বঙ্গবন্ধু, এক বহুমাত্রিক দার্শনিক

12071

Published on সেপ্টেম্বর 11, 2018
  • Details Image

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তঃ

পলাশী প্রান্তরের নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকা-ের চেয়েও জঘন্যতম ঘটনা হলো ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনার আর কোন দৃষ্টান্ত নেই। যে পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করতে সাহস পাননি, সেই পাকিস্তানীরাই কিছু বাঙালী কুলাঙ্গারের সহায়তায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেন। জাতির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের বিচার এ দেশের মাটিতে হয়েছে। আরও বিচার হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর ও প্রত্যক্ষ গণহত্যায় জড়িত পাকিস্তানী দালালদের।

বঙ্গীয় সমতটের মানুষগুলো প্রাকৃতিক কারণেই ছিল স্বাধীনচেতা। হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাঙালী এ জাতিগোষ্ঠীর মননে এবং ঐতিহ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। প্রাচীন রাজ-রাজড়াদের আমল থেকে নিকট অতীতের পাল, মুঘল, নবাব, ইংরেজ শাসিত গৌড়, রাঢ়, বঙ্গসম আমলেই বাঙালীর স্বাধীনচেতা মননের পরিচয় পাওয়া যায়। সম্ভবত বাংলার ‘বার ভূইয়া’ খ্যাত আঞ্চলিক শাসক-নৃপতিদের শাসন ব্যবস্থা ও শাসনের ধরন থেকেই এর পরিচয় আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রভাবে এ জনপদের মানুষের মাঝে যেভাবে স্বাধীনচেতা মনোভাব বিরাজমান তা আর কোথাও তেমন প্রকট নেই। তাই কঠিন-কোমলে, আবেগে, উদাসী মনের মানুষের মিলনমেলা এ বঙ্গদেশে। এ জাতির চিন্তা-চেতনার সবটুকু ধারণ করেই হাজার বছর পর এক পরিপূর্ণ এবং শাশ্বত বাঙালীর রূপ ধারণ করে জোয়ার-ভাটার প্লাবন ভূমিতে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে আজকের বৃহত্তর ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আবির্ভূত হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের তথা তদানীন্তন পূর্ব বাংলার এক নিভৃত পল্লী বা অজপাড়াগাঁয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একটি সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন। জন্মের পর অতি কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর চারপাশের হতদরিদ্র মানুষের কঙ্কালসার ছবি। হয়ত প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁর মননে এ দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলোর দুঃখ-বেদনার প্রতিচ্ছবি গ্রথিত হয়েছিল। তারই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর সারা জীবনের রাজনীতি, ধ্যান ও জ্ঞানে। জীবনে শিক্ষার প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন এ দরিদ্র সর্বহারা মানুষের জীবনাচার থেকে মানুষের বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাদের অনুচ্চারিত, অব্যক্ত ধ্বনির মধ্যে। সেদিনই প্রাকৃতি পাঠের প্রথম অধ্যায়ে তাঁর জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য স্থির হয়ে গিয়েছিল। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন মানুষের মানবতার মুক্তির। প্রচলিত একটা কথা আছে ওভ ুড়ঁ ফড়হ’ঃ যধাব ধ ফৎবধস, যড়ি ধ ফৎবধস পড়সব ঃৎঁব? এখানেই ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য। কালামজীর মতে জীবনের লক্ষ্য ২০ বছরের মধ্যে স্থির করতে হবে, যা বঙ্গবন্ধু স্থির করেছিলেন তারও আগে। এ সত্যটা তাঁর জীবনে চরম সত্যে পরিণত হয়েছিল। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন শিশু-কিশোর জীবনে। চঞ্চল আবেগপ্রবণ কৈশোর স্বপ্ন দেখার সবচেয়ে বড় সময়। কবিরা স্বপ্ন দেখেন, তাদের দেখা আর দশজনের মতো নয়। তারা শুধু চর্ম চোখে সাদামাটা দর্শন করেন না, তাদের দেখা ব্যতিক্রম বলেই তারা হয়ে ওঠেন দার্শনিক। এপিজে আবদুল কালামের একটি বিখ্যাত উক্তি ‘যে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে সেটা আসল স্বপ্ন নয়, বরং যে স্বপ্ন তাকে ঘুমাতে দেয় না সেটাই প্রকৃত স্বপ্ন।’ এমন স্বপ্নই দেখেছিলেন দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল। ভারতের জাতির পিতা মোহন লাল করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। এরা সবাই স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ তৈরি করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তাদের সঙ্গে কতটা মিল আছে ইতিহাস তা সুস্পষ্টভাবে পৃথক করে দেখিয়ে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু নিছক স্বপ্নচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রকৃত স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি সারাজীবন লড়াই করে গেছেন। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য যে পথ বেছে নিয়েছিলেন তা একজন সুদূরপ্রসারী দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন প্রকৃত দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব। বাংলার স্বাধীনতার যে স্বপ্ন তিনি বুকে লালন করতেন তা বাস্তবে রূপ দিতে যে পরিকল্পনার দরকার তা তিনি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নিতে দ্বিধা করেননি, ভুলও করেননি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে তরুণ শিক্ষিত ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেন ‘ছাত্রলীগ’। পরের বছর সৃষ্টি করেন রাজনৈতিক দল প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক আওয়ামী লীগ। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে বাঙালী জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে। ১৯৫৪’র নির্বাচনে প্রবীণ নেতাদের পাশে তারুণ্যের তেজোদীপ্ত যুগান্তকারী নেতৃত্বের গুণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অসম মহিমায় তাঁর নিজের স্থান এবং নিজস্ব বলয় সৃষ্টিতে সফল হন। ’৫৮-তে বাঙালী বিদ্বেষী স্বঘোষিত লৌহমানব, সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের অপশাসন, শোষণ-অত্যাচার স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অন্তরের চক্ষুকে খুলে দেয়। ’৬২’র ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন, মেধাবী ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠন করেন ‘নিউক্লিয়াস’। এজন্য যে সেদিন সবাই তাঁকে বাহবা দিয়েছিল তা কিন্তু মোটেও নয়। বরং বহু প্রগতিশীল, বামপন্থী বিপ্লবী বন্ধুরা এটাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের সূচনা বলে নিন্দা-মন্দ বলতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু নিয়তির কি অমোঘ বিধান এ নিউক্লিয়াসের ধারাবাহিকতাই মহান মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার লড়াইয়ে বিশেষ অবদান রাখে।

১৯৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধের সময় অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের অসহায়ত্ব দেখে তিনি শিউরে উঠেছিলেন। সেদিনের সে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে দেশের পূর্বাংশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্বাতন্ত্র্য রক্ষাকবচ হিসেবে প্যারা মিলিশিয়া গঠনের দাবিসহ বাঙালীর মুক্তি সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। লাহোরে ঘোষিত ৬ দফা তখন বঙ্গবন্ধুর নিজের দল আওয়ামী লীগও গ্রহণ করেনি। গ্রহণ করেছিল ছাত্রলীগ। ৬ দফাকে এদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসহ প্রায় সবাই বিচ্ছিন্নতাবাদের দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করে তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কেউ দমাতে, নিরস্ত, এমনকি হতাশও করতে পারেনি। ’৬৬’র ৬ দফার কারণে দিশেহারা স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সৃষ্টি করে তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শত অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন উপেক্ষা করে আপন অভীষ্ট লক্ষ্যে হিমালয়ের মতো অবিচল হয়ে রইলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখে দেশবাসী নিজেদের মনের কথা শুনতে পেয়ে সমগ্র জনতা তাঁর পেছনে এসে দাঁড়াল। জনতার রুদ্র রোষে তাসের ঘরের ন্যায় ভেঙ্গে পড়ল স্বৈরাচারের অহমিকার দুর্গ। মুজিব আর শেখ মুজিব রইলেন না, হয়ে গেলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। ’৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল। লৌহমানব আইয়ুবের পতন হলো। ’৭০-এ নির্বাচন দিল ইয়াহিয়া সরকার। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক বলে দাবিদার বহু রাজনৈতিক দল ‘শর্ত সাপেক্ষ’ নির্বাচনের বিরোধিতা করল। বামপন্থী অনেকেই স্লোগান তুলল ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। আবার অতি প্রগতিশীলরা ধুয়া তুলল ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে নির্বাচনে গিয়ে প্রমাণ করে দিলেন জনগণ কি চায়, তাদের নেতা কে? শোষকগোষ্ঠীর টনক নড়ল। তিনি এখানে সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচন করে প্রমাণ করলেন আব্রাহাম লিংকনের চেয়ে তিনি গণতন্ত্রের কম পূজারী নন। এরা এদের পরিণতি সম্পর্কে যা বোঝার বুঝে ফেললেন। শুধু বুঝতে দেরি হলো অথবা জেগে ঘুমানোর মতো বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতে গিয়ে এরা যে দেশের মানুষের বিপক্ষে চলে গেলেন তখন তাদের আপসোস করা ছাড়া আর কোন গতি রইল না। অবস্থা বেগতিক দেখে কেউ কেউ ৬ দফা বাদ দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার ১ দফা ঘোষণা করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চাপ দিতে কার্পণ্য করেননি। জাতির পিতা দক্ষ নাবিকের মতো তাঁর পথ চলা শুরু করেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, আশা করেছিলেন, এমনকি অতি উৎসাহীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন ৭ মার্চ রেসকোর্সে ১০ লাখ জনতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু যেন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামান্য ভুলও করতেন তবে বাংলার স্বাধীনতা হতো না। বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদ নিয়ে লাখ লাখ জনতাসহ সেদিন তাঁকে জীবন দিতে হতো।

কৌশলে তিনি সব করলেন, তবুও বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ থেকে জাতিকে বাঁচালেন। তিনি প্রমাণ করলেন বাঙালীরা স্বাধীনতাকামী, বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়। ৭ মার্চ রেসকোর্সের চারপাশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র অবস্থান, আকাশে সামরিক হেলিকপ্টার ঘুরছিল শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুখ থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি শোনার অপেক্ষা। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হলো না। তবে ২৫ মার্চ এরা তার সুদসহ আদায় করেছিল। সেদিন পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্ট ছিল ‘চতুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সবাইকে বোকা বানিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে গেল আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’ সম্ভবত এটাই নেতৃত্বের ক্যারিশমা। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, পদ্ধতি কোন কিছুই বাদ দেননি। যারা বোঝার ঠিকই বুঝেছে। যারা বুঝেও অবুঝের মতো কাজ করেছে তাদের পরিণতি ইতিহাসই নির্ধারণ করে দিয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন চরিত বিশ্লেষণের বেশি কিছু দরকার নেই। শুধু ৭ মার্চের ভাষণই যথেষ্ট। সেখানে তিনি বলেছেন মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ কথা দুটি ভাষণে তিনি দু’বার উচ্চারণ করেছেন- ‘আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না। আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’। আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব। এ সবের মধ্যেই স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ তথা গেরিলা যুদ্ধের রূপরেখা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ভারতীয় মাউন্টেন ব্রিগেডের মেজর জেনারেল সোয়ান সিং ওভান আমাদের প্রশিক্ষণে একটা মন্তব্য করেছিলেন- ও I have never heard nor read such a historical speech and such a mighty word like Insallah.

নেতাজী সুভাষ বসু বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ লক্ষণীয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এখানে কতটা অগ্রগামী ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে ২০০১ সালে ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ উৎসবে এক আলোচনায় জানা যায় নৌ ও বিমান বাহিনীর অফিসার র‌্যাংকের কিছু বাঙালী সদস্য সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারত সরকারের সাহায্য কামনা করে। ভারত সরকার তাদের কাছে সিভিল নেতৃত্বের কথা জানতে চাইলে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রস্তাব করে।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেখ আমার দেশের মানুষ এখনও স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়নি। দেশের মানুষকে আগে জাগাতে হবে। তারাই একদিন স্বাধীনতা চাইবে। তা না হলে সশস্ত্র পথে স্বাধীনতা আসবে না।’ তিনি প্রসঙ্গক্রমে পলাশীর যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে বলেন, পলাশীতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং রবার্ট ক্লাইভের মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছিল পাশে ভাগীরথীর নদীর অপর তীরে কৃষকরা ধান ক্ষেতে কাজ করছিল। তারা জানত না কি হচ্ছে। তাদের কাছে সেটা ছিল রাজায় রাজায় যুদ্ধ। জনতার সম্পৃক্ততা থাকলে ফলাফল অন্যরকম হতো। উদাহরণ টানলেন মাস্টারদা সূর্যসেন চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড় ৩ দিন দখল করে রেখেও স্বাধীনতা আনতে পারেননি। কারণ জনসম্পৃক্ততা ছিল না। অতঃপর নেতাজী সুভাস বসু জাপানের সহযোগিতায় আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ইংরেজকে একটা ধাক্কা দিতে পেরেছিলেন, ক্ষুদিরাম বসুরা ইংরেজদের ঘুম হারাম করতে পেরেছিলেন; কিন্তু জনগণের সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা না থাকায় স্বাধীনতা আসেনি। তাই আগে আমি আমার জনগণকে তৈরি করি। তারাই একদিন স্বাধীনতা চাইবে। যদি সেদিন আসে ভারত বা ত্রিপুরা সরকারের সেদিন সাহায্য লাগবে। বাস্তবে তাই হয়েছিল। কত বড় দার্শনিক ও দূরদর্শিতা থাকলে এটা সম্ভব আজ তা বিশ্লেষণের দিন এসেছে।

শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এক কোটি বাঙালীর সঙ্গে লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধাও ভারতে গিয়েছিলেন। তোফায়েল আহমেদের ভাষায় ছাত্র যুবকরা ভারতে গিয়ে দেখে আগে থেকেই তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা আছে। সবার থাকা-খাওয়া, ট্রেনিং, অস্ত্র স্বাধীনতার বা মুক্তিযুদ্ধের জন্য যা প্রয়োজন সবই আছে। নেতৃত্ব? তাও আছে। ট্রেনিং সেন্টারে যখন মাইকে বেজে উঠত ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’

বাংলার স্বাধীনতা তাঁর জীবনে কেমনভাবে গ্রথিত হয়েছিল তা ভাবতেও অবাক লাগে। বাংলা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ দুটি মোটা দাগে বিভক্ত। প্রথম পর্ব স্বাধীনতা সংগ্রাম, দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্ব মুক্তিযুদ্ধ। ভাবতে অবাক লাগে বঙ্গবন্ধু তার সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে কোনদিন পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তাঁর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। তিনি বলেছিলেন ‘এই বাংলার’। সেদিন পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তেইশ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস মনুষ্য নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। ‘লক্ষণীয় যে, তিনি বারবার বাংলা শব্দটি উচ্চারণ করলেও কখনও পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি উচ্চারণ করেননি। এটাকে বলে আদর্শ।

৭ মার্চের ভাষণে তিনি রাজনীতির কবি হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন। এ উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে মহান নেতাদের বহু ভাষণ, আহ্বান রয়েছে। কিন্তু কোনটিই বিশ্ব সভায় স্থান পায়নি। এমনকি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদাও পায়নি। সে অনন্য স্বীকৃতি মিলেছে ৭ মার্চের ভাষণে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, মধ্যযুগের কবি, গীতিকার, বাউলরা তাদের রচনা বা সৃষ্টির মাঝে নিজেদের নাম যেভাবে ব্যবহার করতেন, যেমন মহাভারতের কথা অমৃত-সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান। এখানে কাশীরাম দাস নিজের পরিচয় ব্যক্ত করে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মিলন ঘটিয়েছেন। তেমনি লালনের প্রতিটি গানে, হাছন রাজার প্রতিটি গানে, এমনকি রাধারমণ, সাম্প্রতিককালে শাহ আবদুল করিমের প্রতিটি গানে গীতিকার বা কবির পরিচয় সহজ-সরলভাবে এবং যথার্থ ব্যঞ্জনায় স্থান পেয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ যদি যথার্থই একটি রাজনৈতিক কবিতা হয় তবে সেখানেও আমরা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করি কবি তাঁর কবিতার মাঝে কালীদাস, হাছন, লালন, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিমদের মতো নিজের নামটি যোগ করতে ভুল করেননি। যেমন তিনি উচ্চারণ করলেন- ‘১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডেকেছেন কিসের RTC? রক্তের দাগ শুকায় নাই। আর সেই তাজা রক্তের ওপর পা দিয়ে আর কিছুতেই RTC-তে শেখ মুজিব বসতে পারে না।’ ৭ মার্চের ভাষণটা যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দিয়েছেন তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর রেখে দিলেন। ৭ মার্চের ভাষণের পরে তিনি যে অসহযোগের ডাক দিলেন আজ থেকে খাজনা দেবেন না, তাতে তিনি মহাত্মা গান্ধীর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। ২৬ মার্চের রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে, সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়ে তিনি বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো এবং চেগুয়েভারার সমকক্ষ হয়ে রইলেন। তাই তো ক্যাস্ট্রোর ভাষায় ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি’।

’৭০-এর নির্বাচনের ইস্তেহার ঘোষণার পাশাপাশি একটি পোস্টার/লিফলেট ছাপা হয়েছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শিরোনামে। পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্যের চিত্র এতে স্থান পেয়েছিল। যা ছিল বাস্তব। কারণ পাকিস্তান সরকার এর কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। সেদিনও বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, এমনকি নিছক শুধু বাংলাও নয় উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বলে। একটা মানুষের রক্তে-মাংসে, অস্থি-মজ্জায় যে অবিনাশী চেতনা তা বিনাশের ক্ষমতা কি কারও আছে? নাকি ছিল? পৃথিবীর সব দেশেরই স্বাধীনতা দিবস আছে, কিন্তু বিজয় দিবস আছে কয়টি দেশের? এ সবের মূলে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তবে তিনি শুধু পরিকল্পনাই করেননি, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপও নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর বিদেশে গিয়ে যত ভাল কিছু দেখেছেন তা নিজের দেশে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। মানুষের তথা নিজের দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা ও অগাধ বিশ্বাস। তাইতো আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তীক্ষè প্রশ্ন করে বলেছিলেন ‘ আপনার বড় গুণ কি’? তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার মানুষকে ভালবাসি।’ ‘আপনার বড় দোষ কি?’ অবলীলায় তাঁর জবাব ছিল ‘আমি আমার মানুষকে বেশি ভালবাসি।’

পাকিস্তান আমলে বাঙালীদের সামরিক বাহিনীতে ভর্তি করা হতো না। অপবাদ ছিল এরা শুধু ভেতো বাঙালীই নয়, ভীতু বাঙালীও। বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি নির্দেশে এই ভেতো ও ভীতু বাঙালীর কাছেই বিশ্বসেরা বলে দাবিদার পাকিস্তানী সেনারা হাঁটু গেড়ে মাথানত করে লজ্জাজনক পরাজয়বরণ করেছিল। এই যে ইতিহাসের স্রষ্টা তিনি কি শুধুই একজন রাজনীতিক ছিলেন? না, মহাকাল তাঁকে একজন রাজনীতিবিদ, রাজনীতির অমর কবি, বহুমাত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবেও অভিষিক্ত করেছে।

১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লার এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘অনেক ব্যথা, অনেক দ-, অনেক জুলুম, অনেক মামলার আসামি, অনেক কারাগারের নির্যাতন- আমি শুধু নই, হাজার হাজার কর্মী সহ্য করে বাংলার মাটিকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করেছে। তোমাদের এখন একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, দেশ যখন আমাদের আছে, মাটি যখন আমাদের আছে, বাংলাদেশের সোনার মানুষ যখন আছে, যদি আমরা সোনার ছেলে পয়দা করতে পারি ইনশাল্লাহ আমার যে স্বপ্ন সোনার বাংলা তা একদিন হবেই। আমি দেখে যাবার না পারি, কিন্তু ইনশাল্লাহ হবে।’

লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত