আওয়ামী লীগের নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ

1361

Published on জুন 22, 2021
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭২ বছর পূর্ণ  করলো। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এক কঠিন সময়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নাম নিয়ে দলটির আত্মপ্রকাশ। ৭২ বছরের ইতিহাসে দলটি সুসময় অতিক্রম করেছে, দুঃসময় পাড়ি দিয়েছে। দলটিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বলা যায়, চ্যালেঞ্জ জয়ে পারঙ্গম এ দলটি।

আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সুবর্ণ মূহূর্ত নিঃসন্দেহে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর, যখন দলটির প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে সামনের সারিতে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব অংশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়, কিংবা স্বপ্ন বা কল্প জগতে বিচরণ করে নয়, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে। এই রায় আকস্মিকভাবে আসেনি। টানা প্রায় দুই যুগ তিনি স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত করেছেন। জাগরণের গান শুনিয়েছেন। তিনি নিঃসঙ্গ পথের পথিক ছিলেন না। এ ভূখণ্ডের আরও অনেক নেতা বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো কেউই লক্ষ্যে স্থির থাকেননি কিংবা থাকতে পারেননি। মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি জেল-জুলুম এমনকি ফাঁসির হুমকি সহ্য করে জনগণকে সচেতন করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন। একইসঙ্গে সংগঠন গুছিয়ে তুলেছেন। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেও এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, আদায় করেছেন তাদের সমর্থন। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে, এমন ধারণাও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তাঁর ছিল। ১৯৪৯ সালের ১৬-১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনে দাবি তুলেছিলেন- ‘এ ভূখণ্ডের ছাত্র-তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’ [বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৯-২৭০ ]

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ-এর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এই অবিনাশী উচ্চারণ যেমন আকস্মিক ছিল না, তেমনি ‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’ বক্তব্যেও ছিল পরিকল্পনার ছাপ। স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধারণ করতে হবে- এ বিষয়ে প্রস্তুতি তাঁর ছিল। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার সময় তিনি নিশ্চিত ছিলেন- মুক্তির মন্দির সোপান তলে জীবন বলিদানের জন্য অগণিত ছাত্র-তরুণ প্রস্তুত। তিনি নিজেই ১৯৫২ সালের ১৪ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে লিখেছিলেন- ‘আই হ্যাভ বর্ন টু সাফার।’ পরবর্তী ১৮ বছরে তাঁর এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিল অনেক অনেক ছাত্র-তরুণ।  

৭২ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি সুবর্ণ মুহূর্ত নিঃসন্দেহে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের ঘোষণা। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভলপমেন্ট পলিসি ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া সভায় বলেছে- মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত নিরাপত্তাহীনতা অতিক্রম- প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রধান পরামর্শদাতা এবং বিশ্বব্যাংকের কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলতে থাকেন- বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস এবং উন্নত দেশগুলোর ভিক্ষার দান ছাড়া দেশটি টিকে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের কিছু ‘জ্ঞানী ব্যক্তি’ও তাদের সুরে সুর মিলায়। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যের মোক্ষম জবাব প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনকেই বেছে নেন। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন- ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ প্রদানের পর  ‘ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেউ কেউ বাংলাদেশকে International Basket Case বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ Basket Case নয়। দুইশ’ বছর ধরে বাংলাদেশকে লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যাঞ্চেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের।.... আজো বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।’ [পৃষ্ঠা ১৯০] 

বাংলাদেশের এই সম্ভাবনার ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁরই প্রেরণায় স্বল্পোন্নত দেশের অবমাননা থেকে মুক্ত হওয়ার অভিযানে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের অর্ধশত বছরের অভিযাত্রায় প্রায় তিন দশক এমন শক্তি ক্ষমতায় ছিল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিÑ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ যাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। পাকিস্তান আমলের মতোই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পরিচালনা ছিল তাদের ধ্যান-জ্ঞান। ক্ষমতায় থাকা কোন কোন শক্তি এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বই মানতে পারেনি। উন্নত বাংলাদেশ সম্ভব- এ বিশ্বাস ‘অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একটি মহল’ পোষণ করেননি। বিশ্বব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি উন্নত দেশের চোখ দিয়ে তারা বাংলাদেশকে দেখেছে- ‘পরনির্ভরতাই বাংলাদেশের ভবিতব্য’। এমন প্রেক্ষাপটেই বিশ্বব্যাংকের প্রবল আপত্তি ও নানা কূটকৌশল উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ পদক্ষেপে বিশ্ব দেখেছে এক নতুন বাংলাদেশকে।       

আওয়ামী লীগের জন্ম সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই বছর পূর্ণ হতে না হতেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বদানকারী দল মুসলিম লীগের প্রধান এম এ জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসেই ঢাকা সফরকালে ঘোষণা দিয়ে গেছেন- ‘উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা’। খাজা নাজিমুদ্দীন, নুরুল আমিনসহ পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতারা এ অবস্থান দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। কিন্তু পাকিস্তানের জাতির পিতার অবস্থান চ্যালেঞ্জ করেন প্রবীণ জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং তাঁর সঙ্গে একদল তরুণ নেতা- যাদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার দিন শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনভুক্ত কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর আন্দোলন সমর্থন করার অভিযোগ তাঁর ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়ে পাঠানো হয় কারাগার। ইতিহাসের কী বিচার! শেখ মুজিবুর রহমানকে বহিস্কারের ঠিক ২০ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর নেতৃত্বে পরিচালিত প্রবল ছাত্র-গণ আন্দোলন তাকে পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে বরণ করে নেয় বঙ্গবন্ধু হিসেবে। এর দু’ বছর যেতে না যেতেই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তাঁরই আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে ডাকসু ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ উত্তোলন করে লাল-সবুজ-সোনালী রংয়ের পতাকা, যা  দেড় মাস যেতে না যেতেই স্বীকৃতি পায় নবজাত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা হিসেবে।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর যেতে না যেতেই ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূূচি ঘোষণা করেছিল, যার মধ্যে প্রধান ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা এবং স্বায়ত্তশাসন।

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নানা ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্ট সরকার কার্যকর হতে পারেনি। কিন্তু তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রাজপথের সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে কংগ্রেসসহ কয়েকটি দলের সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয়। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় আতাউর রহমান খানের ওপর। শেখ মুজিবুর রহমান একাধিক দফতরের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু শপথের দিনই ঘোষণা করেন- ‘মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির প্রবল চাপে পড়িয়াই আমি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলাম না। [ সূত্রÑ দৈনিক সংবাদ, ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬। সংবাদপত্র বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১১০]

প্রদেশের ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় এক বছর আগে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে  অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলটি  অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, সকল ধর্মের অনুসারীদের জন্য দলের সদস্য ও নেতৃত্বপদ উন্মুক্ত করার ঘোষণা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ ভূখণ্ডের জনগণ প্রথম ধারণা পায় যে সরকার জনকল্যাণে কাজ করতে পারে। কিন্তু অলক্ষে বিপদ ঘনিয়ে আসে- মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা-কর্মী নিয়ে ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এদের মধ্যে একদল ত্যাগী ও জনসম্পৃক্ত কর্মীও ছিলেন, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়ে যান। দলের বিভাজনের মুখে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালনে পূর্ণ সময় প্রদান করেন। ১৯৪৯ সালে দল প্রতিষ্ঠার পর তিনি দফায় দফায় জেলা ও মহকুমা সফরে গেছেন। হেঁটে বা সাইকেলে ও বাসে ঘুরেছেন একের পর এক জনপদ। মন্ত্রীত্ব ছাড়ার পর আরও বেশি করে সফর শুরু করেন। আওয়ামী লীগ প্রস্তুত হয়ে যায় ১৯৫৯ সালে নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনের জন্য। শাসকগোষ্ঠী বিপদ বুঝতে পেরে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে জারি করে সামরিক শাসন।

এই সামরিক শাসনের নিষ্ঠুর নির্যাতন সহ্য করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু সামরিক শাসন জারির সময় গ্রেফতার হন। আবার সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণেও তাঁর স্থান হয় কারাগারে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দল এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রািট ফ্রন্ট নামে জোট গঠন করেন, যারা মূলত পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র আদায়ের দাবিতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসন, কৃষক-শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ ও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির দাবি সামনে আনতে চেয়েছেন। এ কারণেই আওয়ামী লীগের একটি অংশের প্রবল বিরোধিতার মুখেও তিনি ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর ঠিক দুই বছর পর তিনি পাকিস্তানের ক্ষমতার দুর্গ লাহোর নগরীতে ঐতিহাসিক ছয়-দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট্রের ২১  দফার ১৯ নম্বর দফায় স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও অর্থ রাখার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু এক যুগের অভিজ্ঞতা ও নতুন বাস্তবতায় তিনি কেন্দ্রের হাত থেকে অর্থ ও বৈদেশিক বাণিজ্য প্রদেশে নিয়ে আসার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তানের শাসকচক্র এবং রাজনীতি ও অর্থনীতির পণ্ডিতরা বুঝে যানÑ ছয় দফা বাস্তবায়ন হলে এমনকি শিথিল ফেডারেশন থাকারও সুযোগ নেই, এ ভূখণ্ড আত্মপ্রকাশ করবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এ পথেই অগ্রসর হয় এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। 

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর স্বল্পোন্নত দেশগুলোরও পেছনের সারিতে থাকা বাংলাদেশের পুনর্গঠন কাজ সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধু এটা পেরেছিলেন। বাস্কেট কেসের অপবাদ ঘুচিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছিল বাংলাদেশ। এ জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক শক্তির সমাবেশ ঘটাতে তিনি গঠন করেন বাকশাল বা বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠনের সময় যারা এ দলে যুক্ত হয়েছিল (যাদের একটি অংশ ১৯৫৭ সালে ন্যাপ গঠন করে) তাদেরও অনেককে ফিরিয়ে আনতে পারেন তিনি। কিন্তু প্রচণ্ড আঘাত আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। রাষ্ট্র ক্ষমতা জবরদখলকারীরা  মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকা আওয়ামী লীগের চার প্রধান নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে। শত শত নেতা-কর্মী নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে উল্টো পথে যাত্রা শুরু করে। 

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে এবং বাংলাদেশ ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়াবে, ক’জনেই বা সে ভরসা করেছিল? শেখ হাসিনার কৃতিত্ব যে তিনি এটা সম্ভব করেছিলেন। কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে, এটা জেনে তিনি ধৈর্য্য ধারণ করেছিলেন। হঠকারিতার পথে পা বাড়াননি। আশির দশকে এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসন অবসানের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সামনের সারিতে চলে আসে। খালেদা জিয়ার বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল যখন গুলিস্তান চত্বরের ছোট পরিসরে কেন্দ্রীয় সমাবেশ করে, শেখ হাসিনা তখন বক্তব্য রাখেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের বিশাল চত্বরে। হরতাল-অবরোধ সফল করায় আওয়ামী লীগ কর্মীরাই বেশি সক্রিয়। এরপরও ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধাধীন ৮ দলীয় জোট জয়ী হতে পারেনি। শেখ হাসিনা আরও পাঁচ বছর ধৈর্য্য ধরেন।  দলের ভিত প্রসারিত করেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন বাতিলের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাংলাদেশে প্রকৃত আপসহীন নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ বছরের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলকে জয়ী করেন তিনি। ২৩ জুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনি খোন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যকে স্থান দেননি নিজের মন্ত্রিসভায়। পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে  তিনি বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করেন। একইসঙ্গে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালের প্রবল বন্যার পরও তিনি বাংলাদেশকে প্রথম বারের মতো খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারেন। প্রমত্ত যমুনায় নির্মাণ করেন বঙ্গবন্ধু সেতু। সে সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকঠামো প্রকল্প ছিল এটি। বিশ্বব্যাংক এ সেতুতে  রেল সংযোগ রাখতে চায়নি। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদের আপত্তি আমলে না নিয়েই সেতুতে রেললাইন স্থাপন করতে পারেন।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উন্নত বিশ্বের সারিতে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। এভাবে তরুণ প্রজন্মের সাথে আওয়ামী লীগের নতুন বন্ধন সৃষ্টি হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন ছিল এ বন্ধনেরই পরিণতি। 

আওয়ামী লীগ টানা এক যুগের বেশি ক্ষমতায়। এ সময়ে অভাবনীয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান বাস্তবে রূপ নিয়েছে। করোনাকালের মহাবিপর্যয় সামাল দিতে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। বাংলাদেশ সমৃদ্ধ দেশ হয়ে উঠবে, এ নিয়ে এখন আর সংশয় নেই এমনকি উন্নত বিশ্বেও।

উন্নত বিশ্বের সারিতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের সামনে। এ পথে রাজনৈতিক বাধা আছে। বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি প্রবলভাবেই সক্রিয় রয়েছে। ধর্মান্ধতার ওপর নির্ভর করে একটি মহল ক্ষমতায় যেতে চায়। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ আছে বুদ্ধিবৃত্তিক। দলীয় কাঠামো থেকে শুরু করে প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় নিরাপত্তা, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন বাড়িয়ে চলা, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক শাখার গণতন্ত্রায়নÑ কত কিছুতেই না দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে হবে। এ শক্তি নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের সমাজের পড়তে পড়তে। তাদের দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে আনা কিংবা প্রভাব বলয়ে সংগঠিত রাখার কাজ কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি পর্যায়ের মতোই ব্যাপক। ৭২ বছরের দলটির এ দিকে নিবিড় নজর পড়ুক, তেমনি অন্য রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনও এ ভাবনায় আসুক বেশি বেশি করে উদ্বুদ্ধ হোক- এটাই প্রত্যাশা।

লেখকঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

আওয়ামী লীগের নতুন যুগের চ্যালেঞ্জঅজয় দাশগুপ্তবাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭২ বছর পূর্ণ  করলো। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এক কঠিন সময়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নাম নিয়ে দলটির আত্মপ্রকাশ। ৭২ বছরের ইতিহাসে দলটি সুসময় অতিক্রম করেছে, দুঃসময় পাড়ি দিয়েছে। দলটিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বলা যায়, চ্যালেঞ্জ জয়ে পারঙ্গম এ দলটি।আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সুবর্ণ মূহূর্ত নিঃসন্দেহে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর, যখন দলটির প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে সামনের সারিতে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব অংশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়, কিংবা স্বপ্ন বা কল্প জগতে বিচরণ করে নয়, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে। এই রায় আকস্মিকভাবে আসেনি। টানা প্রায় দুই যুগ তিনি স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত করেছেন। জাগরণের গান শুনিয়েছেন। তিনি নিঃসঙ্গ পথের পথিক ছিলেন না। এ ভূখণ্ডের আরও অনেক নেতা বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো কেউই লক্ষ্যে স্থির থাকেননি কিংবা থাকতে পারেননি। মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি জেল-জুলুম এমনকি ফাঁসির হুমকি সহ্য করে জনগণকে সচেতন করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন। একইসঙ্গে সংগঠন গুছিয়ে তুলেছেন। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেও এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, আদায় করেছেন তাদের সমর্থন। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে, এমন ধারণাও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তাঁর ছিল। ১৯৪৯ সালের ১৬-১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনে দাবি তুলেছিলেনÑ ‘এ ভূখণ্ডের ছাত্র-তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’ [বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৯-২৭০ ]১৯৭১ সালের ৭ মার্চ-এর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñ এই অবিনাশী উচ্চারণ যেমন আকস্মিক ছিল না, তেমনি ‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে’ বক্তব্যেও ছিল পরিকল্পনার ছাপ। স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধারণ করতে হবেÑ এ বিষয়ে প্রস্তুতি তাঁর ছিল। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার সময় তিনি নিশ্চিত ছিলেনÑ মুক্তির মন্দির সোপান তলে জীবন বলিদানের জন্য অগণিত ছাত্র-তরুণ প্রস্তুত। তিনি নিজেই ১৯৫২ সালের ১৪ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে লিখেছিলেনÑ ‘আই হ্যাভ বর্ন টু সাফার।’ পরবর্তী ১৮ বছরে তাঁর এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিল অনেক অনেক ছাত্র-তরুণ।  ৭২ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি সুবর্ণ মুহূর্ত নিঃসন্দেহে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের ঘোষণা। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভলপমেন্ট পলিসি ২০২১ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি থেকে শুরু হওয়া সভায় বলেছেÑ মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত নিরাপত্তাহীনতা অতিক্রমÑ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রধান পরামর্শদাতা এবং বিশ্বব্যাংকের কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলতে থাকেনÑ বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস এবং উন্নত দেশগুলোর ভিক্ষার দান ছাড়া দেশটি টিকে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের কিছু ‘জ্ঞানী ব্যক্তিও’ তাদের সুরে সুর মিলায়। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যের মোক্ষম জবাব প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনকেই বেছে নেন। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেনÑ ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ প্রদানের পর  ‘ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেউ কেউ বাংলাদেশকে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ইধংশবঃ ঈধংব বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ ইধংশবঃ ঈধংব নয়। দুইশ’ বছর ধরে বাংলাদেশকে লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যাঞ্চেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের।.... আজো বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।’ [পৃষ্ঠা ১৯০] বাংলাদেশের এই সম্ভাবনার ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁরই প্রেরণায় স্বল্পোন্নত দেশের অবমাননা থেকে মুক্ত হওয়ার অভিযানে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের অর্ধশত বছরের অভিযাত্রায় প্রায় তিন দশক এমন শক্তি ক্ষমতায় ছিল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিÑ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ যাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। পাকিস্তান আমলের মতোই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পরিচালনা ছিল তাদের ধ্যান-জ্ঞান। ক্ষমতায় থাকা কোন কোন শক্তি এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বই মানতে পারেনি। উন্নত বাংলাদেশ সম্ভবÑ এ বিশ্বাস ‘অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একটি মহল’ পোষণ করেননি। বিশ্বব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি উন্নত দেশের চোখ দিয়ে তারা বাংলাদেশকে দেখেছেÑ ‘পরনির্ভরতাই বাংলাদেশের ভবিতব্য’। এমন প্রেক্ষাপটেই বিশ্বব্যাংকের প্রবল আপত্তি ও নানা কূটকৌশল উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ পদক্ষেপে বিশ্ব দেখেছে এক নতুন বাংলাদেশকে।       আওয়ামী লীগের জন্ম  সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই বছর পূর্ণ হতে না হতেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বদানকারী দল মুসলিম লীগের প্রধান এম এ জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসেই ঢাকা সফরকালে ঘোষণা দিয়ে গেছেনÑ ‘উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা’। খাজা নাজিমুদ্দীন, নুরুল আমিনসহ পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতারা এ অবস্থান দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। কিন্তু পাকিস্তানের জাতির পিতার অবস্থান চ্যালেঞ্জ করেন প্রবীণ জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং তাঁর সঙ্গে একদল তরুণ নেতাÑ যাদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার দিন শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিুবেতনভুক কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর আন্দোলন সমর্থন করার অভিযোগ তাঁর ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়ে পাঠানো হয় কারাগার। ইতিহাসের কী বিচার! শেখ মুজিবুর রহমানকে বহিস্কারের ঠিক ২০ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর নেতৃত্বে পরিচালিত প্রবল ছাত্র-গণ আন্দোলন তাকে পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে বরণ করে নেয় বঙ্গবন্ধু হিসেবে। এর দু’ বছর যেতে না যেতেই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তাঁরই আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে ডাকসু ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ উত্তোলন করে লাল-সবুজ-সোনালী রংয়ের পতাকা, যা  দেড় মাস যেতে না যেতেই স্বীকৃতি পায় নবজাত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা হিসেবে।আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর যেতে না যেতেই ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূূচি ঘোষণা করেছিল, যার মধ্যে প্রধান ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা এবং স্বায়ত্তশাসন।পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নানা ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্ট সরকার কার্যকর হতে পারেনি। কিন্তু তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রাজপথের সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে কংগ্রেসসহ কয়েকটি দলের সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয়। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় আতাউর রহমান খানের ওপর। শেখ মুজিবুর রহমান একাধিক দফতরের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু শপথের দিনই ঘোষণা করেনÑ ‘মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির প্রবল চাপে পড়িয়াই আমি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলাম না। [ সূত্রÑ দৈনিক সংবাদ, ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬। সংবাদপত্র বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১১০]প্রদেশের ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় এক বছর আগে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে  অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলটি  অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, সকল ধর্মের অনুসারীদের জন্য দলের সদস্য ও নেতৃত্বপদ উন্মুক্ত করার ঘোষণা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ ভূখণ্ডের জনগণ প্রথম ধারণা পায় যে সরকার জনকল্যাণে কাজ করতে পারে। কিন্তু অলক্ষে বিপদ ঘনিয়ে আসেÑ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা-কর্মী নিয়ে ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এদের মধ্যে একদল ত্যাগী ও জনসম্পৃক্ত কর্মীও ছিলেন, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়ে যান। দলের বিভাজনের মুখে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালনে পূর্ণ সময় প্রদান করেন। ১৯৪৯ সালে দল প্রতিষ্ঠার পর তিনি দফায় দফায় জেলা ও মহকুমা সফরে গেছেন। হেঁটে বা সাইকেলে ও বাসে ঘুরেছেন একের পর এক জনপদ। মন্ত্রীত্ব ছাড়ার পর আরও বেশি করে সফর শুরু করেন। আওয়ামী লীগ প্রস্তুত হয়ে যায় ১৯৫৯ সালে নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনের জন্য। শাসকগোষ্ঠী বিপদ বুঝতে পেরে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে জারি করে সামরিক শাসন।এই সামরিক শাসনের নিষ্ঠুর নির্যাতন সহ্য করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু সামরিক শাসন জারির সময় গ্রেফতার হন। আবার সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণেও তাঁর স্থান হয় কারাগারে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দল এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রািট ফ্রন্ট নামে জোট গঠন করেন, যারা মূলত পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র আদায়ের দাবিতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসন, কৃষক-শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ ও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির দাবি সামনে আনতে চেয়েছেন। এ কারণেই আওয়ামী লীগের একটি অংশের প্রবল বিরোধিতার মুখেও তিনি ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর ঠিক দুই বছর পর তিনি পাকিস্তানের ক্ষমতার দুর্গ লাহোর নগরীতে ঐতিহাসিক ছয়-দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট্রের ২১  দফার ১৯ নম্বর দফায় স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও অর্থ রাখার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু এক যুগের অভিজ্ঞতা ও নতুন বাস্তবতায় তিনি কেন্দ্রের হাত থেকে অর্থ ও বৈদেশিক বাণিজ্য প্রদেশে নিয়ে আসার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তানের শাসকচক্র এবং রাজনীতি ও অর্থনীতির পণ্ডিতরা বুঝে যানÑ ছয় দফা বাস্তবায়ন হলে এমনকি শিথিল ফেডারেশন থাকারও সুযোগ নেই, এ ভূখণ্ড আত্মপ্রকাশ করবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এ পথেই অগ্রসর হয় এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর স্বল্পোন্নত দেশগুলোরও পেছনের সারিতে থাকা বাংলাদেশের পুনর্গঠন কাজ সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধু এটা পেরেছিলেন। বাস্কেট কেসের অপবাদ ঘুচিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছিল বাংলাদেশ। এ জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক শক্তির সমাবেশ ঘটাতে তিনি গঠন করেন বাকশাল বা বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠনের সময় যারা এ দলে যুক্ত হয়েছিল (যাদের একটি অংশ ১৯৫৭ সালে ন্যাপ গঠন করে) তাদেরও অনেককে ফিরিয়ে আনতে পারেন তিনি। কিন্তু প্রচণ্ড আঘাত আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। রাষ্ট্র ক্ষমতা জবরদখলকারীরা  মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকা আওয়ামী লীগের চার প্রধান নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে। শত শত নেতা-কর্মী নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে উল্টো পথে যাত্রা শুরু করে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে এবং বাংলাদেশ ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়াবে, ক’জনেই বা সে ভরসা করেছিল? শেখ হাসিনার কৃতিত্ব যে তিনি এটা সম্ভব করেছিলেন। কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে, এটা জেনে তিনি ধৈর্য্য ধারণ করেছিলেন। হঠকারিতার পথে পা বাড়াননি। আশির দশকে এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসন অবসানের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সামনের সারিতে চলে আসে। খালেদা জিয়ার বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল যখন গুলিস্তান চত্বরের ছোট পরিসরে কেন্দ্রীয় সমাবেশ করে, শেখ হাসিনা তখন বক্তব্য রাখেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের বিশাল চত্বরে। হরতাল-অবরোধ সফল করায় আওয়ামী লীগ কর্মীরাই বেশি সক্রিয়। এরপরও ১৯৯১ সালের ফেব্র“য়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধাধীন ৮ দলীয় জোট জয়ী হতে পারেনি। শেখ হাসিনা আরও পাঁচ বছর ধৈর্য্য ধরেন।  দলের ভিত প্রসারিত করেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির প্রহসনের নির্বাচন বাতিলের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাংলাদেশে প্রকৃত আপসহীন নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ বছরের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলকে জয়ী করেন তিনি। ২৩ জুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনি খোন্দকার মোশতাকের মন্ত্রি¿সভার কোনো সদস্যকে স্থান দেননি নিজের মন্ত্রিসভায়। পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে  তিনি বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করেন। একইসঙ্গে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালের প্রবল বন্যার পরও তিনি বাংলাদেশকে প্রথম বারের মতো খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারেন। প্রমত্ত যমুনায় নির্মাণ করেন বঙ্গবন্ধু সেতু। সে সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকঠামো প্রকল্প ছিল এটি। বিশ্বব্যাংক এ সেতুতে  রেল সংযোগ রাখতে চায়নি। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদের আপত্তি আমলে না নিয়েই সেতুতে রেললাইন স্থাপন করতে পারেন।২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উন্নত বিশ্বের সারিতে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। এভাবে তরুণ প্রজন্মের সাথে আওয়ামী লীগের নতুন বন্ধন সৃষ্টি হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন ছিল এ বন্ধনেরই পরিণতি। আওয়ামী লীগ টানা এক যুগের বেশি ক্ষমতায়। এ সময়ে অভাবনীয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান বাস্তবে রূপ নিয়েছে। করোনাকালের মহাবিপর্যয় সামাল দিতে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। বাংলাদেশ সমৃদ্ধ দেশ হয়ে উঠবে, এ নিয়ে এখন আর সংশয় নেই এমনকি উন্নত বিশ্বেও।উন্নত বিশ্বের সারিতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের সামনে। এ পথে রাজনৈতিক বাধা আছে। বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি প্রবলভাবেই সক্রিয় রয়েছে। ধর্মান্ধতার ওপর নির্ভর করে একটি মহল ক্ষমতায় যেতে চায়। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ আছে বুদ্ধিবৃত্তিক। দলীয় কাঠামো থেকে শুরু করে প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় নিরাপত্তা, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন বাড়িয়ে চলা, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক শাখার গণতন্ত্রায়নÑ কত কিছুতেই না দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে হবে। এ শক্তি নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের সমাজের পড়তে পড়তে। তাদের দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে আনা কিংবা প্রভাব বলয়ে সংগঠিত রাখার কাজ কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি পর্যায়ের মতোই ব্যাপক। ৭২ বছরের দলটির এ দিকে নিবিড় নজর পড়ুক, তেমনি অন্য রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনও এ ভাবনায় আসুক বেশি বেশি করে উদ্বুদ্ধ হোকÑ এটাই প্রত্যাশা।

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত