জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন সময়ের দাবি

3059

Published on সেপ্টেম্বর 21, 2020
  • Details Image

অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূরঃ

দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষকে পাকিস্তানী শোষণের হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলেন। এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেছিলেন (যা এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে)। পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু দ্রুত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন শুরু করেন এবং সফলভাবে অর্থনৈতিক এবং অর্থনীতির বাইরের উভয় খাতের গভীরে প্রথিত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন। সেই স্বপ্নের ঘোর কাটতে না কাটতেই বাঙালীর জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার, যা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে নৃশংসতম ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রীমহল সপরিবারে হত্যা করে আমাদের জাতির পিতাকে। সেদিন দেশের বাইরে থাকায় দৈবক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। সেদিন স্বাধীনতাবিরোধী চক্র একে একে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ২০ জন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা চালায়। এই হত্যাকা-ের মাধ্যমে খুনীরা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থেকে বাঙালিত্ব ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে চিরতরে বিদায় করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে এদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার স্বপ্নে বিভোর ছিল।

এই হত্যাকা-ের মাত্র ৯ দিনের মাথায় ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ এ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি (কালো আইন) ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত এই কালো আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ তফসিল ভুক্ত করেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান এই কালো আইনের বৈধতা না দিলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ আগস্টের খুনীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া যেত। জিয়াউর রহমানই ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, ভবিষ্যতে কেউ যাতে ব্যবস্থা না নিতে পারে সে ব্যবস্থা করে দিলেন এবং ঐ সময়ে একটি প্রোপাগা-া ছড়িয়ে দিলেন যে, যেহেতু অধ্যাদেশটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, সেহেতু এটি আর পরিবর্তন করা সহজ হবে না। এই আইন বাতিল করতে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সংবিধানের মূল অংশ পরিবর্তন করতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হয়। কোন তফসিলভুক্ত আইন পরিবর্তন করতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন না। শুধু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেই যে কোন আইন পরিবর্তন করা যায়। তারপরেও তারা প্রোপাগা-া ছড়িয়ে ছিলেন যে, এই আইন পরিবর্তন করা যাবে না। এই দোহাই দিয়েই জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনীরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের দীর্ঘ ২১ বছর পর সংবিধান সংশোধন করে বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালে আত্মস্বীকৃত কয়েকজন খুনীর রায় কার্যকর করা হয়। এখনও ওই মামলায় দ-প্রাপ্ত পাঁচ খুনী পলাতক রয়েছে। জানগণের চাওয়া খুব শীঘ্রই দ-প্রাপ্ত পলাতক খুনীদের দেশে ফেরত এনে রায় কার্যকর করা হোক। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

তবে হত্যাকা-ের বিচার হলেও নেপথ্যে ষড়যন্ত্রকারীরা (স্বাধীনতাবিরোধী চক্র) এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। তাই জনগণ এখন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের শনাক্ত করা এবং যারা বেঁচে নেই, প্রয়োজনে তাদের মরণোত্তর বিচারের দাবি তুলেছে। কারণ নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীরাই এই হত্যাকা-ের জন্য মূলত দায়ী। নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদের যদি শাস্তি না দেয়া হয়, তাহলে তারা বার বার এ ধরনের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবে এবং ভাবতে থাকবে আমরা বিচারের বাইরে থেকে যাব। তারা এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটানোর চেষ্টাও করেছে। যেমন, ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার বছরই জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালায় ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসীরা। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ৮ দলীয় জোটের সমাবেশ ছিল। চট্টগ্রাম বিমান বন্দর থেকে মিছিল করে সমাবেশস্থলে যাবার পথে ট্রাক মিছিলে শেখ হাসিনার ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীদের ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধুর খুনী ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালায়। তখন শেখ হাসিনা ঐ বাসভবনেই ছিলেন। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে দুপুর আড়াইটার দিকে শেখ হাসিনা গ্রিন রোডে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে ভোটের পরিস্থিতি দেখতে যান। গাড়ি হতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই জিয়ার উত্তরসূরিরা শেখ হাসিনার ওপর গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণ করে। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী ও নাটোর রেল স্টেশনে প্রবেশের মুখে শেখ হাসিনাকে বহনকারী রেলগাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারের কাছে সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় শেখ হাসিনার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতার পর হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ২০০০ সালের ২২ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছে এবং হেলিপ্যাডের কাছে ২০ জুলাই ৭৬ কেজি ওজনের বোমা গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে। ২২ জুলাই বেলা সাড়ে ১০টায় শেখ লুৎফুর রহমান ডিগ্রী কলেজ মাঠে ওই জনসভায় শেখ হাসিনার বক্তব্য রাখার কথা ছিল। ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনার। সেখানে পুঁতে রাখা বোমা উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে রাত ৮টার দিকে শেখ হাসিনার জনসভাস্থল থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হলে ঘটনাস্থলেই দু’জনের মৃত্যু হয়। আগেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ভেস্তে যায় শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টা। ২০০২ এর ৪ মার্চ যুবদল ক্যাডার খালিদ বিন হেদায়েত নওগাঁয় বিএমসি সরকারী মহিলা কলেজের সামনে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা চালায়। ২০০২ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি-জামাত নেতা-কর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালায়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন জোটের এমপির প্রত্যক্ষ মদদে জোট সন্ত্রাসীরা শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা চালায় বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়। ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে গুলিবর্ষণ করে জামায়াত-বিএনপি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তি সমাবেশস্থলে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও নিহত হন আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী। হামলায় আরও ৪শ’ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। এই যে এতবার শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য হামলা, এটা সম্ভব হয়েছে নেপথ্যে ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার না হওয়ার কারণে। সেজন্য নেপথ্যে ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে একটি জাতীয় কমিশন এখন সময়ের দাবি। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে দেখে স্বাগত জানাই। কারণ, ষড়যন্ত্রকারী এবং নেপথ্যে খুনীদের মুখোশ উন্মোচন এবং যারা ওই হত্যাকা-ের কুশীলব, ষড়যন্ত্রকারী ছিল, যারা সাহস করে সামনে আসতে পারেনি, তাদের (ষড়যন্ত্রকারী) অনুসারীরা যাতে আগামীতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে ধ্বংস করতে না পারে, সেজন্য এই জাতীয় কমিশন গঠন এবং তাদের (ষড়যন্ত্রকারী) বিচারের আওতায় আনা এখন কমিশন গঠন এবং বিচার হলে দেশ-বিদেশের সকল মানুষ ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকা- সম্পর্কে সঠিক জানতে পারবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় এড়াতে পারেন না অনেকেই। প্রধান হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে। এখন সময় এসেছে সমাজে শুভ মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পেছনের চক্রান্তকারী এবং হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের রায় প্রকাশ করার পর থেকে অনেকেই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা শুরু করেছেন। এটা নিয়ে লেখালেখিও হচ্ছে, বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া হচ্ছে। সরকারী পর্যায়েও খোঁজ-খবর নেয়া শুরু হয়েছে বলে স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশকে যদি গুপ্ত ঘাতকদের ষড়যন্ত্র থেকে পরিত্রাণ পেতে হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য জাতীয় কমিশন গঠন করা এখন বাস্তবতা এবং আমরা এর জোর দাবি জানাচ্ছি।

লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকন্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত