লোকশিল্পীর পৃষ্ঠপোষক বঙ্গবন্ধু

1353

Published on নভেম্বর 25, 2020
  • Details Image

ড. তানভীর আহমেদ সিডনীঃ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিবিদ হিসেবে লোকঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি গণমানুষকে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন। তাঁর গণমানুষের সাথে যোগ ছিল বলেই তিনি এদেশের মানুষের জীবন-সংস্কৃতি এবং ভাবনাকে উপলব্ধি করতে পারতেন। তাঁর জেলজীবনের দিনলিপি কারাগারের রোজনামচায় লেখেন, “গ্রামে গ্রামে আনন্দ ছিল, গান বাজনা ছিল, জেয়াফত হতো, লাঠিখেলা হতো, মিলাদ মাহফিল হতো। আজ আর গ্রামের কিছুই নাই। মনে হয় যেন মৃত্যুর করাল ছায়া আস্তে আস্তে গ্রামগুলিকে প্রায় গ্রাস করে নিয়ে চলেছে।” বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ ছিল বাঙালি জাতির পিতার। সে সূত্রে শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ, কুতুবুল আলম, শাহ আবদুল করিম, অনিল দে, কছিমউদ্দিন প্রমুখের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে কারণেই তিনি শাহ আবদুল করিমকে বলতে পেরেছেন, ‘মুজিব ভাই থাকলে করিম ভাই থাকবে।’ 

গম্ভীরাকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে নেন। ১৯৭২ সালে নাটোর গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সামনে কুতুবুল আলম সমালোচনামূলক গম্ভীরা গান পরিবেশন করেন। দেশের মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু কেঁদে ফেলেন। চোখের জল মুছে তিনি মঞ্চে গিয়ে শিল্পীকে জড়িয়ে ধরেন । ভেবে দেখার বিষয় রাষ্ট্রপ্রধান একজন শিল্পীকে জড়িয়ে ধরছেন তার গান শুনে। শুধু তাই নয় তিনি এই শিল্পীকে জানালেন দেশের মানুষের জন্য তিনি কাজ করছেন। কুতুবুল আলম জাতির পিতার মাথায় মাথাল পরিয়ে দেন এবং হাতে লাঠি দিয়ে বলেন, “নানা তোমার লোকজন ঠিকমতো কাজ না করলে লাঠি দিয়ে পিটাবা। মাথাল দিলাম এই জন্য যে ক্ষেতে খামারে তুমি যখন যাবে তখন যাতে তুমি রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে পার।” এ থেকে বোঝা যায় লোকশিল্পীরা বঙ্গবন্ধুকে আপনজন মনে করতেন। জাতির পিতার মাথায় মাথাল পরিয়ে দিয়ে তিনি পরামর্শ দেন। এমনি করেই তিনি লোকশিল্পীদের সাথে মিশতেন। গণমানুষের সংস্কৃতির প্রতি তাঁর পক্ষপাত ছিল। এ বিষয়ে তিনি ১৯৭০ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর হোটেল পূর্বানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “শিল্পী, সাহিত্যিক এবং কবিদের জনসাধারণের আশা- আকাক্সক্ষা অবশ্যই প্রতিফলিত করতে হবে। তাঁরা তাদের মানুষ, মাতৃভূমি ও সংস্কৃতির জন্যে শিল্পচর্চা করবেন।”

গণভবনে একবার মন্ত্রীপরিষদের সদস্য, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিদেশিদের সামনে বাংলাদেশের লোকগানের আয়োজন করা হয়েছিল। এই আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কবিয়াল রমেশ শীল, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষের গান এবং গম্ভীরা পরিবেশিত হয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু গম্ভীরা গানের তথ্যচিত্র তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গম্ভীরা গানের ছয়টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। বিষয়গুলো হলোÑ আত্মসমালোচনা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃষি, পরিবার পরিকল্পনা, সমবায় ও দেশের সার্বিক অবস্থা। এগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করা হয়।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ বেতার পুনরায় লোকসংগীত পরিবেশন করে। সেইসময় বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিপরিষদকে গম্ভীরা গান শুনতে নির্দেশ দেন। তার পরের বছর লোকসংগীত পরিবেশিত হয়। এ অনুষ্ঠানে গম্ভীরা পরিবেশনের জন্য নানা-নাতি আমন্ত্রণ পান। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা তুলে ধরার পর নানা-নাতি কালো টাকার দৌরাত্মের কথা গানের মাধ্যমে পরিবেশন করেন। ঐ দিনই বঙ্গবন্ধু ১০০ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট বাতিলের ঘোষণা দেন। রাত ১২-০৫ মিনিটে বিশেষ বুলেটিনে নোট বাতিলের ঘোষণা করা হয়। এ সময়ে কুতুবুল আলম ও রেডিওর কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করে শিল্পীদের পারিশ্রমিকের দুর্দশা কাটানোর জন্য অনুরোধ করেন। শিল্পী অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে এর সমাধান করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কুতুবুল আলমের পরিবার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হন। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার রহনপুরের ঘাটনগরে কুতুবুল আলমের স্ত্রী, দুইপুত্র ও শাশুড়ি শহিদ হন। দৈবক্রমে তার বড় মেয়ে কাকলি ও দ্বিতীয় পুত্র কাজল বেঁচে যায়। বঙ্গবন্ধু এই লোকশিল্পীর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা জানার পর তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। জবাবে এই শিল্পী বলেন, “আপনি শুধু আমার জন্য দোয়া করবেন।” স্নেহপ্রবন রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, “যখন তুই ঢাকায় আসবি তখন সরাসরি গণভবনে আমার সঙ্গে দেখা করবি। যদি তুই দেখা না করছস তাহলে আমি তোকে পুলিশ দিয়ে ধরে আনব।” কুতুবুল আলম বলেন, “গণভবনে যেতে হলে নিরাপত্তাবাহিনীর লোকজন কী কী সব যন্ত্রপাতি লাগিয়ে তারপর আপনার কাছে নিয়ে যায়। তাই গণভবনে যেতে আমার মন চায় না।” বঙ্গবন্ধু বলেন, “ঠিক আছে। এখন থেকে নিরাপত্তার লোকজন তোকে আর চেক করবে না।”

জাতির পিতার কাছে মনে হয়েছে, লোকশিল্পীর জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই। তাঁর নিজের নিরাপত্তার চেয়ে বড়ো হয়ে গিয়েছিল একজন শিল্পীর মর্যাদা রক্ষা। যারা এদেশে রাজনীতি করবেন তাদের জন্য এটি একটি শিক্ষা যে একজন রাষ্ট্রপ্রধান মানুষের সঙ্গে কতটা যুক্ত থাকলে এমনি নির্দেশনা দিতে পারেন। একই সঙ্গে শিল্পবান্ধব শেখ মুজিব তাত্ত্বিকের ন্যায় বলেছিলেন, “তুই গম্ভীরা চালিয়ে যা। দরকার হলে তোকে নিয়ে আবার জাতীয়ভাবে গম্ভীরা গানের আসর করে মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘব করার চেষ্টা করব।”
কুতুবুল আলম তাঁর সুহৃদ, আত্মার আত্মীয় শেখ মুজিবকে বলেন, “বড় নানা, আমি কোমরে ব্যথার জন্য আগের মত নেচে নেচে গান করতে পারি না।” বঙ্গবন্ধু তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ডাক্তার ঘাস্ট এবং ডাক্তার সাইজার তাঁর চিকিৎসা করেন। শিল্পী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান তার খবর রাখতেন। সে সময়ের শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে তিনি বলেন, “আমার কুতুব যে হাসপাতালে আছে তোমরা কি তাকে একবার দেখতে গিয়েছিলে?” এ থেকে বোঝা যায় জাতির পিতা লোকশিল্পীদের সঙ্গে কতোটা অন্বিষ্ট ছিলেন।

লোকসংগীত শিল্পীদের বঙ্গবন্ধু যে কতো ভালোবাসতেন তা একটা ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে কুতুবুল আলম একবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাকে দেখেই বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “শুনছস আমার আলম মইরা গ্যাছে গা। আমি তোগো মরতে দিব না। তোরা সব আঁচর-কোঁচর খাবি। আমি তোগোরে তালা লাগাইয়া রাখুম।” দুজনেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন। যারা লেখাটি পাঠ করছেন তারা একবার ভেবে দেখুন, জাতির পিতা লোকশিল্পীর বেদনায় কাঁদছেন, এখানে একজন রাজনীতিবিদের চেয়ে বড়ো হয়ে ওঠেন বাঙালি প্রেমিক একজন মানুষ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাবতেন সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তাঁর আত্মার আত্মীয়। সে কারণেই তিনি শিল্পীদের ঘরের খবর রাখতেন। একবার অনেক লোকের ভীড়ে বঙ্গবন্ধু কুতুবুল আলমের কাছে গিয়ে গালে একটা আদর-চড় মেরে বলেন, “আমি শুনছি ছোট নানীর সব অলঙ্কারপাতি চুড়ি গেছে। তুই একবার আমার সঙ্গে দেখা করবি। ছোটো নানীর জন্য কিছু অলঙ্কারপাতি বানিয়ে দেব।” তিনি জানতেন লোকশিল্পীদের আয় বেশি নয় তাই তিনি শিল্পীর পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন শিল্পী কুতুবুল আলম বলেছিলেন, “বড় নানা আমি কী এতই গরীব যে আপনার কাছ থেকে ছোট নানীর অলঙ্কার নেব!” বঙ্গবন্ধু বলেন, “আর কমু না। আমাকে মাফ কইরা দিস। তুই যখন কিছুই নিলি না তখন তোকে এমন একটা জিনিস দিয়ে যাব যা চিরকাল থাকবে। তোকে লিটারারি পেনশনের ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব।” বঙ্গবন্ধু জানতেন সরাসরি কিছু দিলে এই শিল্পী নেবেন না। তাই পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে চাইলেন। তাঁকে মাসে ২০০ টাকা পেনশন বরাদ্দ করেছিলেন।

রাজনীতি-গবেষক ও তরুণ রাজনীতিবিদদের জন্য এটা একটা পাঠ। বাঙালি জাতির নেতা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে খবর রেখেছেন এদেশের আনাচে কানাচে থাকা লোকশিল্পীদের। আর সে সূত্রে গম্ভীরা গানের শিল্পী কুতুবুল আলমের পরিবেশনা মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের উপভোগ করতে বলেছেন। বেতারে এক সংগীত উৎসবে বঙ্গবন্ধু কোনো তথ্য না দিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেটা সেখানে উপস্থিত সকলকে বিস্মিত করেছিল। আমরা এই মহান নেতাকে তাঁর কর্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুসরণ করবো তবেই দেশ সত্যিকারের অর্থে সোনার বাংলা হবে।

লেখকঃ প্রভাষক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত