বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

3126

Published on মার্চ 11, 2020
  • Details Image

ড. এ কে আব্দুল মোমেনঃ

ভিশন ২০২১; ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জন; বা রূপকল্প ২০৪১। শব্দগুলো এখন প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয়। এর অন্যতম কারণ, অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ, বেড়েছে ক্রয়-ক্ষমতা। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে আগের তুলনায় বহু গুণ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে গেল কয়েক বছরের বৃত্ত ভেঙে ৮ শতাংশের মাইলফলক অতিক্রম করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছর শেষে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে। গত অর্থবছরে দেশে মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। বছর শেষে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১ হাজার ৯০৯ ডলারে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৫১ ডলার, আর ২০০৬ সালে ছিল ৫৪৩ ডলার। সে হিসাবে এই সময়ে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬৬ ডলারে।

অর্থনীতির এই যে ফুলে-ফেঁপে ওঠা, তার নিরিখেই বাংলাদেশ চমকে দিচ্ছে বিশ্বকে। নানা দেশের এ এক অনুকরণীয় মডেল। বিশ্ব নেতারাও উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো—অবাক বিস্ময়! অর্থনীতি তো আর ম্যাজিক নয়। জাদুদণ্ডের পরশে যার ভোল পালটানো যায় না। অনেক কষ্টে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা। পিছলে পড়লে ফের উত্তরণের সংকল্প। বিশ্বব্যাংক, এশীয় ব্যাংক হতভম্ব। বলছে দেশটা করেছে কী! আমরা তো ভেবেছিলাম বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সূচক কোনোমতে ছ’য়ের ঘরেই আবদ্ধ থাকবে বহুকাল। এখন দেখছি, তারা সাত পেরিয়েছে, আটের ঘরও পেছনে ফেলে যাচ্ছে আরো সামনে। ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবন হয়েছে আরামপ্রদ ও ব্যস্তময়। বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বব্যাপী। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে একে ‘উন্নয়নের মডেল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির উদীয়মান এই অগ্রযাত্রাকে ‘স্টার অব ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট’ বলছেন বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও। নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ভাষায় এ দেশের অগ্রযাত্রা হলো—‘Standard bearer of South Asia। নিউইয়র্ক টাইমস-এর ‘Success in a land Known for Disasters’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, মহিলাদের উন্নয়নে বাংলাদেশ যা করেছে, তা অন্য মুসলমান দেশের জন্য অকল্পনীয়; অবিশ্বাস্য।

এই যে, ৫৬ হাজার বর্গমাইল নিয়ে এক সময়ে যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, তলাবিহীন ঝুড়ির কটাক্ষ, তা থেকে উদীয়মান অর্থনীতির তারকা হিসেবে খ্যাতি। সত্যি, মনের গহিনে ডেকে যায় আনন্দের বান। পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বাংলাদেশকে টেনে সামনে নেওয়ার যে দুঃসাধ্য অভিযাত্রা, তার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতির উপমাগুলো এমনি এমনি রাজনৈতিক বক্তৃতার রাশিমালায় গ্রোথিত হয়নি। পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া যুক্ত হয়নি সরকারি প্রেস নোটে, কিংবা উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাবনায়। শব্দগুলোর মূল ভিত্তি রচিত হয়েছিল, একাত্তরে, বা তারও আগে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে। সেই সময়ে রোপিত বীজের পরিষ্ফুটন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন, সংশোধন আর পরিচর্যার পরে আজকের অবস্থান।

রাজনৈতিক অস্থিরতা আর নেতাদের দায়িত্বহীনতায় তিনি বুঝতে সক্ষম হন, বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে দলীয় সিদ্ধান্ত কিংবা নেতাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। দলের ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও অ্যাসেমব্লিতে ন্যাপ উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে গ্রামে গেছেন বঙ্গবন্ধু। সে সময় প্রত্যন্ত এক গ্রামের এক বৃদ্ধা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। “আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারণ শুধু আমাকে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানে পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসেবে হাজির করতেন। না নিলে রাগ করতেন। আমার মনে আছে, খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘বাবা, আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।’ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সঙ্গে, আমাকে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চারআনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এলো। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।” বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এটাই ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির নীতি।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতির শেষ পর্যায় তখন। ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনায় নতুন এক মাত্রা যোগ করে। একদিকে যেমন তিনি বুঝতে পারলেন, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাঙালি কতটা অসহায়, পাকিস্তান সরকার কতটা নির্বিকার, অন্যদিকে অনুভব করলেন, গরিব-দুঃখী মানুষগুলোর কী কষ্ট। তাই তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য চাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার কিছু অংশ তিনি প্রকাশ করলেন, ১৯৭০ সালের শেষ দিকে, পাকিস্তান টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে, তার প্রাক-নির্বাচনি ভাষণে। সেদিনের ভাষণে তিনি এমনসব বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন, যার সঙ্গে গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সরাসরি যোগ ছিল। তিনি শুরুতেই একচেটিয়াবাদ ও কার্টেলের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন। বললেন, ভূমি-সংস্কার না করার ফলে দরিদ্র কৃষকদের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। ৯০ লাখ শ্রমজীবী মানুষ বেকার। পাশাপাশি তিনি তুলে ধরেন অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভয়াবহ এক চিত্র। গ্রামাঞ্চলে প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থার কথা জানালেন। আর বললেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তিনি কী কী করবেন। বৈষম্য দূর করবেন। সমবায় সমিতি গড়ে তুলবেন। শিল্পের প্রসারে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে গুরুত্ব দিবেন। কৃষি ব্যবস্থা সংস্কার করবেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিবেন। গ্রামে গ্রামে বিজলিবাতি দিবেন। পুঁজি বিনিয়োগ করবেন শিক্ষা খাতে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাসগৃহ নির্মাণ করবেন। প্রতি ইউনিয়নে পল্লি চিকিত্সাকেন্দ্র খুলবেন। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সবকিছুর পুনর্বিন্যাস করবেন। নয়া মজুরি কাঠামো তৈরি করবেন। জনগণের সরকার কায়েম করবেন।

’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তার দল স্মরণকালের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করা হয়। তীব্র প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু জনতার ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে ধারণ করে জাতিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো’। সে ভাষণ ছিল সংগ্রামের প্রারম্ভিকা। ছিল মুক্তির সূচনা। জনযুদ্ধের নির্দেশক এ ভাষণ একটি জাতির উন্মুখ চেতনাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

এ কণ্ঠ কাঁপিয়ে দিয়েছিল সমগ্র দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষকেও। তাই বিশ্বের বড়ো বড়ো জননেতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। সমগ্র দেশবাসী এ ভাষণ শুনে শিহরিত হয়েছেন। সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে গণ্ডিবদ্ধ নেই। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এলো স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত জাতির ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার স্থপতি। জাতির জনক। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের আকাশে পতপত করে উড়ল লাল সবুজের নতুন পতাকা। দেশ হয় হানাদার মুক্ত।

’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে প্রথম পা রাখেন। বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরলেন। শুরু করলেন, ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে’ যাত্রা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ব্যাপক অগ্রগতির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রবর্তক। তার অর্থনৈতিক আদর্শ ও কৌশল ছিল নিজস্ব সম্পদের ওপর দেশকে দাঁড় করানো। এক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন সোনার বাংলা গড়ে তোলার। অঙ্গীকার অনুযায়ী, চমত্কার একটি সংবিধান দিলেন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই। সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা লেখা আছে সংবিধানের পাতায় পাতায়। জাতিকে উপহার দিলেন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, যার মূল লক্ষ্য ছিল সম্পদের সামাজিকীকরণ। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত শ্রেষ্ঠ বাঙালি মেধার সম্মিলন ঘটালেন তিনি পরিকল্পনা কমিশনে। যাত্রাতেই বললেন, ‘আমাদের চাষিরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি। তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’

লেখক :পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

প্রকাশঃ দৈনিক ইত্তেফাক (১০ মার্চ ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত