৭ মার্চের ভাষণ ‘বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ’

934

Published on মার্চ 10, 2023
  • Details Image

ড. জেবউননেছা:

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা এবং ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের সাক্ষী এ দেশের জনগণ। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার লিপ্সার প্রতিবাদে বাংলার মানুষকে করে তুলেছিল অদম্য সাহসী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠিত হয় মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানিরা টানা নয়মাস হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন করে দখলে নিতে চায় আমাদের ভূখণ্ড। কিন্তু তা আর হয় না। কী করে হবে? এই দেশে জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক নেতা, যার আহবানে লাখো লাখো মানুষ জমায়েত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। তার পূর্বেই তিনি নিজ যোগ্যতায় ভূষিত হয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। বঙ্গবন্ধুর প্রথম জীবনী লেখক কাজী কামাল আহমেদ তার গ্রন্থে লিখেছেন, “শেখ মুজিব আত্মবিশ্বাসহীন এবং বঞ্চিত জনগণের পূর্ব বাংলাকে এক নতুন আশা এবং লক্ষ্যের দেশে পরিণত করেছেন। তিনি নীরব দুর্দশামাখা কন্ঠগুলোকে, উদ্বিগ্ন কন্ঠগুলোকে ভাষা দিয়েছেন; যে কন্ঠ ছিল অশ্রুতপূর্ব।” তাই কানে ভাসে, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।

১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দুদিন পূর্বে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা না করেই স্থগিত ঘোষণা করে। প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর আহবানে ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন চলে। ওই দিন বিকেলেই বঙ্গবন্ধু পূর্বাণী হোটেলে একটি সংবাদ সম্মেলনে আয়োজন করেন এবং ২ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দেন। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে পল্টনের জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। আসে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ, ২২ ফাগুন, ৯ মহররম, রবিবার । এ প্রসঙ্গে কবি ও নাট্যকার , ১৯৭১ এর কলম সৈনিক মু. জালাল উদ্দিন নলুয়া, তার দিনলিপিতে লেখেন- “আ-মরি বাংলা ভাষা। বায়ান্নর রক্তদানের ফলে মাতৃভাষা স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একাত্তরের রক্তদানে। আজ বেতার টেলিভিশনে অনুষ্ঠান ঘোষণায় ও বর্ণনায় বাংলা স্বতঃস্ফূর্ত রূপ লাভ করেছে। ফৌজি অনুষ্ঠানে উর্দুর পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলা। হোটেল, রেঁস্তোরা, সড়ক সর্বত্র বাংলা প্রচারের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের দর্শকরা ঝুঁকে পড়ছে বাংলা ছবির দিকে। এ সমস্ত দেখে- পার্শ্বস্থ ছেলে বুড়োর কথা শুনে বুক ফুলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে- জয় বাংলার জয়।” অতঃপর ৮ মার্চ, ১৯৭১-এ তিনি লেখেন, “গতকাল রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু’। ভাষণ ঢাকা থেকে রীলে করার কথা ছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ তা হতে দেয়নি। তাই বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঢাকা বেতারের ৩য় অধিবেশন বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর আজ ৮-৩০ মি. ভাষণ পুনঃপ্রচারিত হয়। বেতারে বঙ্গবন্ধুর দলীয় বার্তা প্রচার করার জন্য সকাল ৮-৫৫ মি. ও দুপুর ১-০০ মি. স্পেশাল বুলেটিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা বঙ্গবন্ধুর বশে। আর পূর্ব বাংলার প্রতিটি লোক চলছে গণতন্ত্রের পতাকাবাহী বঙ্গবন্ধুর আদেশে। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছেন ২৫শে মার্চ পর্যন্ত কোর্ট-কাচারী-অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। তা খোলা হবে নিম্নোক্ত শর্তে-

১. সৈন্য বাহিনী ব্যারাকে নাও।

২. সামরিক আইন প্রত্যাহার কর।

৩. নির্বিচারে গুলি করে যাদের হত্যা করা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ ও তদন্ত।

৪. সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।”

দিনলিপির এই দুটি পাতা থেকে সহজে অনুমেয়, আপামর জনসাধারণ কীভাবে চেয়েছেন একটি দেশ হোক, একটি মানচিত্র হোক এবং আমাদের স্বাধীনতা হোক। এই কাঙ্খিত স্বাধীনতার জন্য যিনি দেবদূত হয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরামহীন সংগ্রামে যিনি ছিলেন অকুতোভয়।

৭ মার্চ, ১৯৭১-এর সকালে বঙ্গবন্ধু শরীরে জ্বর অনুভব করেন। কিন্তু এই কিংবদন্তী, ইস্পাতদেহীকে জ্বর কেন কোনো কিছুতেই কাবু করতে পারে না। বক্তব্যের পূর্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি টানা ৩৬ ঘন্টার এক বৈঠকে মিলিত হলেও কোনো স্থির সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু কি বলবেন, সেই দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। তবে এই সময়ে তাকে ভরসা দেন তার ছায়াসঙ্গী, যিনি ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলায় প্যারোলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিরোধিতা করে অন্যরূপ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যে কারণে আইয়ুব সরকার মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু ও মামলায় অন্যান্য বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি হলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “..সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, সবার ভাগ্য আজ তোমার উপর নির্ভর করছে… অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে, তুমি নিজে ভেবে যা বলতে চাও নিজের থেকে করবে। তুমি যা বলবে সেটিই ঠিক হবে।” বঙ্গবন্ধু ঠিক তাই করেছিলেন।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দিদের একজন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে গগনবিদারী কন্ঠে ১৮ মিনিট বক্তব্য প্রদান করেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। আর এই ঘোষণার পূর্বে গণমাধ্যমে নানা রকমের শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য The Daily Telegraph পত্রিকার প্রতিনিধি David Loshak ঢাকা থেকে ‘E Pakistan UDI ( Unilateral Declaration of Independence) Expected’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন, যেটি ৬ মার্চ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, “Sheikh Mujibur Rahmam is expected to declare independence tomorrow.” The Sunday Times পত্রিকার ৭ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত করাচী থেকে পত্রিকার প্রতিনিধি Peter Hazel Hurst প্রেরিত “East Pakistan leader could declare UDI” প্রতিবেদনে দুই ধরনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। মুজিব একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন অথবা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে উভয় অংশের প্রতিনিধিদের যোগদানের আহবান জানাবেন।

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F. Field ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে “We Shall Fight on the Beaches : The Speeches That Inspired History” শিরোনামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন, যেখানে ৪১ জন সামারক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়। উক্ত গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। The Daily Telegraph পত্রিকার প্রতিনিধি David Loshak ঢাকা থেকে প্রেরিত ‘The end of the old Pakistan’ শিরোনামযুক্ত এক প্রতিবেদনে বলেন, ‘On Sunday (March, 71) Sheikh Mujib came as near to deaclaring this (independence) as he could without inviting immediate harsh reaction from the Army.”

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কাব্যিকতা, শব্দশৈলী, বাক্যবিনাসে ভরপুর। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় পোয়েট অফ পলিটিক্স’। জুলিয়াস সিজার, উইনস্টন চার্চিল, চার্লস দ্য গল, মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকন, অলিভার ক্রমওয়েলের বিখ্যাত সব ভাষণে একইরকম বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণটি ইতিহাসখ্যাত, ভাষণটি ছিল আকারে নাতিদীর্ঘ। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস-এর শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ছিল ৩ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সময় ১৮ মিনিট, শব্দ ১১০৫। অপরদিকে মার্টিন লুথার কিং এর ‘I have a dream’ বক্তব্যের সময় ১৭ মিনিট, শব্দ ১৬৬৭। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মহাকাব্যিক। এই মহাকাব্যের নান্দনিক সৌন্দর্য এবং শব্দের প্রাচুর্য এখনো জনগণকে অনুরণিত করে। যতবারই ভাষণটি কানে আসে, মনে হয় নতুন শুনছি। সেই শৈশব থেকে শুনে আসছি, তাও যেন বারে বারে শুনতে ইচ্ছে করে। একটি বক্তব্য কতটা আবেগময় হতে পারে, হতে পারে মর্মস্পর্শী। তা ৭ মার্চের ভাষণই বলে দেয়।

২০০৯ সালের ১২ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন (বিএনসিইউ) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে ‘ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাবনা ইউনেসকোতে প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে ৭ মার্চের ভাষণটি ইউনেসকোর অপর একটি অনুষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রার’ এ অন্তর্ভুক্তির জন্য অধিকতর উপযোগী বলে প্রতীয়মান হয়। অতঃপর ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি কোরিয়ান ইউনেসকো জাতীয় কমিশন বিএনসিইউ-কে পত্র মারফত ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিত মেমোরি অফ ওয়ার্ল্ড সম্পর্কিত কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ১১-১৪ মার্চ, ২০১১ তারিখে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় বিএনসিইউ ৭ মার্চের ভাষণের ওপর প্রস্তুতকৃত খসড়া প্রস্তাব প্রেরণ করে। ২০১৩ সালে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে অনুষ্ঠিত হয় পরবর্তী কর্মশালা। ২০১৬ সালের ৪-১৫ এপ্রিল প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ১৯৯তম নিবার্হী বোর্ড সভা চলাকালে তৎকালীন শিক্ষা সচিব এবং শিক্ষামন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে পরিমার্জিত প্রস্তাবনাটি ইউনেসকোতে জমাদানের লক্ষ্যে প্যারিসস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেরণ করে। অতঃপর নানা প্রক্রিয়া শেষে ভাষণটি ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো কর্তৃক ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অফ ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রার’-এ বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে গৃহীত হয়। ভাষণটি বর্তমানে তফসিল আকারে বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত (পঞ্চদশ সংশোধনী) হয়েছে।

৭ মার্চের ভাষণেই রোপিত হয়েছে স্বাধীনতার বীজ। ওই ভাষণের প্রেক্ষিতে রচিত হয়েছে নানা কবিতা এবং প্রবন্ধ। তবে সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে যায় নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কি করে আমাদের হলো’ শিরোনামের কবিতাটি। কবিতার শেষ স্তবকটি ছিল এরকম–

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,

রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে

অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,

হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার

সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷’

হ্যাঁ কবির সাথে আমিও একমত। সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের এই দিনে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি যার স্বতঃস্ফূর্ত আহবানে আপামর জনগণ হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছে ‘বাংলাদেশ’।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ বিডিনিউজ২৪.কম

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত