২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলা চালানো নাশকতাকারী জঙ্গি নেতাদের রাজনৈতিক পরিচয়

547

Published on আগস্ট 17, 2023
  • Details Image

বাংলাদেশে নাশকতাকারী সংগঠন বলতে প্রথমেই সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জেএমবি, হরকত উল জিহাদ, বাংলা ভাই- এদের বর্বরতার দৃশ্য। তাহলে আসুন একবার এসব জঙ্গিবাদী সংগঠনেরর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক সংযোগ ও ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জেনে আসি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গোয়েন্দাদের তদন্ত ও সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে দেখা গেছে, জেএমবি নামক নিষিদ্ধ সংগঠনটির নেতাদের পরিবার মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকারের ভূমিকা পালন করেছে, পরবর্তীতে জামায়াত-শিবেরের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। পরবর্তীতে বিএনপির সহায়তায় আওয়ামী লীগ নিধনের কৌশল বাস্তবায়নের জন্য তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে অনেকগুলো জঙ্গি সংগঠন গঠন করে। সেগুলোর মধ্যে জেএমবি, হরকত-উল-জিহাদ, বাংলা ভাই সর্বাপেক্ষা বেশি হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়।

২০০৬ সালের ৩০ এপ্রিলের জনকণ্ঠের সংবাদ থেকে জেএমবি নেতাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়, জেএমবির শুরা সদস্যের সাত জনের সবারই ধর্মীয় রাজনীতির হাতেখড়ি শিবিরের মাধ্যমে। জঙ্গি সংগঠন জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের বাবা ছিল ১৯৭১-এ জামালপুরের আল বদর কমান্ডার, তার নাম আবুল ফজল। শায়খ আবদুর রহমান নিজেও শিবিরের অগ্রগামী সংগঠন ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। পারিবারিকবাবে তার সঙ্গে জামায়াতের সব শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

ছাত্র শিবিরের সাবেক নেতা শায়খ আবদুর রহমানের ছোটভাই আতাউর রহমান সানি মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় ছিল শিবিরের সাথী, পরে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিবিরের অন্যতম প্রধান সাংগঠনিক নেতা হয়। ২০০০ সালে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকে। পরবর্তীতে জেএমবির সামরিক শাখার দায়িত্ব নেয় এবং সারাদেশের শিবিরের সঙ্গে জেএমবির নেটওয়ার্কিংয়ের কাজটি করতো সে।

জেএমবির আরেক অপারেশনাল কমান্ডার বাংলা ভাইয়ের আসল নাম সিদ্দিকুর রহমান। বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার মহিষবাহান ইউনিয়নের কর্ণিপাড়া গ্রামের নাজির হোসেনের ছেলে সে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানিদের সহায়তার জন্য তার পরিবার এলাকার স্বীকৃত রাজাকার পরিবার হিসেবে পরিচিত। ১৭ আগস্ট বোমা হামলার অন্যতম কুশীলক এই সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই বগুড়ার আযিযুল হক কলেজে শিবিরের একজন প্রভাবশালী নেতা ছিল। শহরের শিবির নিয়ন্ত্রিত রেটিনা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করতো সে। পরে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর পরামর্শে জেএমবিতে যোগ দেয়। বগুড়ার প্রভাবশালী শিবির নেতা হওয়ার সুবাদে তারেক রহমানের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে বাংলা ভাইয়ের। ফলে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জেএমবির সার্বিক যোগাযোর কাজটাও করতো সে।

একারণে বাংলা ভাইয়ের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিত ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও নিজামী তা অস্বীকার করে বলেছিল- বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি! এমনকি ২০০২ সালের ১৭ আগস্ট বাগেরহাটে আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যাচেষ্টাকালে গ্রামবাসীরা বাংলা ভাইকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও, তারেক রহমানের হুকুমে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শহরের চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে জেএমবি। ২০০৩ সালের ১৪ অগস্ট জয়পুরহাট থেকে বাংলা ভাইসহ কয়েকজন জেএমবি সদস্যকে অস্ত্রসহ আটক করা হলেও, হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটের সুপারিশে আবারো ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।

শুধু তাই নয়, ২০০৫ সালে বাংলা ভাইয়ের সহযোগী ও জেএমবি নেতা খামারু আটক হওয়ার পর, বাংলা ভাইয়ের সুপারিশে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের মাধ্যমে তার মুক্তির ব্যবস্থা করে দেয় তারেক রহমান।

জেএমবির শুরা সদস্য নুরুল হুদা আবেদও ছিল একজন প্রভাবশালী শিবির নেতা। পরবর্তীতে শায়খ আবদুর রহমানের সঙ্গে জোট বেধে জেএমবি গঠন করে সে।

২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের পত্রিকায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাকারী, রমনা বটমূল, উদীচী ও সারাদেশে বোমা হামলার অন্যতম হোতা মুফতি হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। তার ভাই মতিয়ার রহমান মতি কোটালিপাড়া থানা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা। বিএনপি নেতা ভাইয়ের মাধ্যমে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার নির্দেশনা গ্রহণ এবং কোনো অপারেশন শেষ করার পর তাদের কাছে রিপোর্ট পেশ করতো মুফতি হান্নান।

জেএমবির মজলিসে শুরার সদস্য হাফেজ মাহমুদ ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার ঘটনায় আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে জেতাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল জেএমবির ক্যাডাররা। বিএনপির পক্ষ থেকেও ক্যাডারভিত্তিক সাহায্য চাওয়া হয়েছিল তাদের কাছে। বিনিময়ে ক্ষমতায় গেলে তাদেরকে অনেক সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল হাওয়া ভবন থেকে।

২০০৫ সালের ২৩ আগস্টের পত্রিকায় গোয়েন্দাদের বরাতে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের সময়টাতে কমপক্ষে ১৪টি ভিন্নধারার উগ্রবাদী সংগঠনের ছদ্মবেশে দেশে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে জামায়াত-বিএনপি। জামায়াত-বিএনপির শক্তিতে ভর করেই দেশজুড়ে সশস্ত্র তৎপরতা চালায় জঙ্গিরা।

২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের খবর থেকে জানা যায়, বগুড়ায় বাংলা ভাইয়ের বাড়িকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি নেটওয়ার্ক পরিচালিত হয়। বিশেষ করে গাবতলীর কয়েকটি গ্রাম, একটি হাটের পাথার ও প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে এসব জঙ্গিদের ট্রেনিং, বোমা বানানোর স্কোয়াড, মহিলা ক্যাডার তৈরির মূল কার্যক্রম চালানো হতো। গাবতলীর গোলাবাড়ি থেকে গ্রেফতার জঙ্গি ক্যাডার রাজ্জাক ওরফে হাসান এসব তথ্য জানায়। রাজ্জাক জানায়, ১৭ আগস্ট বগুড়ার বোমা হামলার ঘটনায় সেসহ আরো কয়েকজন জঙ্গি রিকশা চালকের ছদ্মবেশে অংশ নিয়েছিল।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত