কাতোলমারী গণহত্যাঃ মো. হেলাল উদ্দিন

2969

Published on মে 7, 2018
  • Details Image

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৬ মে এবং ২২ বৈশাখ ১৩৭৮। ওই দিনটি খোষলামপুর গ্রামবাসীর জন্য ছিল এক ঘন তমসাচ্ছন্ন বিভীষিকাময় দিন। গ্রামবাসী কখনো বুঝতেই পারেনি এটি হবে তাদের জীবনের শেষ দিন। ইয়াহিয়া খানের দস্যুবাহিনী ১৯৭১ সালের ওই দিনে খোষলামপুর গ্রামে যে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে, তা অবর্ণনীয়। খোষলামপুর গ্রামের কয়েকজন ভুক্তভোগী, নির্যাতিত ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, ওই দিন সকাল ৮টায় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ফুলবাড়ী ও পার্বতীপুরের অবাঙালি বিহারিরা গ্রামটি চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা অনুযায়ী আনুমানিক ১০০ থেকে ১৫০ জন বিহারি ও জোলা একত্রিত হয়ে গ্রামটি ঘেরাও করে।  অতঃপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম দিক থেকে গ্রামে প্রবেশ করে। অবশিষ্ট বিহারিরা খানদের সঙ্গে নিয়ে ৮-১০ জনের গ্রুপ হয়ে বাড়ি বাড়ি প্রবেশ করে নারী, পুরুষ ও ছেলে-মেয়েদের ধরে এনে গ্রামের হরিপদ মণ্ডলের বাড়ির সামনে একত্রিত করতে থাকে। হানাদার বাহিনীর আরেকটি দল আটক মানুষদের পাহারা দিতে থাকে। প্রত্যেক বিহারির হাতে বল্লম, ছোরা ও অন্যান্য অস্ত্র ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের কাছেই শুধু রাইফেল ছিল। হানাদার বাহিনীর গ্রামে প্রবেশের পর মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। ভয়ে গ্রামের পুরুষ ও মহিলারা চিৎকার-চেঁচামেচি করতে করতে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে জীবন রক্ষাও করেছে। এ রকম কয়েকজন গ্রামবাসী এই হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পেয়েছে। নবাবগঞ্জের এই এলাকা বিহারি অধ্যুষিত ছিল। পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী ও বিরামপুরে ছিল অবাঙালি বিহারি পরিবারের বসবাস। তাই খুব সহজেই তারা পাশের এলাকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামগুলোতে প্রবেশ করে গণহত্যা, নির্যাতন ও লুটতরাজে মেতে উঠেছিল। এ অবস্থা দেখে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে বিহারিমুক্ত অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ কারণে অনেকেই কাতোলমারী গণহত্যা থেকে রেহাই পায়।

এই গণহত্যার সময়সীমা ছিল মোট আট ঘণ্টা। বিহারিরা গ্রামের মানুষকে আশ্বস্ত করেছিল যে ফুলবাড়ীতে তাদের মেজর আছেন। উনি সবার সঙ্গে কথা বলতে চান। ঘাতকদের এই প্রতিশ্রুতি খোষলামপুর গ্রামের নিরীহ মানুষ সহজেই বিশ্বাস করেছিল। এই কথা বলে তারা গ্রামের শতাধিক মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দুপুর ২টার দিকে ফুলবাড়ী নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিছুদূর যাওয়ার পর কালীরঘাট নামক স্থানে রাস্তার পাশের জমিতে দাঁড়াতে বলে। সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে যার কাছে যা কিছু আছে দিতে বলে। না দিলে যদি সার্চ করে কারো কাছে কিছু পাওয়া যায় তাহলে গুলি করে মারা হবে বলে হুমকিও দেয়। টাকা-পয়সাসহ  সর্বস্ব নেওয়ার পর সবাইকে কাতোলমারীতে নিয়ে যায়। সেখানে মেয়েদের দুটি ও ছেলেদের দুটি লাইন করে বসিয়ে দেয়। বসানোর পর তাঁদের পেছনের দিকে স্টেনগান ফিট করে কয়েক মিনিটের মধ্যে সবাইকে হত্যা করা হয়। এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল কাতোলমারী নামক গ্রামে। তাই এটি কাতোলমারী গণহত্যা নামে পরিচিত। সেদিনের ওই গণহত্যায় শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন। ঘটনাস্থলে সবার মৃত্যু নিশ্চিত মনে করে তারা ওই স্থান ত্যাগ করে। যাওয়ার সময় গ্রামের ১৮ জন পুরুষ ও মহিলাকে ফুলবাড়ীতে নিয়ে যায়।

সুন্দরী মেয়েদের ঘরের মধ্যে আটকে রাখার পর পুরুষদের ঘরের পেছনে একটি মাঠে নিয়ে যায়। তাঁদের দিয়ে সেখানে একটি গর্ত করে নেয়। এই গর্তে ফেলে বল্লম, শুলপি, ছোরা ও লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে। আটকে রাখা মেয়েদের এ দৃশ্য দেখিয়ে তাঁদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ফুলবাড়ী থানার একটি কক্ষে যুবতী মেয়েদের তিন দিন ধরে আটকে রেখে তাঁদের পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তিন দিন ধরে উপর্যুপরি শারীরিক নির্যাতন করার পর তাঁদের কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং বাকি কয়েকজনকে সৈয়দপুরে পাঠানো হয়। এখান থেকে ছাড়া পেয়ে লাঞ্ছিত যুবতী মেয়েরা মির্জাপুর মুসলমানপাড়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। এই গণহত্যায় যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁরাও পরে খোষলামপুর গ্রামের মুসলমানপাড়ায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের মুসলমানরা মির্জাপুর কলেজপাড়ায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর ভারতে চলে যান এবং দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসেন।

কাতোলমারী গণহত্যায় খোষলামপুর গ্রামের ৯ জন আহতের মধ্যে এখনো সাতজন জীবিত আছেন। তাঁরা হলেন সুভাষ চন্দ্র মণ্ডল (ভগা), মন্টু চন্দ্র দাস, নরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, মিনতি রানী দাস, প্রমীলা বালা, রঙ্গিনী বালা, তরণি কান্ত মহন্ত। তাঁরা সবাই সেদিন স্টেনগানের গুলিতে আহত হয়েছিলেন; কিন্তু ভাগ্যের জোরে এখনো বেঁচে আছেন। এই গণহত্যায় খোষলামপুর গ্রামের আটজন এবং আলদাতপুর প্রামাণিকপাড়া থেকে দুজন নারীকে পাকিস্তানি বাহিনী ফুলবাড়ীতে তাদের ক্যাম্পে আটকে রেখে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। তাঁরা হলেন সুধারানী, ফেলানী বালা, জতু রানী, ভারতী রানী, চিনু বালা-১, মালতি রানী, নিভা রানী, জ্যোত্স্না রানী, ভারতী রানী, চিনু বালা-২ প্রমুখ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে খোষলামপুর গ্রামের এই বীরাঙ্গনা নারীরা আজও কোনো স্বীকৃতি পাননি। পাননি কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও। কাতোলমারী গণহত্যায় ধর্ষিত নারী ও বীরাঙ্গনারা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁদের জীবনের সেই দুঃসহ স্মৃতি। স্বামী, সন্তান ও পরিবার হারিয়ে নিঃস্ব জীবন যাপন করে চলেছেন। তাঁরা আজ সবাই বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি চান। চান সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত