পাঠক বঙ্গবন্ধু লেখক বঙ্গবন্ধু

3503

Published on আগস্ট 22, 2020
  • Details Image

সুভাষ সিংহ রায়ঃ

বঙ্গবন্ধু যে প্রচুর শিল্প-সাহিত্যের বই পড়তেন, তা তার ভাষণ, বক্তৃতা, চিঠিপত্র আর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে রবার্ট পেইন দেখেছেন জর্জ বার্নার্ড শ, বার্ট্রান্ড রাসেলের রচনাবলি, মাও সে তুং স্বাক্ষরিত গ্রন্থ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকদের রুদ্ররোষে ২৪টি মামলায় ১৮ বার জেলে নিক্ষিপ্ত হন শেখ মুজিব। তিনি সর্বমোট ১২ বছর জেল খেটেছেন। আর ১০ বছর কড়া নজরদারিতে ছিলেন। জেলবন্দি নিঃসঙ্গ জীবনেও বই ছিল তার একমাত্র অবলম্বন।

১৯৫০ সালের ২১ ডিসেম্বর ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেল থেকে বঙ্গবন্ধু একটি চিঠি লিখেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। সেই চিঠিটি তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করলেও গবেষকরা পরবর্তী সময় উদ্ধার করেন। সেই চিঠিতে আছে- 'গত অক্টোবরে কেন্দ্রীয় জেলখানার গেটে যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, আপনি কথা দিয়েছিলেন, আমাকে কিছু বই পাঠিয়ে দেবেন। তবে এখনও কোনো বই পাইনি। ভুলে যাবেন না এখানে আমি একা আর বই-ই আমার একমাত্র সঙ্গী।' সত্যিই, কত অসাধারণ ছিল বইয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার 'স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার' লেখায় উল্লেখ করেছেন এভাবে :'আব্বার কিছু বইপত্র, বহু পুরনো বই ছিল। বিশেষ করে জেলখানায় বই দিলে সেগুলি সেন্সর করে সিল মেরে দিত। ১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন, কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল, যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশির ভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন আব্বা; কিন্তু আমার মা'র অনুরোধে এই বই ক'টা আব্বা কখনও দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নার্ড শ'র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল। জেলে কিছু পাঠালে সেন্সর করা হয়, অনুসন্ধান করা হয়, তারপর পাস হয়ে গেলে সিল মারা হয়। পরপর আব্বা কতবার জেলে গেলেন তার সিল এই বইগুলিতে ছিল। মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলি এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন।'

এ থেকে বুঝতে পারা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন বড় ধরনের পড়ূয়া মানুষ ছিলেন। আল বেরুনির ভারততত্ত্ব বইটির অনুবাদ হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি আমাদের অনেকেরই দেখা। তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজনামচা' ও 'আমার দেখা নয়া চীন' বইতে পাওয়া যায় বিশ্বসাহিত্যের নিবিষ্ট এক পাঠকসত্তাকে। অবাক হতে হয়, বিশ্বসাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের খবর তিনি রাখতেন।

বঙ্গবন্ধুকে কারাগারের ভেতরে সময় কাটাবার জন্যও নানা বিষয়ের বই হাতে তুলে নিতে হয়েছে। নিজেকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করেছেন। পরবর্তী জীবনে রাষ্ট্র পরিচালনায় সেইসব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন। আমরা সেইসব দিনের রোজনামচা বঙ্গবন্ধুর জবানিতে পেয়েছি। 'দিনভরই আমি বই নিয়ে আজকাল পড়ে থাকি। কারণ সময় কাটাবার আমার আর তো কোনো উপায় নাই! কারও সাথে দু-এক মিনিট কথা বলব তা-ও সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। বিকালের দিকে একা একা হাঁটাচলা করি, আর দুনিয়ার অনেক কথাই ভাবি। অনেক পুরানা স্মৃতি আমার মনে পড়ে।'

ডাচ্‌ দার্শনিক, আইনজ্ঞ, কূটনীতিক হুগো গ্রসিয়াস (১৫৮৩-১৬৪৫) তার কালজয়ী সৃষ্টি যুদ্ধ ও শান্তির আইন প্রসঙ্গে গ্রন্থে অতীতের যুদ্ধবিষয়ক ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সব প্রচলিত নিয়মনীতির ওপর দাঁড়িয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও দর্শন রচনা করেছেন, যাকে বলা হয় যুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের ব্যবস্থাপত্র। বইটির নাম 'অন দ্য ল অব ওয়ার অ্যান্ড পিস'। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের আইনজ্ঞরা যখন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রসিয়াসের এই গ্রন্থটি জেনেভা থেকে এনে তাদের দিয়েছিলেন।

আমরা জানি, ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টেরিটরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম আইন করেছিলেন। তখন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আর কেউ এই আইন করেনি। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ এই আইন করে। হুগো গ্রসিয়াস প্রণীত সমুদ্র আইনের বইটিও বঙ্গবন্ধু সংগ্রহ করে কমিটির কাছে এনে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন বিশ্বসাহিত্যের অনুরাগী পাঠক ছিলেন। সদ্য প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বইও তিনি পড়তে দারুণ আগ্রহী ছিলেন। "ঘরে এসে বই পড়তে আরম্ভ করলাম। এমিল জোলা-র লেখা 'তেরেসা রেকুইন' পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র- জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই-তিন ঘণ্টা সময়।" [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১০১]

১৯৬৭-এর জুনে পাকিস্তান সরকার জাতীয় পরিষদে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করে; সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৬৭-এর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আইয়ুব শাহির কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু : 'আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেকসপিয়ার, অ্যারিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সে তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য, আর সরকার আমাদের পাঠে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলা কবিতা লিখে বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এ-ব্যবস্থা মানি না, আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এদেশে গীত হবেই।'

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে এক ভ্রমণে গিয়ে নৌপথে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শোনার অনুপম অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে এই মহান নেতার কলমে। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রাণ। তিনি তো জানতেন এক একটি বাংলা অক্ষর এক একটি বাঙালির জীবন। বাঙালির জীবনে স্বাধীনতার আলোর জন্য তিনি নিপতিত হয়েছিলেন পাকিস্তানি কারা-অন্ধকারে। কারাকক্ষেও তিনি খুঁজে ফিরেছেন বাংলা বই ও পত্রিকা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে দারুণ কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন :'শিল্প-সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে এদেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা, সাহিত্য-শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাদের কল্যাণে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে, লেখনীর মাধ্যমে তার মুখোশ খুলে দিতে হবে।' তিনি এই সম্মেলনে আরও বলেছিলেন, 'জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না।' তিনি রাষ্ট্রনায়ক হয়েও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে 'স্যার' সম্বোধন করতেন।

ভারতবর্ষকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন ঐতিহাসিক পরিব্রাজক আল বেরুনি। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যবান এ গ্রন্থটি মূল আরবি থেকে বাংলা অনুবাদ করেন আমাদের খ্যাতনামা পণ্ডিত আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ। সেই সময়কার আল বেরুনির ভারততত্ত্ব বইটির অনুবাদ হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলোকচিত্রটি আমাদের অনেকেরই দেখা। আর তার এখন পর্যন্ত প্রকাশিত তিনটি বই 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' (২০১২), 'কারাগারের রোজনামচা' (২০১৭) এবং 'আমার দেখা নয়া চীন' (২০২০) ছাড়াও চিঠিপত্রেও আবিস্কার করি বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের নিবিষ্ট এক পাঠকসত্তাকে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই নেতার অন্তরজুড়ে। ১৯৬৬ সালের ১৭ জুলাই লেখা তার কারালিপিতে আছে রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি না পড়তে পারার খেদ :'আমার কতগুলি বইপত্র আইবি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader's Digest, টাইমস, নিউজউইক এবং রাশিয়ার চিঠি, কোনো বই-ই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই।...'

বাঙালির জীবনে স্বাধীনতার আলোর জন্য বঙ্গবন্ধু নিপতিত হয়েছিলেন পাকিস্তানি কারা-অন্ধকারে। কারাকক্ষেও তিনি খুঁজে ফিরেছেন বাংলা বই ও পত্রিকা। মার্কিন রাষ্ট্রতত্ত্ববিদ, লেখক হেনরি ডেভিড থরোর সুবিখ্যাত রচনা সিভিল ডিসঅ্যাবিডিয়েন্স (১৮৪৯) ছিল বঙ্গবন্ধুর পাঠের আওতায়। এপ্রিল ১৯৬৭-তে তিনি লিখছেন :"মনে রেখ থরোর কথা-'Under a government which imprisons any unjustly, the place for a just man is also a Prison.'' এভাবেই বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের পাতায় পাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পেয়েছেন চিরকালের মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষের দেখা। সে মানুষেরই স্বাধীনতার অধরা স্বপ্নকে অতঃপর রূপ দিয়েছেন স্বদেশের বাস্তবে।

আমরা লেখক বঙ্গবন্ধুকে আবিস্কার করতে পারি পুরোনো পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সময়কালের মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা পাঁচটি প্রবন্ধের সন্ধান পাই। 'নেতাকে যেমন দেখিয়াছি' (ইত্তেফাক, সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা, মার্চ ১৯৬৪। ১৩৭৬ সনের ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর, শুক্রবার 'ইত্তেফাক' পত্রিকায় লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হয়।), 'শহীদ চরিত্রের অজানা দিক' (ইত্তেফাক, সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা, রবিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৩৭২, ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৫), 'স্মৃতির মিছিল :হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী' (দৈনিক পাকিস্তান, বিশেষ প্রতিনিধি, শুক্রবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৩৭৬, ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯। ১৩৭৯ সনের ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৯৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার দৈনিক বাংলার বিশেষ সংখ্যায় লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হয়।), 'আমাদের মানিক ভাই' (ইত্তেফাক, সোমবার, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৬, ৯ জুন ১৯৬৯), 'আমার মানিক ভাই' (ইত্তেফাক, বৃহস্পতিবার, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯, ১ জুন ১৯৭২। ১৩৮০ সনের ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৯৭৩ সালের ১ জুন, শুক্রবার ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) স্মৃতিসংখ্যায় লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হয়।

লেখকঃ রাজনৈতিক বিশ্নেষক

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত