংস্কৃতির সামনে কোন চক্রান্ত নেই, শাসন বা নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল নেই। শিল্পী সাহিত্যিকরা আর মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের জন্যে সংস্কৃতি চর্চা করবেন না। দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তন সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি কান্না, সুখ দুঃখকে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্যে শিল্পী, সহিত্যিক সংস্কৃতি সেবীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি"। 

"স্বাধীনতার পর বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্যে প্রায় কিছুই করা হয়নি। শিল্পী সাহিত্যিক এবং সংস্কৃতিসেবীদের তাঁদের সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে মানুষের আশা-আকাংক্ষা প্রতিফলিত করতে দেয়া হয়নি। যে সংস্কৃতির সাথে দেশের মাটি ও মনের সম্পর্ক নেই তা বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাঙলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমাদের জনগণ এই চক্রান্ত প্রতিহত করেছে। আপনারা সবাই আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানেন। বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্যে জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনও এই ষড়যন্ত্রের দোসর। তারা রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল এবং আজও এ ব্যাপারে উঁচু মহলে জোর আপত্তি রয়েছে। জনগণ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত সহ্য করবে না। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যেসব বাঙালি সরকারী সমর্থন পেয়েছেন, তাঁদের দিন আজ শেষ"। 

ছাত্রলীগের ২৩ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে (১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি) প্রধান অতিথির ভাষণে অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে বঙ্গবন্ধু বলেন :

"অতীতে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আন্দোলন করে তা রুখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলাভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয় কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে। গানের শব্দ বদল করে রেডিওতে গাওয়া হয়েছে। তারা মুসলমানী করিয়েছে। এ অধিকার তাদের কে দিল?" 

বঙ্গবন্ধু বাংলার কবি সাহিত্যিকদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে আত্মনিয়োগের আহ্বান জানিয়েই কেবল ক্ষান্ত থাকলেন না, তিনি ঘোষণা করলেন ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই তিনি সরকারী অফিস আদালতে বাংলা ভাষা চালু করবেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বললেন :

"ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি যে, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারী অফিস আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করবো না। কারণ তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোন দিনই বাঙলা চালু করা সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় কিছু কিছু ভুল হবে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে"। 

বঙ্গবন্ধু ৭ কোটি বাঙালিকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে ঢাকায় বাঙালি নিধন শুরু করলে বঙ্গবন্ধু সেই রাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শেষমেষ দীর্ঘ নয় মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আর দেশ স্বাধীনের পরপরই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত