পেরুয়া গ্রামে গণহত্যাঃ লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির

3178

Published on মার্চ 28, 2018
  • Details Image

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে। গণহত্যা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পরবর্তী নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা আরো বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আফসোসের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত রয়ে গেছে। অরক্ষিত উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো নিয়ে এই ধারাবাহিক রচনা।

সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৫৪ কিলোমিটার দূরে সুরমা নদীর পশ্চিম পাড়ে দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নে অবস্থিত হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রাম পেরুয়া। নদীর অপর পাড়ে শ্যামারচর বাজার ও দক্ষিণ কোণে উজানগাঁও, যে এলাকাকে আবার গ্রামের একটি পাড়ার লোকজন দৌলতপুর বলেও ডাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশেষ করে ময়মনসিংহ থেকে অনেক মুসলমান এসে এই এলাকার বিভিন্ন গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলে, যাদের স্থানীয়রা সেটেলার মুসলিম হিসেবে সম্বোধন করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন এলাকার সেটেলার মুসলিমদের নিয়ে শাল্লা থানার উজানগাঁওয়ের খালেক মিয়া (১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পিডিপি থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছে হেরে যায়) ও শাল্লা থানার বাহারা ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান শরাফত মিয়া গড়ে তোলে বিশাল এক রাজাকার বাহিনী। তারা সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ আর নারী নির্যাতন করত।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সুনামগঞ্জ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর রাজাকার অধিনায়ক খালেক মিয়া তার বাহিনী নিয়ে নিজ (দৌলতপুর তথা উজানগাঁও) গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে। ৬ ডিসেম্বর ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়ক সুধীর কুমার দাসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণে অধিনায়ক সুধীর কুমার দাস ও জওহরলাল দাসসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হওয়ার পর তারা পশ্চাৎপসরণ করেন। আর তখনই রাজাকাররা নদী অতিক্রম করে পেরুয়া ও আশপাশের গ্রামে আক্রমণ করে। তারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে থাকে এবং বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। সেইসঙ্গে তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে কিশোরী আর তরুণীদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং লুট করে নিয়ে যায় নিরীহ গ্রামবাসীর টাকা-পয়সা, সোনাদানা।

অবস্থার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে গ্রামের আতঙ্কিত নারী-পুরুষ তাদের নাবালক সন্তানসহ প্রাণভয়ে দৌড়ে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে এলংজুড়ি গ্রামের পাশে গাছপালায় ঘেরা এক জায়গায় আশ্রয় নেন। কিন্তু রাজাকাররা সেখানেও উপস্থিত হয়ে সবাইকে ধরে রামচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো করে এবং নারী ও পুরুষদের দুই ভাগে বিভক্ত করে। তারপর পুরুষদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায় তারা। নির্যাতন শেষে পুরুষদের নদীর ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর নারীদের তারা বলে- ‘তোমাদের কোনো ভয় নেই, তোমাদের নিরাপদ আশ্রয়ে প্রেরণ করা হবে।’ এমন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে তাদের আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। তা ছাড়াও অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে কলেমা পড়িয়ে মুসলমান হতে বাধ্য করা হয়। বয়স কম হওয়ায় সেদিন রাজাকারদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন হীরেন্দ্র শেখর রায় চৌধুরী, শৈলেন কুমার রায়, মদন ও পাণ্ডব। সেদিন শৈলেন কুমার রায়ের পরিবারের ৬ জনকে হত্যা করা হয়।

উজানগাঁও থেকে রাজাকার বাহিনী পেরুয়া গ্রামে আসার পথে নদী পারাপারের জন্য পেরুয়া গ্রামের দিনমজুর ব্রজেন্দ্র দাসকে বাধ্য করে। নদী পার হওয়ার পর রাজাকাররা ব্রজেন্দ্র দাসকে গুলি করে। পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে ব্রজেন্দ্র দাস নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনোক্রমে সাঁতার কেটে তীরে উঠে নদী তীরবর্তী পেরুয়া গ্রামের গুঞ্জর আলীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। গুঞ্জর আলী কাপড় দিয়ে বেঁধে ব্রজেন্দ্র দাসের রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করেন। ইতোমধ্যে রাজাকাররা ব্রজেন্দ্র দাসের খোঁজে গুঞ্জর আলীর বাড়িতে প্রবেশ করলে ব্রজেন্দ্র দাস পালিয়ে যান। রাজাকাররা সেই বাড়িতে ব্রজেন্দ্র দাসকে খুঁজে পায়নি বলে ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়িতে ভাঙচুর করে। তারা বলতে থাকে যে, গুঞ্জর আলী ও তার স্ত্রী কুলসুম বিবি ব্রজেন্দ্র দাসকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। তাই রাজাকার অধিনায়ক কুলসুম বিবিকে সামনে পেয়ে তাকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়। তার নির্দেশে রাজাকাররা কুলসুম বিবিকে বলপূর্বক তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য গুঞ্জর আলী বার বার রাজাকারদের অনুরোধ করেন। রাজাকাররা কুলসুম বিবির হাত ধরে এবং গুঞ্জর আলীর পা ধরে টানতে থাকে। রাজাকাররা রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করলে গুঞ্জর আলীর মাথা থেঁতলে যায় এবং তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়লে রাজাকাররা কুলসুম বিবিকে টানাহ্যাঁচড়া করে নদীর ঘাটে নিয়ে গিয়ে নৌকায় করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। কুলসুম বিবি চিৎকার করে সাহায্য প্রার্থনা করেন, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসতে সাহস পাননি। তার শিশু সন্তানরা নদীর পাড়ে মায়ের জন্য চিৎকার করতে থাকে। কুলসুম বিবির তখন বিধ্বস্ত অবস্থা। একদিকে তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে, তাকে বলপূর্বক অপহরণ করা হয়েছে এবং অন্যদিকে তার শিশু সন্তানদের দেখার জন্য কেউ রইল না। ক্যাম্পে নেয়ার পর ৩ দিন আটকে রেখে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। ৩ দিন পরে কুলসুম বিবিকে ছেড়ে দেয়া হলে তিনি নদী পার হয়ে অতি কষ্টে বাড়ি আসেন। এসে তিনি দেখেন যে, তার দুই শিশু সন্তান ক্ষুধার তাড়নায় আর ভয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে আর স্বামীর লাশ কুকুর-বিড়ালে খাচ্ছে। বিপর্যস্ত কুলসুম বিবি তার ক্ষুধার্ত সন্তানদের বাড়িতে থাকা কিছু মুড়ি আর পানি দেন। অসুস্থ শরীরে তিনি একা গুঞ্জর আলীর লাশ কোনোক্রমে দাফন করেন, কেননা রাজাকারদের ভয়ে অধিকাংশ গ্রামবাসী তখন পলায়ন করেছিলেন।

কয়েক দিন পরে বেশ কিছু গ্রামবাসী গ্রামে ফিরে আসেন। কিন্তু রাজাকারদের ভয়ে তারা কুলসুম বিবিকে এড়িয়ে চলতে থাকেন। আবার অনেকে ‘সে খারাপ মাইয়া হয়ে গেছে’- এমন মন্তব্যও করতে থাকেন। তাই গ্রামবাসীদের বাড়িতে তাকে কাজ করতেও দেয়া হয়নি।

গুঞ্জর আলীর পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন পার্শ্ববর্তী গ্রাম শ্যামারচর বাজারের বাঁশ ব্যবসায়ী কালা মিয়া। তিনি একজন সাহসী ও সমাজসচেতন ব্যক্তি ছিলেন। তার বয়স ছিল প্রায় ৫৫ বছর। গুঞ্জর আলীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কালা মিয়া কুলসুম বিবির সঙ্গে দেখা করেন এবং তার করুণ পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবগত হন। কালা মিয়াকে দেখে কুলসুম বিবি কিছুটা সাহস ফিরে পান। কালা মিয়া কুলসুম বিবিকে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেন। ইতোমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু গ্রামের মানুষ তখন পর্যন্ত কুলসুম বিবিকে অসম্মান করতেন। কিছুদিন পর কালা মিয়া কুলসুম বিবির সঙ্গে আলাপ করেন যে, যদিও তার বয়স কুলসুম বিবির চেয়ে ৩০ বছরের বেশি, তবুও যদি কুলসুম বিবি রাজি হয় তবে তিনি তাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত আছেন। কুলসুম বিবি কালা মিয়াকে জানান যে, তার প্রতি নির্যাতন হয়েছিল এবং তাকে বিয়ে করলে গ্রামবাসীর কাছে কালা মিয়া অপদস্থ হবেন। কিন্তু কালা মিয়া তাকে জানালেন যে, এই নির্যাতনের বিষয়ে কুলসুম বিবির কোনো দোষ নেই, যে কোনো নারীই এই বিপদের সম্মুখীন হতে পারতেন। আর কালা মিয়া সাহসী মানুষ, তাকে অপমান করার সাহস কারোর নেই। দুই সন্তানের লালন-পালনের কথা চিন্তা করে কুলসুম বিবি কালা মিয়ার সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর কালা মিয়া ১৩ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি কুলসুম বিবিকে ভালোবেসেছেন, সম্মান প্রদর্শন করেছেন ও তার সন্তানদের নিজের সন্তানের মতো লালনপালন করেছেন।

৬ ডিসেম্বর গুঞ্জর আলীর বাড়িতে ব্রজেন্দ্র দাসকে না পেয়ে রাজাকারদের আরেকটি দল তার বাড়িতে হানা দেয়। সেখানেও তাকে না পেয়ে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী প্রমীলা দাসের ওপর নির্যাতন চালায়। প্রমীলার স্বামী ব্রজেন্দ্র দাস পেটে গুলি নিয়ে আজো বেঁচে আছেন। সেদিন রাজাকারদের সঙ্গে সংঘর্ষে গ্রামবাসী ছাড়াও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার পেরুয়া গ্রামের যে স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল সেখানে আজো কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি। সরকারিভাবে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দীর্ঘদিনের দাবি এলাকাবাসীর।

লেখকঃ বীরপ্রতীক, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত