৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদ ও বাংলাদেশের শাসনকাঠামো এবং উন্নয়নের পথনির্দেশক

895

Published on জুন 7, 2021
  • Details Image

ড. জহিরুল হক শাকিলঃ 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত ৬ দফা দাবি বাঙালীর ‘মুক্তির সনদ’ ও ‘বাঁচার দাবি’ নয়; বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলভিত্তি। ৭ জুন তথা ৬ দফা দিবসের প্রসঙ্গ আসলেই বাঙালী জাতির ত্যাগ, সংগ্রামী ও প্রতিবাদমূখর দিকটি চলে আসে। এদিনে বাঙালি জাতি ৬ দফা দাবির আদায়ের আন্দোলনে জীবন দিয়েছেন, রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছেন, ৮শ’রও বেশি গ্রেফতার হয়েছেন আর অগনিত মানুষ মামলার শিকার হয়েছেন। ৬ দফা দাবির পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ তথা কোনো একটি দলের নেতা থাকলেন না; হয়ে গেলেন আপামর বাঙালির একক নেতা। পরবর্তিতে বাঙালির আত্ননিয়ন্ত্রনের অধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বাধীনতা পরবর্তী রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতি সবকিছু আবর্তিত হতে থাকে একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আর তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আর কোনো ব্যক্তি থাকলেন না; হয়ে উঠলেন একটি প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠান, তাঁর দর্শন ও নেতৃত্বের পাশাপাশি ৬ দফা দাবিভিত্তিক আন্দোলনের পথ ধরেই স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধীকারের পথে বেয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রতিটি নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচীতে প্রতিফলিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবির দর্শন। এ যেন বাংলাদেশের জন্য ম্যাগনাকার্টাস্বরূপ। ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের এই চুক্তি অনুযায়ী রাজতন্ত্রের বিপরীতে সাধারন নাগরিকদের কিছু অধিকারের স্বীকৃতির পাশাপাশি রাজার ক্ষমতার সংকোচন ঘটে, রাজার স্বেচ্ছাচারিতার লাগাম টেনে ধরা হয়। এই ম্যাগনাকার্টা থেকেই সাংবিধানিক শাসনের শুরু। ইংল্যান্ডের অলিখিত শাসনতন্ত্রের বিপরীতে ম্যাগনাকার্টাই হলো মূল সাংবিধানিক দলিল ও পথ প্রদর্শক। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ও নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন সনদ প্রণয়নে ম্যাগনাকার্টা দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। অপরদিকে ৬ দফা দাবিও বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারসহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ে পাকিস্তানের স্বৈরাচার শাসন ব্যবস্থার উপর কুঠারাঘাত। ৮শ’ বছর আগে স্বাক্ষরিত ম্যাগনাকার্টা যেভাবে আজও সাংবিধানিক শাসন ও নাগরিক অধিকারের রক্ষাকবচ সেভাবে ৫৫ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত ৬ দফা দাবিও বাঙালির মুক্তির সনদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের শাসন ও নীতি প্রণয়নের মুল ভিত্তি। আর সেজন্যই ৬ দফা দাবিকে বাঙালি ও বাংলাদেশের ম্যাগনাকার্টা বলা হয়।

১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মেলনে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনের প্রথম দিন তথা ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি পেশ করলে পরদিনের পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিত্রিত করে সংবাদ প্রকাশ হলে তিনি সম্মেলন বর্জন করেন। ১১ ফেব্রুয়ারী ঢাকা ফিরে বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার ব্যাখ্যাই শুধু দেননি; এর যৌক্তিকতাও তুলে ধরেন। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬ দফা দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৬ দফা দাবি ও এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত ‘ছয় দফাঃ আমাদের বাঁচার দাবি’ শিরোনামে পুস্তিকা প্রকাশ ও সারাদেশে তা ব্যাপক প্রচার করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ও ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা পুণঃ পেশ করেন। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।

মূলতঃ ৬ দফা দাবি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোয় এক চরম আঘাত। সেজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের রোষানলে পড়ে অনেক কন্টাকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে আখ্যা দেয়ার অপচেষ্ঠা করা হয়েছে। জেলে যেতে হয়েছে। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ দল-মত নির্বিশেষে একাট্টা হয়েছেন ৬ দফা দাবি আদায়ে। আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে, ২৭ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর মাইজদী ও বেগমগঞ্জ, ৬ মার্চ সন্দ্বীপ, ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ১১ মার্চ ময়মনসিংহ সদর এবং ১৪ মার্চ সিলেট, ২৭ মার্চ সাতকানিয়া, ৭ এপ্রিল পাবনা ও নগরবাড়ী, ৯ এপ্রিল রংপুর, ১০ এপ্রিল দিনাজপুর, ১১ এপ্রিল রাজশাহী, ১৪ এপ্রিল ফরিদপুর, ১৫ এপ্রিল কুষ্টিয়া, ১৬ এপ্রিল যশোর এবং ১৭ এপ্রিল খুলনায় বিশাল জনসমাবেশে ৬ দফা যে বাঙালির অস্তিত্বের প্রশ্ন সেটা তুলে ধরেন। বাঙালিকে উজ্জীবিত করেন। এভাবে সারা দেশে ৩৫ দিনে অন্ততঃ ৩২টি বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান বক্তব্য রাখেন। এছাড়া সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিদিনই ছোটখাটো মিছিল মিটিং চলতে থাকে। প্রথমে এটি আওয়ামী লীগের কর্মসূচী হলেও বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বে ও বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত ব্যাখ্যা-বক্তৃতায় ৬ দফা অল্প সময়েই সর্বস্তরের বাঙালির দাবী ও আন্দোলনে পরিণত হয়। ধারাবাহিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী হরতাল আহবান করা হয়। হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে ১১ জন বাঙালি শহিদ হন। আন্দোলন আরো তীব্র হয়। রূপ নেয় গণ আন্দোলনে। সেজন্যই ৭ জুনকে পরবর্তী বছর থেকে ৬ দফা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। উল্লেখ্য ৬ দফা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলেন সিলেটের বিয়ানীবাজারের বড়দেশ গ্রামের ফখরুল মৌলা খান ওরপে মনু মিয়া। সেজন্য সিলেটের বিয়ানীবাজারে ৭ জুনকে মনু মিয়া দিবস হিসেবেও পালন করা হয়।

৬ দফা দাবি আওয়ামী লীগকে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের একক রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালির অধিকার আদায়ের ও সামনের দিকে এগিয়ে চলার বাতিঘরে পরিণত করেছে। এর পর থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দিতে থাকে। নেমে আসে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা। বাড়তে থাকে জেলজুলুম। যতই পাকিস্তানীদের নির্যাতন বাড়ে বাঙালিরা ততোই স্বোচ্চার হন। এরই মাঝে ছাত্র সমাজের ১১ দফা মিলে তুমুল ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকসহ সকল পেশাজীবী মানুষের সর্বাত্মক আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আসে ১৯৭০’র নির্বাচন। সে নির্বাচনে ৬ দফা ভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েই আওয়ামী লীগের ভুমিধ্বস বিজয়। নির্বাচনী ফলাফল না মানলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালিকে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির আহবান। স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন হয়ে পড়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাঙালির জাতির উপর নেমে আসে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এরই মাঝে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা ঘোষণায় ম্যাগনাকার্টা যেমন ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণায়ও ৬ দফা ছিল দিকনির্দেশক।

৬ দফার মূল বক্তব্য ছিল- প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার যেখানে আইন পরিষদ সার্বভৌম, স্বায়ত্বশাসন, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পৃথক থাকা এবং পূর্বপাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে মুদ্রা পাচার বন্ধ, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তশালী করতঃ আধা-সামরিক বাহিনী গঠন, অস্ত্র কারখানা ও কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন। আমরা ৬ দফার এ সারকথা বিশ্লেষণ করলেই দেখতে পাই ৫৫ বছর পরও স্বাধীন সার্বভৌম আজকের ২০২১ সালের বাংলাদেশে ৬ দফার প্রাসঙ্গিকথা রয়েছে। ৬ দফার আলোকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা ও তৎসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ, বিদেশে মুদ্রা পাচার রোধ ও যুগের আদলে গতানুগতিক ও মানবিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সুসংহত করার মাধ্যমেই আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, মানবাধিকার ও আপামর জনগনের ভাগ্যোন্নয়ন।

লেখক: অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত