গণমাধ্যমবান্ধব বঙ্গবন্ধু

893

Published on আগস্ট 31, 2021
  • Details Image

হীরেন পন্ডিতঃ

বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সাল থেকেই ছিলেন বাঙালি জাতির প্রধান আকর্ষণ। বাঙালি জাতির মুক্তির ইতিহাস তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে ধীরে ধীরে বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা ও স্থপতি হয়ে উঠেছেন তাতে যোগাযোগ কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

১৯৪২ সালে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করার পর, যখন তরুণ শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান, তখন তিনি সরাসরি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতে জাতীয় পরিসরে রাজনীতি করা। সুতরাং, তিনি অবিভক্ত বাংলার কিংবদন্তী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলেন। তরুণ নেতা হিসেবে শেখ মুজিব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

এই সময় থেকে সংবাদপত্র অফিসে তার যাতায়াত শুরু হয়। কলকাতায় দৈনিক আজাদের কার্যালয়ে, সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন সময় পেলেই। বঙ্গবন্ধু তখন থেকেই মিডিয়ার বন্ধু ছিলেন। সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র অফিসের অবস্থান ছিল তার হৃদয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা অবিস্মরণীয় ছিল। মহান নেতা স্বাধীনতার সময় সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে আখ্যা দিয়েছিলেন সংগ্রামের প্রতিভূ হিসেবে।

ভাষা আন্দোলনে গণমাধ্যমের অবদান, ছয় দফা দাবি বাংলাদেশের জনগণের বেঁচে থাকার দাবি হিসেবে উপস্থাপনে গণমাধ্যমের অসামান্য অবদান।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই মিডিয়াতে অনেক বন্ধু ছিলেন। সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র অফিসের অবস্থান ছিল তার হৃদয়ের কাছাকাছি। সাংবাদিকদের মধ্যেও তার অনেক বন্ধু ছিল। তার অমর সৃষ্টি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মিডিয়া। এর প্রতি তার গভীর আগ্রহ ও বিশ্বাস পরবর্তীকালে বড় রকমের সহায়ক হয়।

বাংলাদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অসীম। এই মহান নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ‘গণমাধ্যম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, শুধু সংবাদমাধ্যম নয়। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। গণমাধ্যমের গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলার সময় বঙ্গবন্ধু তার স্মৃতিতে উল্লেখ করেন যে,“আমার বাবা বাড়িতে সংবাদপত্র রাখতেন; আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী এবং সওগাত।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১০) তারপর তিনি পূর্ব বাংলার গণমাধ্যমের রাজনীতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে কথা বলেন। তৎকালীন জনগণের কল্যাণে এই ধারার নেতৃবৃন্দ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ।

তরুণ মুজিব কলকাতায় তার জীবনে মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাই তাকে প্রায়ই মুসলিম লীগের প্রেস রিলিজ দিতে পত্রিকার অফিসে যেতে হতো। একপর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন যে, মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে সমর্থন করে। সুতরাং, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আর্থিক সহায়তায় তারা দৈনিক ইত্তেহাদ প্রকাশ করেন।

এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর আহমেদ। ম্যাগাজিনটি ওই সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আধুনিক ম্যাগাজিন হিসেবে সম্পূর্ণ নতুন রূপে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে পত্রিকাটি বাজারজাত করেন। তিনি পত্রিকার ব্যবস্থাপনায় একজন দায়িত্বশীল পরামর্শকও ছিলেন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও, কাগজটি কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংবাদপত্রের ঢাকা অফিসে কাজ করেন এবং পূর্ববঙ্গে এজেন্ট নিয়োগ করে এর ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার কলকাতা থেকে প্রকাশিত হওয়ায় পূর্ব বাংলায় এই পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। মওলানা ভাসানী সম্পাদক ছিলেন, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রকাশক ছিলেন তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পত্রিকার অর্থায়ন করতেন। দলীয় কর্মীদের সঙ্গে শেখ মুজিবও সমধুর সম্পর্ক থাকায় এই পত্রিকার বিক্রির ব্যবস্থা করেছিলেন।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের আগে ইত্তেফাক সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর হয়ে যায় এবং তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) সম্পাদক হন।

১৯৫৫ সালে পূর্ব বাংলায় ধারা ৯২ (ক) চালু করা হয়েছিল, রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা এবং তাদের কার্যালয় বন্ধ করা। দৈনিক ইত্তেফাকও তখন বন্ধ ছিল। কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তফাজ্জল হোসেন বলেছিলেন যে, তিনি আর কোনো কাগজপত্র বের করবেন না। চাকরি নিয়ে করাচি যাচ্ছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে অনুরোধ করেছিলেন- তুমি যাবে না। তুমি চলে গেলে কেউ ইত্তেফাক চালাতে পারবে না। তফাজ্জল হোসেন পরের দিন তাকে বার্তা পাঠান যে, তিনি করাচিতে যাচ্ছেন না।

তফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গভীর হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুরোধে সোহরাওয়ার্দী প্রথমে তাকে দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং তাকে পত্রিকাটির প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেন। ১৯৬৬ সালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, তখন দৈনিক ইত্তেফাক তার পক্ষে জনমত গড়ে তুলে পাকিস্তানি জেনারেলের ক্ষমতা ভেঙে দিতে সহায়তা করে।

১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় এ দেশের সংবাদপত্রগুলো সাহসী ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়য়ন্ত্র মামলার আদালত রিপোর্টিং, যা দেশদ্রোহিতার অভিযোগে শুরু হয়েছিল, দৈনিক পত্রিকায় তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। একদিকে ছাত্র গণ-আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি, অপরদিকে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিদিন মিছিল-সমাবেশ শুরু হয়। জেনারেল আইয়ুব সব দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন।

সেই সময়, সংবাদপত্রগুলো, তাদের সংবাদ, কলাম এবং সম্পাদকীয়তে, পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির শোষণ, নির্যাতন এবং বৈষম্যের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছিল। পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় দৈনিকগুলোও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তারা শেখ মুজিবের সব সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা, বিবৃতি, এবং বক্তৃতা প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ ছেপেছে। বলা হয়ে থাকে যে, সংবাদপত্র জনগণকে অনুপ্রাণিত ও জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিবের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে বাঙালি জাতির প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। সমগ্র জাতি এক হয়ে গেল। শেখ মুজিব দৈনিক পত্রিকায় অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন, তার নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্য ছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর, পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্দেশে সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর পাওয়ার জন্য তারা আবার আগের মতো সাহসী ভূমিকা পালন করে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে সংবাদপত্রগুলো ‘ঐ আসে মহামানব’ বলে বর্ণনা করে।

স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ শাসন করেন। সেই স্বল্প সময়ে তিনি ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেন।

বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম সাংবাদিকদের বাকস্বাধীনতা রক্ষা করেন। গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মিডিয়ার জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের জাতীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থাও করেছিলেন। এক কথায়, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাজনীতির কবি হলেন সেই চূড়ান্ত মুক্তি যার চেতনা অসীমভাবে প্রত্যাশার ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে।

লেখক: প্রান্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

সৌজন্যেঃ নিউজ বাংলা

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত