জাতিসংঘে শেখ হাসিনার প্রস্তাব: টেকসই উন্নয়নে সময়োপযোগী উচ্চারণ

1032

Published on অক্টোবর 5, 2021
  • Details Image

হীরেন পন্ডিতঃ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ রেখে যাওয়ার জন্য একটি ‘সার্বিক বৈশ্বিক’ উদ্যোগের মাধ্যমে এই বিশ্বের জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আশু সাহসী ও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা-বিষয়ক নেতৃবৃন্দের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এ আহ্বান জানান। বৈঠকে এ ব্যাপারে তিনি ছয়টি সুপারিশ পেশ করেছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করেন।

শেখ হাসিনা তার প্রস্তাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে প্যারিস-চুক্তির কঠোর প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল আদায়ের ওপরও জোর দেন। এ তহবিলের ৫০ শতাংশ বিশেষ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে অভিযোজন ও স্থিতিস্থাপকতার জন্য ব্যবহার করা হবে।

উন্নয়শীল দেশগুলোতে নতুন আর্থিক প্রক্রিয়া এবং সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লোকসান, ক্ষয়ক্ষতির সমস্যা এবং সেই সঙ্গে বড় আকারের জনসংখ্যার স্থানচ্যুতি মোকাবিলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মহামারি ও দুর্যোগের দ্বৈত বিপদ মোকাবিলায় বিশেষ করে জলবায়ু-সৃষ্ট দুর্যোগের বর্ধিত পৌনঃপুনিকতা আক্রান্ত সিভিএফ দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রয়োজন।

শেখ হাসিনা বলেছেন, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে তাদের অভিযোজন ও প্রশমন প্রচেষ্টায় সহায়তা করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব তুলে ধরে তিনি বলেছেন, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো বৈশ্বিক গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনে সবচেয়ে কম অবদান রাখে, কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক আইপিসিসি রিপোর্টের উল্লেখ করে বলেছেন, এটি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে। কেননা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে চলে গেলে তারা স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তার সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অভিযোজন ও স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পথিকৃৎ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সম্প্রতি, ইউএনএফসিসিসিতে বাংলাদেশ একটি উচ্চাভিলাষী ও হালনাগাদ এনডিসি জমা দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার সবুজ প্রবৃদ্ধি, স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ গ্রহণ করেছে। তিনি এটা স্পষ্ট করেন যে, সরকার জলবায়ু ঝুঁকি থেকে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা এবং তা থেকে জলবায়ু সমৃদ্ধির পথে যাত্রা করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) এবং ভি২০-এর চেয়ার হিসেবে তার সরকারের মূল লক্ষ্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ঢাকাস্থ জিসিএ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সর্বোত্তম অনুশীলন এবং অভিযোজন জ্ঞান শেয়ার করছে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে বিশ্বব্যাপী ‘টিকা বৈষম্য’ দূরীকরণসহ ৬টি বিষয় তুলে ধরেন। কোভিডের প্রেক্ষাপটে এ বছর সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য ছিল-কোভিড থেকে পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশার মাধ্যমে স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলা, টেকসইভাবে পুনর্গঠন করা, গ্রহের চাহিদার প্রতি সাড়া দেয়া, মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং জাতিসংঘকে পুনরুজ্জীবিত করা। এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশনে বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের সভাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে।

প্রথমত, এবারের অধিবেশনের একটি বড় অংশজুড়ে ছিল কোভিড মোকাবিলা এবং পরবর্তী টেকসই পুনরুদ্ধার ও পুনঃনির্মাণ কোভিডহতে মুক্তিলাভের জন্য। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রতিক্রিয়া এবং পুনরুদ্ধার কোভিড পরবর্তী টেকসই পুনরুদ্ধারের অন্যতম শর্ত তাই সাধারণ অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়েছে।

বিশ্ব যাতে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা পেতে পারে সে বিষয়েও এবারের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্ব নেতারা আলোচনা করেন। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে জলবায়ু বিষয়ে ভূমিকা পালনকারী দেশগুলোকে নিয়ে একটি সভা আয়োজন করা হয়েছে।

তৃতীয়ত, কোভিডের কারণে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে যে অগ্রযাত্রা- তা অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠে সম্মিলিতভাবে টেকসই বিনির্মাণের বিষয়ে বিশ্বনেতারা আলোচনা করেন। এসডিজির প্রতিটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে করোনা পরবর্তী পুনরুদ্ধারের বিষয়টি তাই এ অধিবেশনে প্রাধান্য পায়।

চতুর্থত, এবারের সাধারণ অধিবেশনে ইউএন ফুড সিস্টেমস সামিট শীর্ষক একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার মূল লক্ষ্য ছিল টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অন্তর্ভুক্ত-ক্ষুধা, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার আন্তঃসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে, উক্ত উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ অর্জন ত্বরান্বিত করা।

পঞ্চমত, করোনার সময়ে আমরা লক্ষ করছি যে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অসহিষ্ণুতা, বৈষম্য-বিভেদ ইত্যাদি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের বিভেদ নিয়ে কখনোই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়টিও এবারের অধিবেশনে আলোচনায় এসেছে। বর্ণ বৈষম্য ও জাতিগত বিভেদ ভুলে সমতার ভিত্তিতে টেকসই পুনরুদ্ধারের বিষয়টি এ উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রাধান্য পেয়েছে।

ষষ্ঠত, প্রতিবারের মতো এবারও নিরস্ত্রীকরণ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সংকট : একটি টেকসই সমাধানের বাধ্যবাধকতা’ শীর্ষক একটি উচ্চপর্যায়ের সাইড ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ছাড়াও গাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ওআইসি অনুষ্ঠানটির সহ-আয়োজক ছিল। ইউএন ফুড সিস্টেমস সামিট শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খাদ্য খাতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী উক্ত সভায় অংশগ্রহণ করে, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন, টেকসই উৎপাদন, খাদ্য বিতরণ এবং সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অংশীজনদের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারত্ব গড়ে তোলার ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃত্বকে আহবান জানান।

একটি শান্তিপূর্ণ ও মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টা, অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, শান্তিরক্ষা কার্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাফল্য আজ সর্বজনবিদিত। এর ধারাবাহিকতায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণ বহুপাক্ষিক ফোরামে বাংলাদেশের দৃপ্ত পদচারণাকে আরও সমুন্নত করেছে।

প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন- ‘যেহেতু আমরা ইতোমধ্যে ডেলিভারি এবং অ্যাকশন অফ এজেন্ডায় প্রবেশ করেছি, তবুও লক্ষ্যগুলো অনেক দূরে বলে মনে হচ্ছে। কোভিড মহামারির আগেও, অনেক দেশ তাদের এসডিজি অর্জনের জন্য ট্র্যাকের বাইরে ছিল। মহামারিটি ঠেলে দিয়েছে তাদের আরও পিছনে, ঠেলে দিয়েছে বলে তিনি মতামত দিলেন। কোভিড মহামারি বিশ্বকে বিচলিত করেছে।

এটি অগণিত জীবন নিয়েছে এবং জীবিকা বিপর্যস্ত করেছে। বিশ্বব্যাপী আমাদের উন্নয়ন লাভ এবং এসডিজির অগ্রগতি খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন, আমরা সবুজ বৃদ্ধি, স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো এবং শক্তিকে কেন্দ্র করে ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ গ্রহণ করেছি। প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে এবং জিডিপির দিক থেকে ৪১তম স্থানে রয়েছে। আমাদের ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী উন্নত দেশগুলোর কাছে করোনার টিকা ও জলবায়ুর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ঠেকানোর জন্য যে প্রযুক্তির প্রয়োজন তা বিশ্বময় বিতরণ করার প্রস্তাব তুলে ধরেন। এই প্রত্যাশার কথাটিই স্মরণ করিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে মানবজাতি সভ্যতার উৎকর্ষের কারণে যা কিছু অর্জন করেছে, বৈষম্যহীনভাবে তার ভাগীদার সমগ্র মানবসমাজ।

বিশ্বসম্পদ বিতরণে, বিশেষ করে করোনার টিকার বিশ্বময় বিতরণের ব্যাপারে বৈষম্যমূলক আচরণকে, কুক্ষিগত করার প্রবণতাকে তিনি কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেন। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম তার ভাষণকে অনন্য বলে আখ্যায়িত করেছে, তার দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও মানবপ্রেমী মনোভাবের প্রশংসা করেছে।

মহামারির কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থার সংকট ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশের পথে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বলে তিনি দাবি করেন, এর থেকে পরিত্রাণের জন্য উন্নত দেশগুলোকেই গুরুদায়িত্ব নিতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

সৌজন্যেঃ নিউজবাংলা২৪

(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত