কানাইঘাটের ভয়াবহ যুদ্ধে ৮৮ হানাদার মারা পড়ে

2522

Published on ডিসেম্বর 4, 2019
  • Details Image

‘কানাইঘাটে পাক সেনাদের সঙ্গে আমাদের ২৫ নভেম্বরের ভয়াবহ যুদ্ধে একজন মেজরসহ ৮৮ জন হানাদার নিহত হয়। আটক করি ২৬ জনকে। অন্যরা পালিয়ে যায়। ভয়াবহ ওই যুদ্ধে আমরাও হারিয়েছিলাম ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১১ জন মিত্রবাহিনীর সৈনিককে। ওই যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনী আর শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ওই যুদ্ধের কথা মনে হলে এখনো শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে।’ যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফণী ভূষণ চক্রবর্তী।

৬৫ বছর বয়সী চিরকুমার এই মুক্তিযোদ্ধা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের সবুজবাগ এলাকায় বসবাস করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন সাবসেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাসহর সাবসেক্টরে লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামানের অধীনে ভগবানপুর ট্রানজিট ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা হেসেবে যোগ দেন। ইস্টার্ন কমান্ড-৪-এর অধীনে ভারতের নাসিমপুর ও লোহারবন্দে ট্রেনিং নেন। তখন তিনি ছিলেন শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ফণী ভূষণ চক্রবর্তী বলেন, “১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়। ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সাফল্যের সঙ্গে জকিগঞ্জ দখল করে। জকিগঞ্জ দখলের পর সিলেট পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় কানাইঘাটে পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থান। কানাইঘাটে ছিল পাক হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। ওখানে অবস্থান করছিল হানাদারদের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা বাহিনী। তাদের সহযোগিতায় ছিল শতাধিক মিলিশিয়া ও বেশ কিছু রাজাকার।

কানাইঘাট-দরবস্তের সঙ্গে সংযোগ সড়কটি ছিল কৌশলগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিলেট পর্যন্ত অগ্রসর হতে হলে এই ঘাঁটি দখলে নেওয়া ছিল খুবই জরুরি। পরিকল্পনা অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট গিয়াসের নেতৃত্বে একটি কম্পানিকে কানাইঘাট-দরবস্ত সড়কে এবং লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বে আরেকটি কম্পানিকে কানাইঘাট-চরখাই সড়কে মোতায়েন করা হয়। বাকি দুটি কম্পানি মেজর আব্দুর রবের নেতৃত্বে সুরমা নদী পেরিয়ে কানাইঘাট আক্রমণ করবে। সব দিক গুছিয়ে আনার পর পাক হানাদার বাহিনী ২৫ নভেম্বর অতর্কিতে আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরা তখন কানাইঘাট থেকে দুই মাইল দূরে গৌরীপুরে।

পাক হানাদার বাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার ও শেলিংয়ের প্রচণ্ড আক্রমণে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছিল। আমাদের দলের কমান্ডার বজলুল গণি ওয়্যারলেসে পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বিভিন্ন সাবস্টেশনে সাহায্যের বার্তা পাঠান। কিন্তু ওপর থেকে নির্দেশ আসে, যেকোনো অবস্থায় আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে হবে। প্রচণ্ড আক্রমণের মধ্যে প্রায় আধাঘণ্টা অবস্থান ধরে রাখার পর আমাদের ডান পাশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থানে মেশিনগান আর এলএমজির ফায়ার করতে করতে এগিয়ে যায়। আমরাও আমাদের অবস্থান থেকে ফায়ার করতে থাকি। পরে জানতে পারি, মেজর ওয়াকার হাসান বীরপ্রতীকের নেতৃত্বে ৩০ জনের একটি দল সেদিন আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। এরপর শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধ। মেজর ওয়াকার তাঁর দলকে নিয়ে ক্রল করে পৌঁছে যান পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থানের কাছাকাছি। পেছন থেকে আমরা অগ্রবর্তী দলকে সাপোর্ট দিতে থাকি। অবস্থা বেগতিক টের পেয়ে হানাদাররা পিছু হটে।”

কানাইঘাটের যুদ্ধে সফলতার পর ফণী ভূষণসহ ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতের উত্তর ত্রিপুরার রানিবাড়ি ক্যাম্পে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, “সেখানে আসাম রেজিমেন্টের মিলিটারি সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের অধীনে পাঁচ দিনের ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঁচজনকে শমশেরনগরে পাক হানাদার বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে পাঠানো হয়। ১ ডিসেম্বর রাতে টিলাবাজার ক্যাম্প হয়ে আমরা নমৌজার উত্তরে মূর্তিছড়া চা বাগান দিয়ে রবিরবাজার পর্যন্ত যাই। ওই রাতেই রবিরবাজারের কাছাকাছি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষে প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওয়্যারলেস বার্তায় আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয় যেকোনো মূল্যে কুলাউড়া শত্রুমুক্ত করতে। দিনের আলোয় সব কিছু দেখা যাচ্ছে। বোমারু বিমান উড়ছে আকাশে। আমরা তখন ফায়ার বন্ধ করে মাটিতে শুয়ে আছি। মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমানগুলো কুলাউড়া ও জুড়ীতে হানাদার বাহিনীর অবস্থানে শেলিং করে। তারা পালায়। শত্রুমুক্ত হয় জুড়ী ও কুলাউড়া।”

কুলাউড়া ও জুড়ী শত্রুমুক্ত হলে ফণী ভূষণ কৈলাসহরে লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জমানের কাছে রিপোর্ট করেন। ৫ ডিসেম্বর তিনি লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জমানের সঙ্গে মৌলভীবাজারে আসেন। তাঁদের সঙ্গে আসে আসাম রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হামিদের নেতৃত্বে একটি কম্পানি। লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জমানের নির্দেশে আসাম রেজিমেন্টের ওই কম্পানির গাইড হয়ে কুমিল্লায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে তাদের পৌঁছে দিয়ে ফণী ভূষণ ১১ ডিসেম্বর শ্রীমঙ্গলে ফিরে যান। এরপর ক্যাপ্টেন এনামের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা মোহন লাল সোমের নেতৃত্বে শ্রীমঙ্গলে ভুড়ভুড়িয়া ক্যাম্পে অবস্থান নেন। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের পর মৌলভীবাজারে লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামানের কাছে তিনি অস্ত্র জমা দেন।

সৌজন্যেঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত