জলবায়ু উদ্বাস্তুদের স্বপ্নের ঠিকানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্প

4025

Published on জুলাই 22, 2020
  • Details Image

কক্সবাজারের ইউসুফ জামানের প্রায় তিন দশকের উদ্বাস্তু জীবনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে বৃহস্পতিবার। বস্তির খুপরি ঘর ছেড়ে তিনি পাচ্ছেন আধুনিক সুবিধা সম্বলিত একটি ফ্ল্যাট।

১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে কুতুবদিয়ায় ইউসুফের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে আশ্রয় জোটে কক্সবাজার বিমানবন্দর লাগোয়া সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায়।

সেই জায়গায় চাটাইয়ের বেড়া আর শন, খড় দিয়ে ছাওয়া ঘরে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ৩০ বছর কেটে গেছে ইউসুফের। প্রৌড়ত্বে এসে তিনি এখন পাচ্ছেন নতুন ঠিকানা।

চার সন্তানের জননী জাহানারা বেগমও উঠতে যাচ্ছেন নতুন বাসায়। অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশ থেকে সাজানো পরিপাটি পাকা দালানে ওঠার বিষয়টি তার কাছে ‘স্বপ্নের চেয়েও বেশি’ কিছু।

তাদের মত ৬০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হবে। ঢাকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে খুরুশকুলে বাঁকখালী নদীর তীরে ২৫৩ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে এই ‘বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’। পুরো এলাকাকে চারটি জোনে ভাগ করে ১৩৯টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে।

সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ১৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হলে এসব ভবনে বসবাসের সুযোগ পাবে ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার, যারা কক্সবাজার বিমানবন্দরের পালে ফদনার ডেইল, কুতুবদিয়া পাড়া ও সমিতি পাড়ায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বহু বছর ধরে।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর বাস্তুহারা মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে কক্সবাজার বিমানবন্দরের পাশে এসব এলাকায় সরকারি খাস জমিতে আশ্রয় নেয়।

মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রকল্প এলাকা ঘুরিয়ে দেখানোর পর প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন বলেন, এটাই দেশের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য দেশের প্রথম আশ্রয়ণ প্রকল্প । “জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর জন্য এখানে যে পুনর্বাসন, এটাকে আমরা বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু পুনর্বাসন প্রকল্প বলতে পারি।… এ ধরনের প্রকল্প পৃথিবীতে বিরল।”

গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশনের চেয়ারম্যান জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনের ২০১৯ সালে এই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে যাওয়ার কথাও বলেন মাহবুব।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বাংলাদেশের নাম রয়েছে তার সামনের কাতারে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের ঝুঁকির কথা যেমন আসছে, তেমনি আলোচিত হচ্ছে দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশের মানুষের টিকে থাকার গল্পও।

২০১৯ সালে গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশনের ঢাকা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বান কি মুন বলেছিলেন, “আমরা এখানে বাংলাদেশের কাছে শিখতে এসেছি। অভিযোজনের বিষয়ে শেখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশই সবচেয়ে ভালো শিক্ষক।”

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন কর্মকৌশল প্রণয়ন করে বাংলাদেশ। এরপর গঠন করা হয় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নেই এ তহবিল পরিচালিত হচ্ছে।

যেভাবে শুরু

‘একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণা বাস্তবায়নে গৃহহীন মানুষের জন্য ঘর বানিয়ে দেওয়ার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে সরকার।

১৯৯৭ সালের ১৯ মে কক্সবাজার জেলাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বহু পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওইসব এলাকা পরিদর্শন করে গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনের তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে প্রথম প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প শুরু হয় ২০১০ সালে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল ৩ লাখ ১৯ হাজার ১৪০টি পরিবার ঘর পেয়েছে।

অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলো তৈরি করা হয়েছে পাকা ও আধা পাকা দালানের ব্যারাক আকারে। বহুতল ভবনে ফ্ল্যাট নির্মাণ খুরুশকুলের এই আশ্রয়ণ প্রকল্পেই প্রথম।

প্রকল্প পরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের আবাসনের জন্য এই বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষে শুরু হয় ভবন নির্মাণ।

সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের ২০টি ভবনের মধ্যে ১৯টির কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। প্রতিটি পাঁচতলা ভবনে থাকছে ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ফ্ল্যাট।

১০০১ টাকার নামমাত্র মূল্যে এসব ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হবে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে জীবন কাটানো পরিবারগুলোকে।

জেলা প্রসাশক কামাল হোসেন জানান, কক্সবাজার বিমানবনন্দর সম্প্রসারণের সময় ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবারের তালিকা করা হয়। তারাই এ প্রকল্পে বসবাসের সুযোগ পাবে।

এই প্রকল্প দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জেলা প্রসাশকের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। ভবনগুলোর নাম প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঠিক করেছেনভবনগুলোর নাম প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঠিক করেছেন।

যা যা থাকছে নতুন ঠিকানায়

মঙ্গলবার প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুরো এলাকাজুড়ে চলছে নির্মাণযজ্ঞ। শহর থেকে খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাওয়ার জন্য সুপ্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ভেতরের রাস্তা নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। কাটা হয়েছে পুকুর। জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য নদীর পাশে সাত মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া ভবনগুলোর আলাদা আলাদা নামও দেওয়া হয়েছে। কোনোটির নাম দেওয়া হয়েছে ইনানী। কোনোটার নাম বাঁকখালী। সাম্পান, ঝিনুক, কোরাল- এরকম নামও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীই এসব নাম ঠিক করে দিয়েছেন বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।

তিনি বলেন, ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের প্রতিটি ফ্ল্যাটে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সিলিন্ডারের সুবিধা থাকবে। প্রকল্প এলাকায় থাকবে ফায়ার স্টেশন, পুলিশ ফাঁড়ি। প্রতিটি ভবনের ওপর সৌর বিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পের সঙ্গে নদীর ধারে ঝাউবন করার নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে মাহবুব হোসেন বলেন, “আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এবং ভারনারেবল ২০ গ্রুপের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে।”

প্রকল্পের নির্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর দশম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং এরিয়া কমান্ডার মো. মাঈন উল্লাহ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “এটি অত্যন্ত নয়নাভিরাম একটি জায়গা। এই জায়গাটিকে সুরক্ষিত করার জন্য মাটিকে অনেক উঁচু করা হয়েছে। প্রতিটি ভবনের নিচের তলায় কোনো ফ্ল্যাট রাখা হয়নি। ফলে ঘূর্ণিঝড় হলে জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢোকারও আশঙ্কা নেই।”

তিনি জানান, সুপেয় পানির জন্য ইতোমধ্যে ১০টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। দুটি পুকুরও খনন করা হয়েছে। স্কুল তৈরি করা হয়েছে। প্রচুর তালগাছ ও ঝাউগাছ লাগানো হয়েছে।

২০২৩ সালে পুরো প্রকল্পের যখন শেষ হবে, তখন এখানে যে কেবল ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবার আশ্রয় পাবে, তা নয়। প্রায় ১০০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হবে আধুনিক পর্যটন জোন।

১৪টি খেলার মাঠ, সবুজ জায়গা, মসজিদ, মন্দির, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পুলিশ ও ফায়ার স্টেশন, তিনটি পুকুর, নদীতে দুটি জেটি, দুটি বিদ্যুতের সাবস্টেশন থাকবে এখানে।

প্রকল্পের আবাসিক ভবনগুলো সব ৫ তলা হলেও একটি ভবন হবে দশ তলা, যার নাম হবে শেখ হাসিনা টাওয়ার। এই ভবনের অবস্থান হবে পর্যটন জোনে।

২০ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ৩৬ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, তীর রক্ষা বাঁধ, ছোট সেতু, ঘাটলা ও খাল থাকবে পুরো প্রকল্প এলাকায়।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যারা ফ্ল্যাট পাবেন তাদের ঋণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা হবে।

যারা ফ্ল্যাট পাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই মসজীবী। সে কারণে সেখানে একটি শুঁটকি মহালও থাকবে। সেজন্য বিক্রয় কেন্দ্র ও প্যাকেজিং শিল্পও গড়ে তোলা হবে।

তবে অন্য পেশার মানুষও আছেন নতুন ঠিকানায় ওঠার স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলোর মধ্যে।

প্যারালাইসিসে ভোগা ইউসুফ জামান গরু-ছাগল পালন করেন। তার ইচ্ছে, নিজের ফ্ল্যাটে উঠলেও তিনি গরু-ছাগল পালনই চালিয়ে যাবেন।

সৌজন্যেঃ বিডিনিউজ২৪

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত