4222
Published on জুন 5, 2021সাখাওয়াত মজুমদারঃ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, অধিকারবঞ্চিত বাঙারির পক্ষে যে ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি পেশ করেন; তা বাঙালির বাঁচার দাবি বা ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা কর্মসূচি সমগ্র বাঙালি জাতির চেতনার মূলে বিস্ফোরণ ঘটায়। ছয় দফা ছাড়া জাতি হিসেবে টিকে থাকার অন্যকোনো বিকল্পই ছিল না আর। ঐতিহাসিক এই ছয় দফার ভিত্তিতেই যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়, ধাপে ধাপে তাই পরিণত হয় বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে। এই দাবির পক্ষে বাঙালি জাতির সর্বাত্মক রায় ঘোষিত হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে। অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর দলকে জনগণ বিজয়ী করলেও, পাকিস্তানিরা সরকার গঠন করতে না দেওয়ায়, বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তৎকালীন বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান অশুভ শোষণের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। সুদীর্ঘ ২৪ বছর পূর্ব পাকিস্তানকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী শাসন করে। পশ্চিম পাকিস্তানের এই পরিকল্পিত শোষনের হিংস্র থাবা থেকে মুক্তির জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে তার ঐতিহাসিক মুক্তির বাণী তথা ছয় দফা দাবি পেশ করেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে প্রাদেশিক শাসনের কথা উল্লেখ থাকলেও, শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের উপর ঔপনিবেশিক শাসন চালাতে থাকে। অর্থনৈতিক,সামরিক ও রাজনৈতিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একাধিপত্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তাহীনতায় ভূগতে থাকেন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙারিরা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শুরু হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আইয়ুবী দশকে এই বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন ব্যয় ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত, বাকি অংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য।
এছাড়াও আরো নানাক্ষেত্রেই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। ফলে দেখা যায়, যেখানে ১৯৪৯-৫০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ৩৩৮ টাকা, ১৯৫৯-৬০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৬৭ টাকা। অন্যদিকে ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ২৮৭ টাকা। ১৯৫৯-৬০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৭৭ টাকায়।
এভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উভয় অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যের পাহাড় গড়ে ওঠে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে, পূর্ব পাকিস্তানের চাকুরের হার ছিল ২৩ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে- যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় অতি নগন্য। এছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ছিল ব্যাপক বৈষম্য। প্রতিরক্ষা ব্যয়ের ক্ষেত্রে ১৯৫০- ৫১ থেকে ১৯৬৯-৭০ সালের এক সারণিতে দেখা যায়, ১৬ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট ব্যয়ের ৩৭৯৫.৫৮ কোটি টাকার মধ্যে ২১১৭.১৮ কোটি টাকা ছিল প্রতিরক্ষা ব্যয়- যার শতকরা হার ছিল ৫৬ শতাংশ। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রতিরক্ষা ব্যয় ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। এছাড়া বিভিন্ন বৈদেশিক সাহায্য, ঋণ প্রভৃতি ক্ষেত্রেই ছিল বৈষম্য।
১৯৬৬ সালে লাহোরে নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্সে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি সংবলিত এক কর্মসূচি পেশ করেন, যা ঐতিহাসিক ৬-দফা নামে পরিচিত। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও পশ্চিমাঞ্চলের নেতারা ৬-দফার বিরুদ্ধে জঘন্য অপপ্রচার চালায়। কিন্তু তাতে কোনোভাবেই স্বার্থক হতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র। মূলত ৬-দফা ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালিদের উপর দীর্ঘদিনের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংঘটিত পদক্ষেপ।
৬-দফা কর্মসূচিতে বলা হয়, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান প্রনয়ণপূর্বক পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যেখানে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বায়ত্বশাসন থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার হবে সংসদীয় প্রকৃতির এবং সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্বদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাগুলোর সার্বভৌমত্ব থাকবে। দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত ক্ষমতা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ক্ষমতা পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকবে।
পাকিস্তানের দু-অঞ্চলের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে। দু-অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। অথবা দু অঞ্চলের জন্য অভিন্ন মুদ্রা থাকবে কিন্তু সংবিধানে এমন সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দু-অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
সকল প্রকার কর, খাজনা ধার্য করার ক্ষমতা ও আদায় করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে।
দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের পৃথক-পৃথক হিসেব থাকতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে আর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে। ফেডারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমানভাবে অথবা সংবিধানে নির্ধারিত হারে আদায় হবে। দেশজ উৎপাদিত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে দু অঞ্চলের মধ্যে আমদানি, রপ্তানি করা চলবে। ব্যবসা, বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে।
অঙ্গ রাজ্যগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কার্যকরী অংশগ্রহণের জন্য সুযোগ দান এবং আঞ্চলিক সংহতি ও সংবিধান রক্ষার জন্য সংবিধানে অংগরাজ্যগুলোকে স্বীয় কর্তত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনা বাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
৬ দফা কর্মসূচি প্রকাশ হওয়ার পর পাকিস্তানি সরকার ও দক্ষিনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কেউ কেউ এর অপব্যাখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলার জনগণ এসব প্রতিক্রিয়াশীল এবং অপব্যাখ্যাকারীদের প্রত্যাখান করে। এরপর স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ৬-দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেয়।
মূলত ৬-দফা আন্দোলন ছিল সমগ্র বাংলার মানুষের বাঁচার দাবি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে সারাদেশে প্রচারিত হয় ৬-দফা। পাকিস্তানি সরকার ভীতসন্ত্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের গ্রেফতার করে। এর প্রতিবাদে সারদেশে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভ বানচাল করার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে পশ্চিমারা। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রগতিবাদী আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু বাংলার ছাত্র সমাজ ও স্বাধীনতাকামী জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা সভায় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়।
বাঙালি জাতির দুঃখ আর স্বপ্নকে ছয় দফা আক্ষরিক ও বাস্তবিক রূপ দিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তা অর্জনের মধ্য দিয়ে ছয় দফা সমুন্নত হলো এক ঐতিহাসিক মর্যাদায়। ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রের ইতিহাসে যেমন ম্যাগনাকার্টা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসেও তেমনি ছয় দফা উজ্জ্বল এক মাইলফলক। ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি যেমন সাম্য, মৈত্রী আর স্বাধীনতার বাণী; তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি ছয় দফা কর্মসূচি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।