সেকুলার রাজনীতির ধারায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অভিযাত্রা

2474

Published on ফেব্রুয়ারি 14, 2021
  • Details Image

মোনায়েম সরকার

তত্ত্বগতভাবে সেকুলারিজম-এর ধারণা কয়েক শতাব্দী ধরে পাশ্চাত্যে এবং তারপরে প্রাচ্যে বিকাশ লাভ করেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে, বিশেষত বাংলাদেশে বাস্তব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে সেকুলারিজম-এর স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুরই অবদান। শেখ মুজিব বাস্তব ঘটনাবলি অবলোকন করে বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গণহত্যা, যুদ্ধবিগ্রহ মানুষের সব রকম অকল্যাণ বয়ে আনে। সেকুলারিজম, গণতন্ত্র এবং মানবতাবাদই মানুষকে মুক্তির পথে নিয়ে যেতে পারে। মুজিবের বাল্য ও কৈশোরকাল কেটেছে বাংলার গ্রামে, যেখানে তিনি গণতান্ত্রিক চেতনার অধিকারী সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তাঁর উচ্চশিক্ষা লাভ ঘটেছিল সেকালের আর দশজন শিক্ষিত মুসলমানের মতো কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। চল্লিশের দশকে কলকাতায় অবস্থান করে এবং মুসলিম ছাত্র-জনতার নেতা হিসাবে তিনি পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করেছিলেন। ১৯৩৯-৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধের ফল স্বরূপ তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ (তথা পঞ্চাশের মন্বন্তর) হিটলারের ইহুদীনিধন এবং অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ছেচল্লিশে কোলকাতার দাঙ্গা এবং দেশবিভাগকালীন নানা স্থানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতি ঘটনা শেখ মুজিবকে বিচলিত করেছিল এবং মানবমুক্তির প্রকৃত পথের সন্ধান খোঁজার জন্য তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের স্বভাবজাত অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধও তাঁকে অসাম্প্রদায়িক সেকুলার চিন্তার দিকে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক নীতির প্রভাবে পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগণের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক চিন্তার সৃষ্টি হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুই বাংলার জনগণকে সে সাম্প্রদায়িক প্রভাব থেকে মুক্ত করেন এবং অবশেষে স্বাধীন বাংলাদেশে সেকুলারিজমকে রাষ্ট্রীয় নীতির একটি মূলস্তম্ভ রূপে স্বীকৃতি প্রদান করেন।

এই সেকুলারিজম বলতে আমরা কি বুঝি? সেকুলারিজমের অর্থ যদি ধর্মনিরপেক্ষতা বলে ধরে নেই, তবে শুধুমাত্র সব ধর্মের সহাবস্থানেই তার এ সম্পূর্ণরূপে পরিমাপ করা যায় না। রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয়। এ উক্তির সপক্ষে দৃষ্টান্ত স্বরূপ ভারতবর্ষের সংবিধানে উল্লেখিত ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। সংবিধানে আছে বটে কিন্তু তাই বলে এটা বলা চলে না যে, সাম্প্রদায়িকতা সে দেশে কোন সমস্যার সৃষ্টি করে না।

ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে গ্রহণ করা সত্ত্বেও সে দেশের সংবিধানের রক্ষক সংসদ-সদস্যদের অনেকেই পার্লামেন্টে শপথ নেন ঈশ্বর ও আল্লাহর নামে। যুক্তরাজ্যের রাজা-রাণী গীর্জারও রক্ষাকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইবেল হাতে শপথ নিয়ে রাষ্ট্রীয় কার্যভার গ্রহণ করেন। এই সব জেনে-শুনে আমাদের বিভ্রান্তি বেড়ে যায়।

অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখবো, মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হওয়ার জন্য সাধনা করেছে। বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব সেই সাধনার ফলশ্রুতি। আবহমানকাল থেকে মানুষ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ভেবেছে, ধর্ম সম্বন্ধেও ভেবেছে। বর্তমান কালে প্রচলিত ধর্মগুলির সবগুলিই প্রাচীন। প্রায় সব ধর্মেই সহনশীলতা এবং অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যবহারিক ও বাস্তব ক্ষেত্রে ঐক্যের চেয়ে বিরোধই প্রাধান্য পেয়েছে। মানুষের মানুষ হওয়ার সাধনা আজও সফলকাম হয় নি। সব ধর্মই ঘোষণা করেছে, সকল মানুষ ভাই ভাই। অথচ আমরা দেখেছি, হিন্দুরা বৌদ্ধদের হত্যা করেছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও হিন্দুদের প্রতি অসহিষ্ণু হয়েছে। ইহুদী ও খ্রিস্টান জন্মশত্রু, দীর্ঘকাল ধরে মধ্যপ্রাচ্য ইহুদী ও মুসলিমদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। আমরা দেখছি, একই সম্প্রদায়ের মধ্যে মারামারি হয়েছে ও হচ্ছে যেমন শিয়া-সুন্নী, রোমান-ক্যাথলিক ও প্রােটেস্টান্টদের মধ্যে বিরোধ আজও লেগেই আছে। যুগে যুগে ধর্মবিদ্বেষ, গোষ্ঠীবিদ্বেষ মানুষকে অমানুষে পরিণত করছে। বর্তমানেও এই ধারা বজায় রয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশে। পাকিস্তানের করাচি, রাশিয়ার চেচনিয়া, যুগোস্লাভিয়ার বসনিয়া প্রভৃতি স্থানে ধর্মের নামে কি রকম জঘন্য ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, তা কি পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারছে না? তবুও কেন মানুষ হত্যার এই উন্মাদনা। এর উৎস কোথায়- ধর্মান্ধিতায় অন্য কোনো খানে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতীতে শত শত বছরব্যাপী ধর্মযুদ্ধ বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিকাশ ও প্রসারকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

লক্ষণীয় যে, প্রাক-রেনেসাঁ যুগে যে অঞ্চলে সেকুলার জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কোন্দ্রস্থল ছিল তা ইউরোপ নয়, আরব ভূ-খণ্ড। ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন প্রমুখ মনীষীর মুক্তচিন্তা সে যুগেও গোড়া মোল্লাদের মনঃপুত হয়নি। মুক্তচিন্তার একটি পরিবেশ মুসলিম-অমুসলিম মনীষীদের চিন্তার বিনিময় ও তার সমৃদ্ধি সহজ ও স্বাভাবিক করে তুলেছিল । কিন্তু ক্রুসেড' সব পণ্ড করে দিয়েছিল। মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধের উন্মাদনা ও জেহাদের তিক্ততা মুসলিমদের ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক করে তুলতে থাকে। আরব জগৎ ধর্মান্ধতার পথে অগ্রসর হয়। ধর্মযুদ্ধের দহন যদি আরব ভূ-খণ্ডকে এভাবে না পােড়াতো, তবে রেনেসাঁ ও আনুষঙ্গিক সেকুলার চিন্তার প্রথম বিকাশ ঘটতো আরব ভূ-খণ্ডেই এবং তা ঘটতো ইউরোপীয় রেনেসাঁর কয়েক শত বছর পূর্বে।

ইউরোপে চতুর্দশ, পঞ্চদশ, ষষ্ঠদশ শতাব্দী থেকে তৎকালীন গীর্জাকেন্দ্রিক ধর্মের অনুশাসনকে উপেক্ষা করে রেনেসাঁর মানবমুক্তির প্রয়াস শুরু হয়। রেনেসাঁর যুগ থেকেই ইউরোপে মানুষের ধারণায় ও কর্মকাণ্ডে সেকুলারিজ নিশ্চিতভাবে রূপ পেতে থাকে। কোন পারলৌকিক প্রত্যাশা নয়, ইহজাগতিক সুখ-দুঃখ সব সম্ভাবনাই রেনেসা পরবর্তী চিন্তানায়কদের বেশি আকর্ষণ করে। তাদের চিহ্ন কর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য রেনেসাঁ কোন আকস্মিক ঘটনা নয়; অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প বিকাশের ব্যাপক সম্ভাবনার পথে সামন্তবাদ এবং গীর্জা ও মন্দিরের প্রভুত্ব বিশেষ বাধার সৃষ্টি করেছিল । ফলে ধর্মের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বিশেষ করে রাজনৈতিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতা ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকে। কালক্রমে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের ফলে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্ম অকার্যকর হয়ে পড়তে শুরু করে। বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আদান-প্রদানের মাধ্যমে সেকুলার চিন্তা ও ভাবধারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল উৎকর্ষের যুগেও ধর্মের বিকৃতি যে কি ভয়াবহ হতে পারে তার নৃশংস রূপ আমরা উপমহাদেশে বিগত অর্ধ শতাব্দীব্যাপী প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৪৬-৪৭ এ মুসলমান হিন্দুকে, হিন্দু মুসলমানকে এবং অতঃপর ১৯৭১-এ মুসলমান মুসলমানকে ধর্মের নামে কি নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার জীবন্ত সাক্ষী আমরা, বহু দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা, ত্যাগ, তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।

কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৪৭ সালে বাংলার মানুষরাই স্বেচ্ছায় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার পশ্চিম প্রান্তের একাধিক জাতিগোষ্ঠী, যাদের ভাষা-সংস্কৃতি, রুটি-রুজি, পােষাক-পরিচ্ছদ সবই ভিন্ন রকমের, মিল শুধু ধর্মের, সেদিন ধর্মকে জাতীয়তার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে। মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু ইসলাম ধর্মের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ পূর্ব বাংলার মানুষকে সুবিচার দিতে ব্যর্থ হলো। পশ্চিম পাকিস্তানি শোষক ও শাসকচক্রের হাতে শোষিত ও বঞ্চিত হতে লাগলো পূর্ব বাংলার মানুষ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো ভাষা আন্দোলন, সে আন্দোলনের স্রোতে ভেসে গেল দ্বিজাতিতত্ত্ব, ক্রমে ক্রমে বিকাশ লাভ করলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা। স্বৈরাচারী মুসলিম লীগের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সূচিত হল গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ৫২-এর ভাষা আন্দোলন সেকুলার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বীজ রোপন করে। তারপর ৫৪-এর নির্বাচন, '৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, '৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিক আন্দোলন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তানের পতন ত্বরান্বিত করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচন, চূড়ান্তপর্বে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর রচিত হয়। আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

উল্লেখ্য যে, শুধুমাত্র শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠী হয়তো এতো অল্প কালপর্বে অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক সেকুলার জাতীয়তায় বিশ্বাসী হতে পারত না, যদি না সাম্রাজ্যবাদী আর পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষণ পরিবর্তনটাকে দ্রুততর করতো। পশ্চিমাদের শোষণের অনিবার্য ফলস্বরূপ আমরা জোট বেঁধেছি প্রবল এক জাতীয়তাবাদী ও সেকুলার তান্ত্রিক ধারার ঐক্যবোধের মাধ্যমে, যেমন প্রচণ্ড তাপ আর শক্তির প্রভাব অঙ্গার রুপান্তরিত হয় হীরকখণ্ডে। তেমনি শেখ মুজিব ক্যাটালিস্ট (Catalyst)-এর ভূমিকা পালন করেছেন এমনকি কারাগারে বন্দি থেকেও। পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণ নির্যাতন এবং উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গণপ্রতিরোধের মধ্য দিয়ে মুজিবের বিকাশ ও উদয় ঘটেছে শেখ মুজিব, মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা হিসাবে। বঙ্গবন্ধুর অন্তরের প্রবল দেশপ্রেম আর সেকুলার চেতনার সঙ্গে গণমানুষের সহজাত মানবতাবাদী জাতীয়তাবোধের সংমিশ্রণে বিকশিত হয়েছিল এক মহান জনদরদী সেকুলার গণতান্ত্রিক নেতার, যার নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলেছি- আমরা বাঙালি, এই আমাদের প্রথম ও বড় পরিচয় ।

বাঙালি জাতির বিশিষ্ট চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে আদিমকালের উপজাতীয় গোষ্ঠীর বিশেষ অবদান থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, আধুনিক সেকুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা আধুনিক যুগেরই সৃষ্টি। উনবিংশ শতাব্দীতে বৃটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতাকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে যে সেকুলার জাতীয়তার সূচনা হয়েছিল তার প্রথম মূর্ত রূপ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ইউরোপীয় রেনেসাঁর অনুসরণে উপমহাদেশে প্রথম সামাজিক সাংস্কৃতিক নবজাগরণকে বাংলার নবজাগরণ বা বাংলার রেনেসাঁস নামে অভিহিত করা হয়। নবজাগরণের যুগে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য মনীষীদের বিস্তারিত কর্মকাণ্ডের ফল স্বরূপ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। উনিশ শতকের নবজাগরণ পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ ও নিম্নবর্ণের হিন্দু সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে নি। ওই নবজাগরণের নানা প্রকার অসম্পূর্ণতা ছিল, যা বাঙালি জাতির পরিপূর্ণ বিকাশকে দীর্ঘকাল ধরে বাধাগ্রস্ত করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই অসম্পূর্ণ নব জাগরণকে সম্পূর্ণতা দান করেছেন। বস্তুত বঙ্গ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণায় এক নতুন যাত্রা সংযোজন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সেকুলার গণতান্ত্রিক ধারায় পরিপূর্ণ রূপ দান করেছেন। নতুন মাত্রা সংযোজনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তার সুসম্পূর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্পর্শে বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারায় ও গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ভাষাভিত্তিক, চেতনাভিত্তিক এবং সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, কিন্তু কোনো ক্রমেই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ নয়; এ হচ্ছে সেকুলারিজম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশে সেকুলার চেতনা তথা ধর্মনিরপেক্ষতার উন্মেষ ও বিকাশের এই হচ্ছে গোড়ার কথা। এই পথে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্ম।

কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা সম্বন্ধে আমাদের অনেকের মনে, এমনকি দায়িত্বশীল মহলেও সুস্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা এক কঠিন সাধনার বস্তু, সামাজিক জীবনে তার প্রয়োগ সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই আজ আর এক ধর্মের লোক বসবাস করে না, বিভিন্ন ধর্ম-বিশ্বাসী লোক একই রাষ্ট্র ও সমাজে পাশাপাশি বসবাস করে। তাই গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রই কোনো বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করতে পারে না এবং এটা বাঞ্ছনীয় ও অপরিহার্য যে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সমাজ ও রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস তার নিজস্ব । ধর্ম আছে এবং থাকবে, বিভিন্ন ধর্মমত ও পথ আছে বলেই সেকুলারিজম অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ঐতিহাসিক অনিবার্যতার কারণেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ সেকুলারিজমকে মৌলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। সংবিধানে ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ ছিল নিমরূপ:

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা :

"ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য
ক. সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা
খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে মর্যাদা দান
গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার
ঘ. কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।

১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানের ২য় ঘোষণাপত্রের আদেশ বলে ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করেছে। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার অনেক বছর অতিবাহিত হয়েছে, বাঙালি জাতির বিবেক পুনঃজাগরিক হতে চলেছে, দেশপ্রেমিক জনগণ এখন বুঝতে পেরেছেন, বঙ্গবন্ধুই আমাদের ঐতিহ্য, বঙ্গবন্ধুই আমাদের দিশারী। আজও বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত বঙ্গবন্ধুর সেকুলার গণতান্ত্রিক ধারার পক্ষে-বিপক্ষে আবর্তিত হচ্ছে। নবজাগরণের এই পর্বে বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পথ ধরেই আমাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে প্রতিহতো ও পরাজিত করে সেকুলার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মহান মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ ও মূল্যবোধ সমগ্র বাঙালি জাতির মননে, চেতনায় ও কর্মে মর্যাদায় আসনে প্রতিষ্ঠিত করাই হোক ১৫ আগস্ট জাতীয় শোকদিবসের শপথ । মুজিব মৃত্যুঞ্জয়ী।

সূত্রঃ শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সম্পাদনাঃ মোনায়েম সরকার এবং মোহাম্মাদ হাননান

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত