মৃত্যুঞ্জয়ী, চির অম্লান তুমি

1919

Published on মার্চ 17, 2020
  • Details Image

সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। কতদিনের প্রতীক্ষা, ক্ষণগণনা শেষ হলো। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফলÑ/পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক...। অতঃপর মহা পুণ্যের পূর্ণতার দিন এসেছে।

আজ ১৭ মার্চ মঙ্গলবার বাঙালিত্বের মহান সাধক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের প্রথম শুভক্ষণ। শততম জন্মবর্ষ। মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ককে স্মরণ করার এর চেয়ে বড় উপলক্ষ বাঙালীর জীবনে আর আসেনি। দিনটিকে সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, রাজনীতির কবি, অবিসংবাদিত নেতা, লোকনায়ক, গ্রীক পুরানের বীর, বাংলার প্রমিথিউসÑ অভিবাদন আপনাকে। শুভ জন্মদিন, প্রিয় পিতা!

‘তোমার মৃত্যুর কাছে কোটি কোটি জীবন আজো নতজানু।’ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের শুকনো ঝরাপাতা, ধানম-ি ৩২ নম্বরের ধীর শান্ত জলরাশি, বিস্মৃতপ্রায় টুঙ্গিপাড়ার উর্বর মাটি জল হাওয়া আজ জয় ঘোষণা করছে তোমার। রাজনৈতিক ভেদাভেদ, মত পথের ভিন্নতা, ব্যক্তিগত দূরত্ব ভুলে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখর গোটা জাতি।

বসন্তে রমনায় ফোটা সব রঙিন সুগন্ধি ফুল আজ তোমার অর্ঘ্য। গাঁয়ের ঝিলে ফোটা শাপলা যেন তোমার মুখের হাসি। দোয়েলের উড়ে বেড়ানোতে তুমি। তুমি বাউলের একতারায়। মিছিলে, প্রতিবাদী স্লোগানে, সংগ্রামে তুমি। ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি...বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে আজ।

তারও বহুকাল আগে ১৯২০ সালের আজকের দিনে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বেঁচে থাকলে আজ ১০০ হতো জনকের। শতবর্ষী হতেন তিনি। দৃশ্যপটে, হ্যাঁ, নেই। বাঙালীর অস্তিত্বের সবটুকুজুড়ে আছেন! এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান...। জনক শেখ মুজিব বাঙালীর চেতনায় বেঁচে আছেন। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের শ্যামল প্রান্তরে তাঁর দীর্ঘ ছায়া। পবিত্র পদচিহ্ন। ‘দুঃখের পথে তোমারি তূর্য বাজেÑ/অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্তমাঝে, মৃত্যুর হোক লয়।’ মৃত্যুকে বেদম মেরে পায়ের তলায় স্থান দিয়েছেন তিনি। কীর্তিমানের পদতলে ‘মৃত্যুরও মৃত্যু হইয়াছে।’ আজ তাই কান্না নয়। চোখের পাতা ভেজানো বারণ। হাসিমুখে উৎসবে যোগ দেয়ার দিন। আজ থেকে শুরু হলো মুজিবর্ষ। বছরব্যাপী আয়োজনে ক্ষনজন্মা নেতা দাতা ত্রাতার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাবে কৃতজ্ঞ জাতি।

আজ এমন এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে যখন তাঁরই উদার অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনে চমৎকার ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশ। ইতিহাস বিকৃতকারীরা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হয়েছে। প্রায় নিশ্চিহ্ন স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে নতুন গতি এসেছে। একই সময়ে ভিড় বেড়েছে সুযোগসন্ধানীদের। আলাদিনের চেরাগ হাতে রাজনীতি, এক চেয়ারে বসে আরেক চেয়ারের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চাটুকার আমলা, লুটেরা ব্যবসায়ী, দু’ হাত পেতে রাখা বুদ্ধিজীবী গণমানুষের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করে চলেছে। এমন বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর ডাক দেয়া মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার সাধনায় শপথে উদ্যাপিত হবে মুজিববর্ষ।

শেখ মুজিবুর রহমান আদর্শ রাজনীতির প্রতীক। দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য যে রাজনীতি, তা আসলে কী? কেমন হয়? আজকের রাজনীতি দেখে উত্তর পাওয়া যায় না। ফিরতে হয় সেই বঙ্গবন্ধুর কাছেই। দেশের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে, জনগণের অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করায় ১৪ বছর কারাগারে কাটাতে হয় তাঁকে। দেশ ও জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট, নেতৃত্বের গুণ শেখ মুজিবুর রহমানকে সমকালীন অন্য রাজনীতিকদের চেয়ে আলাদা করে তোলে। তাঁর মাঝে ছিল বিরল সম্মোহনী ক্ষমতা। অদ্ভুত এক আকর্ষণ ছিল। সব মিলিয়ে বাঙালীর প্রাণের স্পন্দন হয়ে ওঠেন তিনি। ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন। দেশপ্রেমের বোধ, জাতীয় চেতনা জাগ্রত করতে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। বাঙালীর মন ও মানস গঠনে তাঁর ছিল অসামান্য অবদান। প্রাচীন বাঙালী সভ্যতার আধুনিক রূপকার তিনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মহান স্থপতি। বাঙালী জাতিসত্তাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। এর আগে হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালীর আলাদা কোন স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। এমনকি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন অবাঙালী। স্বদেশী যুগের বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাসী ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদে। বিপরীতে বাঙালীর জন্য বাংলাদেশ নামের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাস রচনা করেন শেখ মুজিব।

হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর অনুসারী হিসেবে রাজনীতি শুরু করলেও, দেখা যায়, সুভাষচন্দ্র বসুর সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনৈতিক দর্শন তাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এ জাদুমন্ত্রে বাঙালীকে বশ করেছিলেন তিনি। সংগঠিত করেছিলেন। প্রস্তুত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য।

তারও আগে ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান।

মুজিবের মধ্যে বাঙালীর গণমুখী উদার অসম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক ও সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছিল। এ দেশের রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে একক ও অবিস্মরণীয় ভূমিকা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৫৫ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেন তিনি। তাঁর সচেতন প্রচেষ্টায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দর্শনের উন্মেষ ঘটে। আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেই মহা দর্শন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ধারণ করে আছে।

তবে হঠাৎ করে নয়, কারও দানে বা দয়ায় নয়, দেশপ্রেমের দীর্ঘ তপস্যা শেখ মুজিবকে আজকের অবস্থানে এনেছে। একেবারে শৈশব থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলী নিয়ে বিকশিত হতে থাকেন তিনি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে শুরু। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে হন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ অলঙ্কৃত করেন। শত নির্যাতন সহ্য করেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। পশ্চিম পাকিস্তানীদের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টি করে পেশ করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। ১৯৬৬ সালে তাঁর উত্থাপিত ছয় দফা দাবি ছিল বাঙালীর মুক্তির সনদ। এর পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ’৬৯ -এর গণঅভ্যুত্থানসহ নানা ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে বাঙালীর একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে ওঠেন তিনি। মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সমস্ত জনগণের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়।

কিন্তু ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও সরকার গঠন করতে দেয়া হয় না আওয়ামী লীগকে। এ অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে চূড়ান্ত ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেন: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এর প্রতিক্রিয়ায় আসে ২৫ মার্চের কালরাত। পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন শেখ মুজিব। তাঁর আহ্বানে প্রশিক্ষিত পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নয় মাস লড়াই করে বাঙালী। পাকিস্তান কারাগারে বন্দী মুজিবের নামেই চলে বাঙালীর সশস্ত্র সংগ্রাম। ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিজয়ী বীরের বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেন তিনি। যুদ্ধবিধস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে, সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে মনোনিবেশ করেন।

কিন্তু মাঝপথে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট চিরতরে থামিয়ে দেয়া হয় তাঁকে। এ দেশেরই একদল বিশ্বাসঘাতক দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তায় নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তাঁকে। সপরিবারে নিহত হন জাতির জনক। এই রক্তাক্ত বেদনাবিধুর ইতিহাস, এই কারবালা বাঙালীর বুকে চির ক্ষত এঁকে দিয়েছে। কলঙ্ক মুছবে না, ঘুচবে না কোনদিন। তবুও অযুত চেষ্টা। ফিরে পাওয়া আকুতি। এ আকুতির মাঝেই বেঁচে আছেন শেখ মুজিব। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষায়: যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান...। আরও সরল ভাষায় মহাদেব সাহা লিখেছেন: এই যে প্রতিদিন বাংলার প্রকৃতিতে ফুটছে নতুন ফুল/শাপলা-পদ্ম-গোলাপ-সেই গোলাপের বুক জুড়ে/ফুটে আছে মুজিবের মুখ।

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ (১৭ মার্চ ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত