আক্কেলপুরে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ জনগণ হত্যাঃ লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির

3431

Published on মার্চ 22, 2018
  • Details Image

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে। গণহত্যা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পরবর্তী নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা আরো বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আফসোসের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত রয়ে গেছে। অরক্ষিত উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো নিয়ে এই ধারাবাহিক রচনা।

জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণে ও ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আক্কেলপুর সীমান্তবর্তী গ্রাম। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ ছিল অধিক। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা জয়পুরহাটের গ্রামে গ্রামে প্রবেশ করে নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। আক্কেলপুরে তারা এক দিনেই ২০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় অপর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদের কারণে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে স্বল্প প্রশিক্ষণ প্রদান করে মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ, এমনকি মাত্র কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে অপারেশন পরিচালনার জন্য দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হতো। আবার অনেক সময় খুব গোপনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্যও মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হতো।

১৯৭১ সালের ১৫ জুন, মঙ্গলবার। প্রশিক্ষণ শেষে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাদের জয়পুরহাট সীমান্ত থেকে বগুড়া পর্যন্ত এলাকায় ভবিষ্যতে অপারেশন পরিচালনার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের অবস্থান ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রেরণ করা হয়। কেবল পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের প্রেরণ করা হয়েছিল বলে আত্মরক্ষার জন্য প্রত্যেককে মাত্র দুটি করে হ্যান্ড গ্রেনেড প্রদান করা হয়। সারা রাত হেঁটে ভোর ৪টার দিকে তারা জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর থানার রোয়াইর গ্রামের মাঠের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। ঠিক তখনই এলাকার কয়েকজন রাজাকার তাদের দেখে ফেলে এবং চিৎকার করে আরো বেশ কিছু সশস্ত্র রাজাকারকে সেখানে জড়ো করে। তারপর তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধাওয়া করে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা আত্মরক্ষার জন্য রাজাকারদের দিকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকেন। কিন্তু জমিতে কাদা পানি থাকায় অথবা অন্য কোনো ত্রুটির কারণে গ্রেনেডগুলো বিস্ফোরিত না হওয়ায় রাজাকাররা ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দি করে আক্কেলপুর পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে সোপর্দ করে। সেখানে নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করা হয়। বাকি ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে পার্শ্ববর্তী কানুপুর গ্রামে আত্মগোপন করেন। জীবনের মায়া ত্যাগ করে গ্রামের কয়েকজন নারী আশ্রয় গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করেন। কিন্তু গ্রামে অবস্থানরত কয়েকজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানতে পেরে তাদেরও বন্দি করে পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে হস্তান্তর করে। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা অমানুষিক নির্যাতন করে তাদেরও হত্যার পর লাশগুলো মাটিচাপা দিয়ে রাখে।

আক্কেলপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় স্থাপিত পাকিস্তানি সেনাছাউনির অধিনায়ক ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির অফিসার মেজর আফজাল। মাদ্রাসার বিভিন্ন কক্ষকে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে সে ব্যবহার করত। বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ জনগণকে ও মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে অনেককে ধরে এনে এখানে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেও অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে আশপাশে মাটিচাপা দিয়ে রাখত তারা। বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের মাদ্রাসার নির্যাতন কেন্দ্রে রাজাকারদের সহায়তায় খেজুরের কাঁটার আঘাতে ও বেয়নেট চার্জ করে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের সময় মুক্তিযোদ্ধারা পানি পান করতে চাইলে তাদের পানির পরিবর্তে বলপূর্বক প্রস্রাব ও গরুর গোবর খাওয়ানো হয়।

তাছাড়া ১৬ জুন বগুড়ার মোজাম পাইকারের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোহাম্মদ খোকন পাইকারকে ধরে আক্কেলপুরের সেনাছাউনিতে এনে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। মুক্তিযোদ্ধা খোকন পাইকার ভালো উর্দু বলতে পারতেন। তিনি উর্দুতে পাকিস্তানি সৈন্যদের অনুরোধ করলেন যেন তাকে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। জানা যায় যে, নামাজ পড়ার সুযোগ দিলেও নামাজরত অবস্থায় তাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়।

আক্কেলপুরের পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধাসহ নিরীহ এলাকাবাসীদের হত্যার পর আশপাশের এলাকায় মাটিচাপা দেয়া হয়। এমন কয়েকটি স্থানের বিবরণ নি¤œরূপ-

১. আক্কেলপুর সিনিয়র মাদ্রাসা-সংলগ্ন রাস্তার পশ্চিম পাশের একটি গর্তে মুক্তিযোদ্ধা খোকন পাইকারের মৃতদেহ মাটিচাপা দেয়া হয়।

২. মুক্তিযোদ্ধা খোকন পাইকারের কবরের ১০০ গজ দূরে রাস্তার পূর্ব পাশের একটি গণকবরে প্রদীপ, সাধু, সুনীল ও নাম না জানা বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ মাটিচাপা দেয়া হয়।

৩. মহিলা কলেজের পশ্চিম পাশের মাঠে একটি গর্ত করে আবের জোয়ারদার, মোখলেস জোয়ারদার, নবীর উদ্দিন, নজির প্রামাণিক, নসির প্রামাণিক, তাসের প্রামাণিক, ডা. বুল চান ও তোফাজ্জল হোসেনের মৃতদেহ মাটিচাপা দেয়া হয়। উল্লেখ্য, তারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে গমনকালীন পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ধরে এনে হত্যার পর মাটিচাপা দিয়ে রাখে। তাছাড়াও নাম না জানা আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও ৬ জন গাড়োয়ানকেও হত্যা করে এখানে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

১৯৭১ সালের জুন মাসে মুক্তিযোদ্ধা খোকন পাইকার, প্রদীপ, সাধু, সুনীলসহ ২১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন এলাকার অধিবাসী হওয়ায় অন্যদের নাম জানা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে গমনের সময় যেসব নিরীহ মানুষকে ধরে এনে আক্কেলপুরের পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয় তাদের মধ্যে যে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন-

শহীদ আবের জোয়ারদার, শহীদ মোখলেস জোয়ারদার, শহীদ নবীর উদ্দিন, শহীদ নজির প্রামাণিক, শহীদ নসির প্রামাণিক, শহীদ তাসের প্রামাণিক, শহীদ ডা. বুল চান, শহীদ তোফাজ্জল হোসেন যেসব রাজাকার জুন মাসে আক্কেলপুরে অবস্থানকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দি করে পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে হস্তান্তর করেছিল পরবর্তী সময়ে সেপ্টেম্বর মাসের দিকে মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়ক কাজী ফরমুজুল হকের নেতৃত্বে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের আক্রমণ করে ৭ জনকে হত্যা করেন। তারপর তাদের মৃতদেহ নওগাঁ জেলার আজলামপুর গ্রামের রানি পুকুর পাড়ে মাটিচাপা দেয়া হয়।

আক্কেলপুরে জুন মাসে সংঘটিত বিভিন্ন গণহত্যায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর গণকবরের স্থানে এখন পর্যন্ত কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। গণকবরগুলো সংরক্ষণসহ এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

লেখকঃ বীরপ্রতীক, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত

সৌজন্যেঃ দৈনিক ভোরের কাগজ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত