যুদ্ধাপরাধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে শেখ হাসিনা

1339

Published on অক্টোবর 3, 2020
  • Details Image

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানঃ

বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ যুদ্ধ করেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী পথচলা সদা সরব থেকেছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে। লড়াইয়ের পথ ধরেই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন 'বঙ্গবন্ধু'। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'-ঐতিহাসিক ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ অর্জিত হয় বিজয় এবং স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে স্বাধীনতাকে পূর্ণতা দেন বঙ্গবন্ধু। শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন।

ইতিহাস বলে, স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দৃঢ় ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৬ এপ্রিল দিল্লির স্টেটসম্যান পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'যারা গণহত্যা করেছে, তাদের এর পরিণতি থেকে রেহাই দেওয়া যায় না। এরা আমার ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। এদের ক্ষমা করলে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ এবং বিশ্বসমাজ আমাদের ক্ষমা করবে না।' (দৈনিক বাংলা, ৩০ এপ্রিল ১৯৭২) জাতির পিতার দৃঢ়তায় সংসদে প্রণীত হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩।

বঙ্গবন্ধু শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে এই জনপদের পুরো জনগোষ্ঠীকে এক পতাকাতলে এনেছিলেন। কিন্তু পরাজিত পক্ষ থেমে থাকেনি। যে কাজটি তারা ১৯৭১ সালে করতে পারেনি, সেটিই ঘটায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। পঁচাত্তরের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পথ ধরে আসে সামরিক শাসন। আনা হয় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী। জারি হয় কুখ্যাত ইনডেমনিটি বিল। খুনিদের দেওয়া হয় দায়মুক্তি। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডসহ সব মানবতাবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হয়। বিধান করা হয়েছিল, পঞ্চম সংশোধনীর বৈধতা কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।

বস্তুত জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর শুরু হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি। শাস্তি দূরে থাক, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন শুরু হয়। ১৯৭২ সালের কোলাবরেটরস অর্ডার বাতিল করা হয়। ১৯৭৩ সালের আইনটিও থেকে যায় নিভৃতে। আইনের শাসনকে করা হয় অবরুদ্ধ। অসাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশীয় চিহ্নিত শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীরা হয় সুসংগঠিত, পুনর্বাসিত। একসময় রাষ্ট্র্রের শাসন ব্যবস্থায় তারা আসন নেয়। তাদের বাড়িতে, গাড়িতে ওড়ে লাল-সবুজের পতাকা।

ভাবতে অবাক লাগে, সুপ্রিম কোর্টের কোনো আইনজীবী বা দেশের গণতন্ত্রমনা কোনো নাগরিক পঁচাত্তর-পরবর্তী অসাংবিধানিক সংশোধনী ও পদক্ষেপগুলো চ্যালেঞ্জ করেননি। আমরা দেখেছি, জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনামলের পর আসে এরশাদের সামরিক শাসনামল। গণআন্দোলনে এরশাদের পতন হয়। এরপর ১৫ দলীয় জোট ও সাতদলীয় জোটের যৌথ রূপরেখার মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসে, তারাও ওই অসাংবিধানিক সংশোধনীর বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়টি বন্দিই থেকে যায়।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠে। সংসদে ইনডেমনিটি রিপিল বিল পাসের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ সুগম হয়। দেশের প্রচলিত সাধারণ আইনে এই বিচারকাজ শেষ হয়। বিচারিক আদালত হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে ১৯৯৮ সালে রায় প্রদান করেন। আমরা দেখেছি, শত বাধা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ওই পর্যায়ের বিচারকাজ এগিয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের, ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের পর আপিল পর্যায়ের বিচারকাজ স্থবির হয়ে যায়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। সচল হয় আপিল পর্যায়ের বিচারকাজ। চূড়ান্তভাবে এ পর্যায়ের বিচার শেষে এরই মধ্যে কয়েকজন ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। জাতি হয়েছে কলঙ্কমুক্ত।


আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার সতীর্থ বিচারক ছিলেন বিচারপতি মুজিবুর রহমন মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। আমরা একত্রে ১১টি মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করেছি। বর্তমানে ট্রাইব্যুনাল-২-এর কার্যক্রম স্থগিত আছে। বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১ চলমান আছে। দায়িত্ব পালনকালে জেনেছি বিচারে উঠে আসা অনেক নির্মম সত্য।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের ভূখণ্ডে যে নৃশংস প্রকৃতির অপরাধ সংঘটিত হয়, তা প্রকারান্তরে মানবসমাজের বিরুদ্ধে সংঘটিত। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করেছিল, তখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের নাগরিকদের কাছ থেকে এসেছিল 'গণআদালত'। বঙ্গবন্ধুকন্যার অদম্য দৃঢ় পৃষ্ঠপোষকতায় জাতির আকাঙ্ক্ষা উচ্চকিত হয় এই 'গণআদালতে'। প্রতীকী বিচার হয় এখানে। জেগে ওঠে নতুন প্রজন্ম। ১৪ এপ্রিল ১৯৯২ জাতীয় সংসদে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে এই 'গণরায়ের' সপক্ষে কথা বলেন। তিনি সেদিন বলেছিলেন, গণআদালতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি প্রস্তাব রাখেন। বলা বাহুল্য, সংসদে সেই প্রস্তাব পাস হয়নি।

২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনকারীদের বিচার করা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের অল্প কিছুদিন পর ১৯৭৩ সালের আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়। ২০১০-এর ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ২০১২-এর ২২ মার্চ গঠিত হয় ট্রাইব্যুনাল-২। এভাবেই শুরু হয় বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হওয়ার দীর্ঘ কাঙ্ক্ষিত পর্ব। এটি সম্ভব হয়েছে কেবল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অদম্য সাহস ও দৃঢ়তায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারকেই তিনি ধারণ করেছেন। দেশজ ও বৈশ্বিক নানা চাপ ও সমালোচনার কাছে তিনি এতটুকু পরাস্ত হননি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য প্রয়োজন প্রবল সাহসী রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অনুকূল অবস্থা এবং বৈশ্বিক সমর্থন। ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ্র্র্র্র্রবঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সোচ্চার হন বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে জাতিকে বের করে আনতে। ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোন যারা সল্ফ্ভ্রম হারিয়েছেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য, তাদের ও তাদের স্বজনদের প্রতি তার এই দায়বদ্ধতা। মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনকারীদের বিচারে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারই প্রতিফলিত হয়েছে কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় পদক্ষেপ ও সাহসের মধ্যে।

অসাংবিধানিক শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসিত ও একপর্যায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার কারণে দায়মুক্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার ব্যক্তির প্রতিকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই স্বীকৃত অধিকারটি দুটি মুখ্য মানবাধিকার দলিলে সন্নিবেশিত রয়েছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের (ইউডিএইচআর) অনুচ্ছেদ ৮ এবং আইসিসিপিআরের ২(৩) অনুচ্ছেদে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে 'কার্যকর' প্রতিকারের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ বিবেচনায় বাংলাদেশে নিজস্ব আইনে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচার কার্যক্রমের এখতিয়ার ও বৈধতা এবং স্বচ্ছতা ও মান প্রশ্নাতীত এবং যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তিমুক্ত।

২০১০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলেন, '১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের অপরাধ যারা সংঘটিত করেছে, তাদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। আইসিসির রোম স্ট্যাচুট, যা আমরা র‌্যাটিফাই করেছি, তদনুসারে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, কেবল বিচারই এসব ক্ষমাহীন ও ভয়ংকর অতীত অপরাধের বিচার ক্ষতকে দূর করবে।' (ইংরেজি থেকে অনূদিত)

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর আমরা দেখেছি, একটি সার্বভৌম দেশের বিচার ব্যবস্থাকে ও বৈধ আইনকে আক্রমণ করে দেশি ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উচ্চারিত নানা বাস্তবতাবর্জিত বিভ্রান্তিকর মন্তব্য। স্বাধীন জাতি হিসেবে এসব আমাদের আহত করেছে। তার পরও শেখ হাসিনা থেকেছেন অটল, তার অঙ্গীকার এবং সাহসী অবস্থান নতুন প্রজন্মকে করেছে উদ্দীপ্ত। এখনও বিচার চলছে। এরই মধ্যে ৪১টি মামলার রায় প্রদান করা হয়েছে। ছয়জন সাজাপ্রাপ্তর দণ্ড কার্যকর হয়েছে। ভবিষ্যতে বিশ্বের যে কোনো ভূখণ্ডে গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ও মানবতা সংরক্ষণে আমাদের ট্রাইব্যুনালের রায় ও পর্যবেক্ষণ এই শুভ ধারণা উচ্চকিত করবে যে 'নেভার অ্যাগেইন'।

বিচারকের শপথের বাধ্যবাধকতার জন্য অনেক কথাই বলা শোভন নয়। কিন্তু একটি কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না থাকতেন, তাহলে কি ইনডেমনিটি রিপিল বিল পাস হতো? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কি হতো? যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হতো? আমি নই, এর উত্তর দেবেন বিদগ্ধ পাঠক।

লেখকঃ বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত