জঙ্গিবাদ মোকাবেলার দর্শন : ‘আমি বাঙালি আমি মানুষ, আমি মুসলমান’

1627

Published on জুলাই 19, 2020
  • Details Image

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানঃ

পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান।’ বাংলাদেশ, বাঙালি ও তার সংস্কৃতি ছিল বঙ্গবন্ধুর চেতনাজুড়ে। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আজ থেকে বাঙালি জাতির এই আবাসভূমির নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধানের মূল স্তম্ভের একটি হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদী ভাবনার যে রূপ পাওয়া যায়, তার পুরোটাই ছিল আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলার ভাষা, লোকাচার, জীবনযাপন, বিনোদন, সাহিত্য ইত্যাদি সব কিছুকেই ধারণ করতে চেয়েছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নবতর পর্যায়ে উপনীত হয়। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যে বাঙালিত্ব নবযাত্রা শুরু করল তাই আবার হোঁচট খেল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার বিভীষিকার মধ্যে। হত্যাকারীরা তাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ডে জানান দিল তারা হচ্ছে ওই শক্তি যারা আজীবন বাঙালিত্বের বিরোধিতাকারী। যারা ষাটের দশকের রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিরোধিতা করেছিল। যারা তথাকথিত মুসলমানিকরণের নামে নজরুলের গান ও কবিতার শব্দ বদলিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান সঙ্গীতশিল্পী সামাজ’ কর্তৃক বন্ধুবন্ধুকে দেয়া সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একটি জাতিকে পঙ্গু এবং পদানত করে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করা। বাংলার মানুষ মুসলমান নয়, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নেই- এই ধরনের অভিযোগ দিয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে ২৩ বছর ধরে তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র চলেছে। আর বাংলার মানুষ এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয়-স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলন ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন।’ ১৯৭৪ সালে প্রথম সাহিত্য সম্মেলনের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘—- আমরা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে দরিদ্র নই। আমাদের ভাষার দুই হাজার বছরের একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে।

আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর।’ দুই হাজার বছরে বাঙালিত্বে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ইসলামের সংশ্লেষ ঘটেছে মাত্র শ’পাঁচেক বছর আগে। তাও আবার ঘটেছিল অত্যন্ত উদার সুফিবাদী পীর আউলিয়াদের দ্বারা। হজরত শাহ জালাল, শাহ আমানত, খানজাহান আলী, বায়েজিদ বোস্তামী, এরা সবাই ছিলেন উদার মনোভাবের সুফি। তারা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অক্ষুণœ রেখেই ইসলামের মূল মর্মবাণী এই অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের কিতাবি ইসলামকে হুবহু এ দেশে অনুসরণের জন্য জোর প্রয়োগ করেননি। যার কারণে ইদানীংকালে নারীদের পোশাক-আশাকে এ দেশে যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে তা কিন্তু গত হাজার বছরেও ছিল না। বেশভুষা, রেওয়াজ নীতি যেগুলোর বাড়াবাড়ি ইদানীং আমরা দেখছি এগুলোর অনেকগুলোই সাম্প্রতিককালের রেমিটেন্স প্রবাহের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভেসে এসেছে। যেমনটি বন্যার পানির সঙ্গে কচুরিপনা ভেসে আসে। এগুলোর অনেকগুলোই দীর্ঘমেয়াদে বাঙালির সংস্কৃতির অংশ হবে না। যেমনটি মাটিতে গ্রথিত না হতে পেরে কচুরিপানা সাগরে ভেসে যায়। কিছু কচুরিপনা অবশ্য বদ্ধ, ডোবা বা জলাশয়ে জন্মায়। যা বছরে একবার পরিষ্কার করতে হয়। আমাদের বাঙালির সংস্কৃতিতে রেমিটেন্স প্রবাহের সঙ্গে আসা সংস্কৃতির কিছু অপভ্রংশ, কিছু ছিটমহলে (ভৌগোলিক এবং মনস্তাত্তি¡ক) শিকড় গাথার চেষ্টা করলেও এগুলো কোনোদিন স্থায়িত্ব পাবে না। বর্তমানে যে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ আমাদের দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, এই নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে তখন বড় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দার্শনিক শূন্যতা। ধর্মীয় জঙ্গিত্ব একটি আদর্শিক সমস্যা। যারা একমুখী একটি দর্শনে বিশ্বাস করে এবং বিপরীতে আমরা কোনো দর্শন খুঁজে পাচ্ছি না। এই র‌্যাডিকেল দর্শনকে মোকাবেলার জন্য আমাদের আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিরে যেতে হবে- আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান’- এই দর্শনকে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের দার্শনিক দেয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। বাঙালির যে শাশ্বত সংস্কৃতি, সেটা বরাবরই উদার, পরমতসহিষ্ণু ও অন্যের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মপরিচয়ে মানুষ শব্দটি ওই অর্থেই ব্যবহার করেছেন : ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ মুসলমান বলতে নিজেকে ইসলাম ধর্মের মূল বাণীকে ঠিক রেখে নিজস্ব সংস্কৃতিকে অক্ষুণœ রেখে আমাদের পূর্বপুরুষ সাধকরা যা গ্রহণ করেছিলেন এই দুই মিলেই আমাদের মুসলমানিত্ব, এটা কোনো রাজনৈতিক ইসলাম (খিলাফত) নয়। বাঙালি, মানুষ আর মুসলমান এই তিনটি মিশ্রণে যে দৃঢ় দেয়াল তৈরি করা যায়, এটা ‘ফায়ারওয়ালের’ কাজ করবে। এখানে জঙ্গিবাদের ভাইরাসটি সহজে ঢুকতে পারবে না। উগ্রবাদী ধর্মীয় ভাইরাস ঢুকলেও বাঙালিত্বের হাজার বছরের ইতিহাস ঐহিত্য সেগুলোকে ধ্বংস করবে। সমস্যা হচ্ছে আমাদের ‘বিল্টইন’ রাজনৈতিক ভাইরাসগুলো নিয়ে। যে ভাইরাস বাঙালির সব অগ্রসরতা এবং প্রগতিশীলতাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। এরা এ দেশেরই লোক। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসেনি। এদের মাতৃভাষা বাংলা হলেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চেয়েছিল। ছয় দফাকে ভারতে ষড়যন্ত্র মনে করত। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে যুদ্ধাপরাধে জড়িয়েছিল। একই গোষ্ঠী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে আবার তাদের পূর্ব পাকিন্তান কায়েম করেছিল। ওই দিন আমাদের বাঙালিত্বকেও তারা হত্যার করেছিল। বাঙালিত্ব ও মনুষ্যত্বকে বিদায় করে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা অনুযায়ী তাদের ধর্মকেই একমাত্র অবলম্বন করেছিল, যার কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিনই সৌদি আরবসহ বেশিরভাগ কথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান ছিন্নবিন্ন করে তাতে ইসলামি লেবাস লাগানো হয়। এটা করেছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে তারই ধারাবাহিকতায় আরেক সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের পেরেকটিই আমাদের সংবিধানে গেঁথে দেয়। যা থেকে আমরা এখনো মুক্তি পাইনি। সামরিক স্বৈরশাসকদের ইসলামিকরণের নামে ঠকবাজ, প্রতারণার হাত থেকে ম্ুিক্ত পেতে নব্বই দর্শক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

সংশোধনের ধারাবাহিকতায় যখন পরিবর্তনগুলো হচ্ছিল তখনই আধাসামরিক লেবাসে গণতন্ত্রের নামে আবার দেশে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় অন্ধকারের শক্তি। এমনটি চলে ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এরই মধ্যে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট চেষ্টা হয় আর একটি ১৫ আগস্ট কায়েমের। পৃথিবীর জঙ্গিবাদী হামলার সর্ব নিকৃষ্ট উদাহরণগুলোর একটি ঘটে সেদিন। যেদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীসহ দলের শীর্ষ নেতাকে একসঙ্গে হত্যা করে আবার পুরোপুরি একটি পাকিস্তান কায়েম করে দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে জীবন রক্ষা পায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার। বহুবার হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয় জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর। আজকের যে জঙ্গি তৎপরতা তারও মূল টার্গেট কিন্তু শেখ হাসিনা। এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। জঙ্গিবাদের বৈশ্বিকীকরণ হয়েছে। বৈশ্বিক জঙ্গিত্বের হয়তো একটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষও রয়েছে। যেমন আইএসের লক্ষ্য সারা পৃথিবীতে না হলেও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু এলাকায় ইসলামি খিলাফত কায়েম করা। আমাদের দেশজ (হোমগ্রোন) জঙ্গিত্বের সঙ্গে আদর্শে মিল থাকলেও তাদের লক্ষ্য খিলাফত নয়। শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল জামায়াত-বিএনপি জোট বা অনুরূপ একটি শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পথ সুগম করা। এটা করার জন্য এ দেশেরই কিছু তরুণকে তারা বিভ্রান্ত করছে এবং অনেকাংশে সফল হয়েছে। এই বিভ্রান্তির অন্যতম উপাদান মতাদর্শগত উপাদান। তা মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন আর একটি মতাদর্শ। আমি মনে করি ‘বাঙালিত্ব’ আমাদের সবচেয়ে বড় মতাদর্শ। বাঙালিত্বই রুখতে পারে জঙ্গিত্ব।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত