রাজাকারদের যারা মন্ত্রী বানিয়েছিল জাতি যেন কোনদিন তাদের ক্ষমা না করেঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

8517

Published on ফেব্রুয়ারি 24, 2018
  • Details Image
    কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে বলেছেন, জাতি কোনদিনও তাদের ক্ষমা করবে না।

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী যাদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার হয়ে সাজা হয়েছে, সাজা কার্যকর হয়েছে তাদের কে যারা মন্ত্রী বানিয়েছিল এবং লাখো শহীদের রক্ত রঞ্জিত জাতীয় পতাকা তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল জাতি যেন কোনদিন তাদের ক্ষমা না করে, ক্ষমা করবে না। সেটাই আমার জাতির কাছে আবেদন’।

শেখ হাসিনা বলেন, যারা আমার মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ-লুটপাট করেছে- সেসব যুদ্ধাপরাধীদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাদের বিচারের রায় আমরা কার্যকর করেছি। যারা এদেরকে মর্যাদা দিয়েছিল, এদের হাতে পতাকা তুলেছিল তাদের ব্যাপারে জাতিকে সচেতন থাকতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা শনিবার বিকেলে রাজধানীর ফার্মগেটস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

তিনি এর আগের ’৭৫ পরবর্তী সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, এক সময় দেখেছি অনেকেই নিজে মুক্তিযোদ্ধা তা বলার সাহস পেতেন না। সরকারী চাকরি পাবার জন্য তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা কথাটা লিখতে সাহস পেতেন না, কারণ তাহলে চাকরি পাবে না। কি দুর্ভাগ্য আমাদের, ’৭৫ এ জাতির পিতাকে হারাবার পর এই অবস্থা বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল। তখন ছিল রাজাকারদের দাপট।

শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৮ এর নির্বাচনে তাঁর দল জয়ী হয়েছে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের জয় অগ্নিসন্ত্রাস করেও বিএনপি-জামায়াত ঠেকাতে পারে নি। এই দীর্ঘ ৯ বছর সরকারে থাকার ফলেই অন্তত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে মানুষ গর্ববোধ করে। আর ভীত সন্তস্ত্র হয় না।

তাঁর সরকারের শাসনেই দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আবার সামনে এসেছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, মানুষ অন্তত তা বলার সুযোগ পাচ্ছে, লেখার সুযোগ পাচ্ছে। সেই আত্মবিশ্বাসটা ফিরে এসেছে। এই আত্মবিশ্বাসটা যেন হারিয়ে না যায়, এমন কোন অন্ধকারে আমরা যেন আবার না পড়ি যাতে করে আবার আমাদেরকে অন্ধকারে চলে যেতে হবে।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে হবে সেই পরিবেশ যেন ভবিষ্যতে আর কোনদিনও বাংলার মাটিতে ফিরে না আসে সেজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

সভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, আব্দুল মতিন খসরু এবং সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, এমিরেটাস অধ্যাপক এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন বক্তৃতা করেন।

সংগঠনের প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ আলোচনা সভা পরিচালনা করেন।

আওয়ামী লীগের সধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সহ দলের সভাপতিমন্ডলী এবং কার্যনির্বাহী সংসদের সদসবৃন্দ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কাহিনীগুলো মানুষের কাছে বলার উদ্যোগ গ্রহণ করে।

যাদের হৃদয়ে পাকিস্তান কিন্তু থাকে বাংলাদেশে, সববরকম আরাম আয়েশ ফল ভোগ করবে এই দেশের আর অন্তরাত্মা পড়ে থাকবে পাকিস্তানে সেই পাকিস্তান ওয়ালাদের থেকে বাংলাদেশের মানুষকে সতর্ক থাকার ও আহবান জানান তিনি।

ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে ’৭৫ এর ১৫ আগষ্টের খুনীদের ভোট চুরি করে সংসদে বসানো হয়েছিল।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গ্রাজুয়েশন প্রাপ্তির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। বাঙালি জাতি আজ মর্যাদা পেয়েছে। এই অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে।

শেখ হাসিনা বলেন, শহীদদের প্রতি আমাদের আজকের অঙ্গীকার, এই অগ্রযাত্রাকে আমরা অব্যাহত রাখবো।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার চর্চা এবং সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, যে ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি সেই ভাষার চর্চাটা আমাদের থাকতে হবে। সেটা পরিবার থেকেও উৎসাহিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর সময়ে অনার্সে সাবসিডিয়ারী হিসেবে বাংলা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও এখন নেই বিষয়টি সম্পর্কে অনুষ্ঠানে জানতে পেরে এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সঙ্গে তিনি আলাপ করবেন বলে জানান।

দেশে বাংলাভাষা শিক্ষায় এক ধরণের অনীহা থাকার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার প্রচুর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষা এবং সাহিত্য চর্চার কোন ব্যবস্থা থাকবে না, এটা কেমন কথা।

এ সময় বিয়ের কার্ড, সাইন বোর্ড-বিলবোর্ড বাংলা ভাষায় লিখিত না হওয়ারও সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, এটা মনে হয় যেন একটা ব্যাধির মত ছড়িয়ে গেছে। এই দৈন্যতাটা কেন থাকবে, আমি বুঝতে পারিনা।

অন্য ভাষা শিক্ষার বিপক্ষে তিনি নন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে বিশ্বটা কিন্তুু এক হয়ে গেছে সেজন্য বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে গেলে অন্য ভাষা আমাকে শিখতেই হবে।

তিনি বলেন, যে যত ভাষা শিখতে পারবে তার মেধার ততই উৎকর্ষ সাধিত হবে । কিন্তুু অন্যভাষা শিখতে না পারলে দেশ যে উন্নত হতে পারবে না সেটা তিনি বিশ্বাস করেন না।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জাপানের উদাহারণ টেনে বলেন, জাপানের জনগণ কিন্তুু নিজেদের ভাষায় কথা বলেই এক সময় সমগ্র বিশ্বে নিজেদের উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইংরেজী আমরা শিখবো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগের জন্য কিন্তুু দেশের অভ্যন্তরে যে ভাষার জন্য ভাষাসৈনিকরা জীবন দিয়ে গেছেন সেটা আমরা কেন শিখবো না,সেটার চর্চা আমরা কেন করবো না। সেটাই হচ্ছে মূল কথা’।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির পিতা হত্যার পর ’৭৫ থেকে ৮১ সাল পর্যন্ত দেশে ফিরতে না পারার কথা স্মরণ করে বলেন, তাঁর এবং শেখ রেহানার সন্তানরা বিদেশে পড়া লেখা করতে বাধ্য হলেও তাঁরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন তাঁদের সন্তানরা যেন বাংলাটা চর্চা করতে পারে যেটি দেশে থেকেও অনেকে পারছেন না বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

ভাষার আদান প্রদানে এক ভাষার শব্দ অন্যভাষায় চলে গিয়ে সে ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এ সময় ইংরেজী উচ্চারণে বাংলা বলার প্রবণতার সমালোচনা করেন।

এ সময় নিন্ম আদালতে এখন বাংলাভাষায় রায় লেখা হচ্ছে উল্লেখ করে ক্রমান্বয়ে উচ্চ আদালতের রায় লেখার ক্ষেত্রেও বাংলার ব্যবহার শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করে বলেন, এতে করে বিচার প্রত্যাশীদের ভোগান্তি অনেকাংশে লাঘব হবে।

তিনি বলেন, উচ্চআদালতের রায়টা ইংরেজীতে লেখা হয় কিন্তুু আমাদের দেশের অনেক সাধারণ মানুষ আছে যারা ইংরেজী জানেন না,তাই রায় পড়ে উকিল সাহেব যা বোঝায় সেটাই তাঁকে বুঝতে হয়।

সেখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবার অবকাশ থেকে যায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী উকিল সাহেবদের কিছু মনে না করারও আহবান জানিয়ে বলেন,এটাই দেশের বাস্তবতা।

তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতে ইংরেজীতে রায় লেখাটা দীর্ঘদিনের একটি পদ্ধতি। চট করেই এটার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবু, আমরা আশাকরি ধীরে ধীরে এটাও চালু হবে, কারণ বিচার প্রত্যাশী সাধারণ জনগকে রায়টাতো পড়ে বুঝতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পড়ে সেটা ইংরেজীতে অনুবাদ হোক। আমরা ইংরেজীর বিপক্ষে নই তবে সেই চর্চাটা বাংলায় থাকা উচিত।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশকে পকিস্তানীকরণে’৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকার গুলোর কঠোর সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, ’৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবেও ঘোষনা দিয়েছিল কিন্তুু এক পর্যায়ে যখন বুঝতে পারলো- মানুষ এটা গ্রহণ করবে না তখন আর দ্বিতীয়বার সে কথা উচ্চারণ হয়নি। অর্থাৎ এটাকে পরিকস্তানের একটি প্রদেশ বানাবারই যেন একটা প্রচেষ্টা হয়েছিল এবং জেনারেল আইয়ুব খানের পদাংক অনুসরণ করেই তারা ক্ষমতায় এসেছিল। বাংলাদেশ যে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী ছিল সেই বিজয়ী মনোভাবটাই তারা ধ্বংস করে দিতে সচেষ্ট ছিল।

তিনি বলেন, যে শক্তিকে আমরা পরাজিত করেছিলাম তাদের প্রতিই এদের খোষামোদী, তোষামোদী, চাটুকারিতা আমরা দেখেছি। যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতির পিতা শুরু করেছিলেন সেই বিচার মার্শাল ল’ অর্ডিন্যান্সে দিয়ে বন্ধ করে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে তাদের রাজনীতি করার অধিকার তারা দিয়েছিল।

তিনি জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রকে যুদ্ধপরাধীদের দল করার সুযোগ করে দেয়া উল্লেখ করে বলেন, এই জিয়াই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সে জারি করে জাতির পিতার বিচারের পথকে যেমন রুদ্ধ করেন তেমনি খুনীদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন।

পোল্যান্ড সরকার সে সময় বঙ্গবন্ধুর এক খুনীকে চাকরি দিয়ে সেখানে পাঠানোর পর তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।

তিনি বলেন, কাজই আমরা দেখেছি দেশের ভাবমূর্তিকে কিভাবে বিশ্বে নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী কানাডা প্রবাসী সালাম, রফিক এবং ‘ভালবাসি মাতৃভাষা’ নামের সংগঠনের উদ্যোগে এবং ’৯৬ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর ঘোষণার প্রেক্ষাপট অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন ।

পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া সব মাতৃভাষা গবেষণার জন্য তাঁর সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন,জাতিসংঘের তৎকালিন মহাসচিব কফি আনানকে নিয়ে এটির ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করলেও ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে না পারায় বিএনপি এটির নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল এবং ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরই তিনি সেটিকে প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন মাতৃভাষা সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে ভাষা জাদুঘরও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সমূহকে সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশের ওপরই আজকে দায়িত্ব পড়েছে।

ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত