বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এশিয়া অন্যরকম হতো

2666

Published on মার্চ 8, 2020
  • Details Image

প্রণব মুখোপাধ্যায়ঃ

বর্তমান বাসভবন ১০ নম্বর রাজাজি মার্গে উঠেছি কিছুদিন হলো। সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামও অবসর নেওয়ার পর এ বাংলোয় থাকতেন। রাজধানী দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন, নর্থ ও সাউথ ব্লকের নির্মাতা ব্রিটিশ স্থপতি এডোয়ার্ড টিয়েন এ বাংলোতেই বাস করতেন। দোতলা বাংলোর একতলায় বসার ঘর, সেখানকার বড় কাঠের টেবিলটা দেখলে আরেকটা টেবিলের কথা মনে পড়ে। আমি যখন প্রথম অর্থমন্ত্রী হই, তখন আমার টেবিলটা ছিলো অতিকায়। এ টেবিলের একটা ইতিহাস আছে। ভারতের প্রথম অর্থমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ টেবিলে বসতেন। পরে তিনি পাকিস্তান চলে যান। শুনেছি, ভারত ভাগ হওয়ার সময় তার পূর্বাভাস ছিলো,-পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানকে বোধহয় বেশিদিন একত্রে রাখা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে পূর্বাভাস সত্যে রূপান্তর করেছিলেন।

ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করলেও বাঙালিত্ব কখনো ভুলতে পারি না। রাইসিনা হিলসের রাষ্ট্রপতি ভবনে এ প্রথম একটি বাংলা বইয়ের গ্রন্থাগার তাই গড়ে উঠেছে আমার আমলে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বহু পুস্তক রয়েছে। এ গ্রন্থাগারে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। আমার কাছে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হলে এ গ্রন্থটি একমাত্র প্রামাণ্য দলিল। আজও আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হই, বাঙালি হিসাবে তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আসলে নিজের জাতিসত্তা সম্পর্কে গর্ববোধ না থাকলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সেটিই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া আমার প্রথম শিক্ষা।

অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে আমি যতটুকু জানি, তার চেয়ে অনেক বেশি জানতেন রাজনীতিতে আমার আদর্শ ইন্দিরা গান্ধী। মনে আছে, ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে একবার সতর্ক করেছিলেন জীবন-সংশয় নিয়ে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিলো-‘ওরা আমারই সন্তান। আমাকে কেন হত্যা করবে?’ অথচ সেই সেনাবাহিনীর একাংশের হাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচারও হয়েছে কিন্তু আমার মনে এখনও সন্দেহ রয়েছে, হত্যার ষড়যন্ত্র কতটা উদঘাটন করা গেছে। সাধারণভাবে হত্যাকারী কারা এখন আমরা সবাই জানি। কিন্তু তাঁর হত্যাকাণ্ডের পেছনের ষড়যন্ত্র নিয়ে প্রকৃত তদন্ত আজও সমাপ্ত হয়নি। প্রকৃত রহস্য এখনও উদঘাটন হয়নি।

আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশকে সৃষ্টি করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেননা, তিনি অত্যন্ত উদার নীতির প্রবর্তক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি লাহোর যান। পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন ও স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তার অবশ্য মূল কারণ ছিলো-যেসব বাঙালি তখনও পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিলেন, তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই ছিলো প্রধান। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিলো জোটনিরপেক্ষ। পাকিস্তান বিরোধী বলেই ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মিশরের পক্ষ নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হলে আমার প্রথমেই মনে পড়ে তাঁর ভাষণের কথা। আমি বলতে পারি, এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এশিয়ার শ্রেষ্ঠ জননেতা। তাঁর বাগ্মিতার তুলনা মেলা ভার। পরে তিনি এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক নেতা হয়ে উঠেছিলেন। এশিয়ার দুর্ভাগ্য যে, এ ধরনের মহান রাষ্ট্রনেতাদের অকালেই প্রাণ হারাতে হয়। বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বন্দরানায়েক-এঁরা জীবিত থাকলে আজ এশিয়ার চেহারা অন্যরকম হতো। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এ ধরনের রাষ্ট্রনেতাদের আজ বড়ই অভাব।

যেদিন তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হয় সেদিন আমি দিল্লিতে ছিলাম না; কলকাতায় ছিলাম। আকাশবাণীর সংবাদে খবরটা জানার পর আমি বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি। স্বজন হারানোর মতো শোকাহত হয়েছিলাম। পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ফোন পেয়ে দিল্লি ছুটে যাই। মনে হয়েছিলো যে, অশুভ শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তারা হয়তো সেখানেই থেমে থাকবে না। নবসৃষ্ট বাংলাদেশকে ফের অন্ধকারের রাজত্বে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তাই ভরত সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। আমাদের সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যাদ্বয় হাসিনা-রেহানা সেদিন ঢাকায় ছিলেন না। তাই আজ বাংলাদেশ ফের মুজিব আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। আমি বলি, ‘মুজিবইজম’। সেটিই তাঁর দর্শন; বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি।

বলে রাখি, প্রথম থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি লন্ডন থেকে দিল্লি আসেন, তখন প্রথম সম্মুখ সাক্ষাৎ। দীর্ঘদেহী ও বজ্রকণ্ঠের মানুষটিকে দেখে শ্রদ্ধায় মন ভরে গিয়েছিলো। অনেক কথা হয়েছিলো। তখন আমাকে দেখিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন-‘এ মানুষটির নাম প্রণব, আপনাদের জন্য বিশ্বের সর্থন আদায় করার লক্ষ্যে ছুটে গিয়েছিলেন। ওর জন্যই আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে আমার অনেক সুবিধা হয়েছে।’ সে সময় বঙ্গবন্ধুর মুখে আমার সম্পর্কে ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ শুনে আমি কিছুটা লজ্জিত হয়েছিলাম।

সত্তরের দশকে আমরা দেখেছি, বিশ্বজুড়ে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের নাম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গোটা বিশ্বে নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের কাছে আদর্শ। আমার মননকে সবসময়ই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আলোড়িত করে। ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রথম বিদেশ সফর হবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। তবে আবার একবার বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছা রয়ে গেছে। এবার যাবো ভারতের সাধারণ নাগরিক হিসাবে; একজন বাঙালি হিসাবে।

(রুদ্র সাইফুল সম্পাদিত ‘শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক গ্রন্থে প্রকাশিত ভারতের সাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়-এর স্মৃতিচারণমূলক এ লেখাটি তাঁর বোনের ছেলে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও সংস্কৃতজন ড. আনন্দ আর বি গুপ্ত-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত; এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়-এর অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত