বত্রিশ নম্বর থেকে ৫/১২ লালমাটিয়া

1511

Published on সেপ্টেম্বর 28, 2020
  • Details Image

আবদুল্লাহ আল মামুনঃ

১৭ মে ১৯৮১। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমানে করে পাঁচ বছর সাড়ে ৯ মাস পর স্বজনহারা শেখ হাসিনা দেশের মাটিতে ফিরলেন। মা-বাবা, তিন ভাইসহ স্বজনদের হারিয়ে তিনি তখন শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে আছেন। সেদিন ঢাকায় এসে স্বজনদের মুখ দেখতে না পেলেও দেশের আপামর মানুষের ভালোবাসায় অভিভূত হয়েছিলেন তিনি।

ওই দিন সন্ধ্যায় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে গণসংবর্ধনা নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা যখন লালমাটিয়ায় ফুফুর বাসায় এলেন, তখন রাত হয়ে গেছে। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি। সেই প্রতিকূল আবহাওয়ায় শেখ হাসিনা শিশু কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নিয়ে ওঠেন ৫/১২ লালমাটিয়া, ডি ব্লকে ছোট ফুফু খাদিজা হোসেন লিলির ভাড়া বাসায়। এই বাড়িতে প্রিয় ছোট ফুফুর সান্নিধ্যে কেটেছে শেখ হাসিনার বেশ কটি দিন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নি (ছোট বোন খাদিজা হোসেন লিলির মেয়ে) হাবিবা হোসেন ডলি সেই সময়কার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে গত শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর মা-বাবা ও ভাইদের হারিয়ে দেশে ফিরে প্রথম দিন মার সঙ্গে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) যখন দেখা হয়, তখন তাঁরা দুজনই বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। কেউ কথা বলতে পারছিলেন না। এই দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’

হাবিবা হোসেন ডলি এখন স্বামী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা (সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, গণপূর্ত অধিদপ্তর) শহীদুজ্জামানের সঙ্গে ধানমণ্ডির ৪ নম্বর সড়কের বাসভবনে বসবাস করেন। মামা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার মাত্র পাঁচ দিন আগে ১৯৭৫ সালের ১০ আগস্ট প্রকৌশলী শহীদুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে মামাতো বোন শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরে তাঁদের লালমাটিয়ার বাসায় ওঠেন, তখন হাবিবা হোসেন স্বামীর বাসায় বসবাস করলেও ঝড়-বৃষ্টির ওই রাতে মা-বাবার বাসায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন লিলির ছোট মেয়ে রোজীর বিয়ে হয় মামাতো ভাই শেখ জামালের (বঙ্গবন্ধুর মেজো ছেলে) সঙ্গে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রোজীও নিহত হন।

বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন লিলিকে একটু কি বেশিই ভালোবাসতেন শেখ হাসিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে হাবিবা হোসেন বলেন, “হাসু আপা মাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। মা মামাকে (বঙ্গবন্ধুকে) ‘মিয়া ভাই’ বলে ডাকতেন। মামি শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে ছিল মায়ের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তাই মা আমাদের আগের সোবহানবাগের বাসা থেকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে প্রায়ই ছুটে যেতেন।”

খাদিজা হোসেন লিলি ২০১২ সালের ১ মে ঢাকার একটি হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত জটিলতায় মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি ধানমণ্ডির ৪ নম্বর সড়কের বাড়িতে মেয়ে ডলি ও জামাতা শহীদুজ্জামানের সঙ্গে বসবাস করতেন। প্রিয় ফুফুকে অন্তিমযাত্রার আগে বিদায় জানাতে এই বাসায়ই ছুটে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে রাতে শেখ হাসিনা মেজো ফুফু আসিয়া খাতুনের (শেখ ফজলুল করিম সেলিমের মা) লালমাটিয়ার ২/১৬ বি ব্লকের ভাড়া বাসায়, নাকি ছোট ফুফু খাদিজা হোসেন লিলির বাসায় গিয়ে ওঠেন, তা নিয়ে অবশ্য কিছুটা মতদ্বৈততার কথাও জানা গেছে তাঁর (শেখ হাসিনা) স্বজনদের কাছ থেকে।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহকারী আবদুর রহমান রমা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে একই বিমানে আমি ১৭ মে ১৯৮১ সালে দিল্লি থেকে ঢাকায় আসি। তারপর আমরা লালমাটিয়ার ডি ব্লকে বঙ্গবন্ধুর ছোট বোনের ভাড়া বাসায় থাকতাম। এখানেই বেশি সময় কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ছোট ফুফু খাদিজা হোসেন লিলির সঙ্গেই বেশি অন্তরঙ্গতা ছিল তাঁর।’ আবদুর রহমান রমা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে কর্মরত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে তিনি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে প্রত্যক্ষ করেন খুনিদের নৃশংসতা।

শেখ হাসিনার ছোট ফুফু খাদিজা হোসেন লিলির স্বামী প্রয়াত সৈয়দ হোসেন ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। এই বাড়িটি প্রয়াত ব্যাংক কর্মকর্তা নূর আহমেদের। পাঁচতলা ভবনের এই বাড়ির তিনতলায় থাকতেন খাদিজা হোসেন লিলি। বাড়ির সামনে বাঁ দিকে রয়েছে গ্যারেজ। গ্যারেজের দোতলায় শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান রমাসহ অন্য কর্মচারীরা থাকতেন বলে জানান বাড়িটির মালিক নূর আহমেদের মেজো ছেলে শওকত আলম। তিনি জানান, শেখ হাসিনা ছোট ফুফুর সঙ্গে এই বাসার তিনতলায় থাকতেন। তবে শেখ হাসিনা এই বাসায় বেশিদিন থাকেননি।

শওকত আলম গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি দেখলাম, একদিন সকালে আব্বা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে বলছেন, আমি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করি। এখন ক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। আপনি এখানে থাকলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ বাড়িতে ভিড় করবেন। এতে আমার চাকরির সমস্যা হতে পারে। তাই আপনি এখানে না থেকে অন্য বাসায় চলে যান। তারপর জি চাচা বলে তিনি (শেখ হাসিনা) আমার আব্বাকে আশ্বস্ত করে অন্য বাসায় চলে যান।’ উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমান ওই বছরের ৩০ মে চট্টগ্রামে নিহত হন।

লালমাটিয়ার ২/১৬ বি ব্লকের বাড়িটি খলিলুর রহমান খন্দকারের। বর্তমানে তাঁর বয়স প্রায় ৮০ বছর। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে মুক্ত হলেও বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি বেশ অসুস্থ। স্মৃতিশক্তিও কিছুটা লোপ পেয়েছে বলে জানালেন তাঁর বাড়ির কেয়ারটেকার আতাউর রহমান। একই তথ্য জানিয়ে ছেলে আবু জাফর খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৮১ সালে যখন শেখ ফজলুল করিম সেলিম তাঁর মাকে নিয়ে এই বাড়ির তিনতলায় বসবাস করতেন, তখন খুব ছোট ছিলেন তিনি। তাঁরা নিজেরা ওই বাড়ির দোতলায় বসবাস করতেন। এ কারণে তাঁর খেলার সঙ্গী ছিলেন শেখ সেলিমের দুই ভাতিজা পরশ ও তাপস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাবা শেখ ফজলুল হক মনি ও মা আরজু মনিকে হারিয়ে তখন দুই ভাই দাদির কাছে বড় হচ্ছিলেন। তাঁদের তিনতলা ওই বাড়িটি ভেঙে ২০১৫ সালে আটতলা ভবন করা হয়েছে।

আবু জাফর খন্দকার গত শনিবার কালের কণ্ঠকে আরো বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ বাড়িতে থাকতে দেখেছি। এই বাড়ির তিনতলায় ভেতরের একটি কক্ষে থাকতেন তিনি।’ আবু জাফর খন্দকার বলেন, ‘১৯৮১ সালের মে মাসের ঠিক কত তারিখ তিনি (শেখ হাসিনা) এ বাসায় এসে ওঠেন, তা আমার মনে নেই।’

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেজো বোন আসিয়া খাতুনের ছেলে শেখ ফজলুল করিম সেলিমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি একটি বই লিখছি। সেখানেই বিস্তারিত উল্লেখ করব।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির পান্ডারা রোডের বাসা ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্বামীর জন্য বরাদ্দ করা মহাখালীর আণবিক শক্তি কমিশনের সরকারি বাসায় ওঠেন শেখ হাসিনা।

সৌজন্যেঃ কালের কন্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত